বিবর্তনের ধারণা আর ঈশ্বরের ধারণা সহাবস্থান করতে পারে; কিন্তু প্রাকৃতিক চয়ন আর স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণা কখনও সহাবস্থান করতে পারে না। তাই শ্যাম এবং কুল, ঈশ্বর এবং বিবর্তন দু’দিকই বজায় রাখার জন্য বিবর্তন-মানা খ্রিস্টানরা বলতে শুরু করলেন, বিবর্তন বাস্তব ঘটনা, কিন্তু প্রাকৃতিক চয়ন ডারউইনের কপোলকল্পিত গালগল্প ছাড়া আর কিছুই না! কলমে আশীষ লাহীড়ি
হালের আমেরিকায় প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চায় ব্যক্তিবিজ্ঞানীর ধর্ম-পরিচয়টা কোনও বিবেচ্য বিষয়ই নয়। আর যদি বিবেচ্য বিষয় হয়-ও, তাহলে দেখা যাবে বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ হয় অজ্ঞেয়বাদী, না হয় নিরীশ্বরবাদী। তার চেয়েও বড় কথা, এমনকী, ধর্মপ্রাণ বিজ্ঞানীরাও তাঁদের পেশাদারি বিজ্ঞানকর্মের সঙ্গে তাঁদের ধর্মবিশ্বাসকে মেলান না। আমেরিকার সম্মানিত বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স’-এর সদস্যদের মধ্যে পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০০৯ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তা থেকে এই তথ্য বেরিয়ে আসে: ৩৩% বিজ্ঞানী ঈশ্বরে বিশ্বাসী, ১৮% কোনও একটা উচ্চতর সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী, ৪৯% নিরীশ্বরবাদী।
বিপরীতক্রমে, আমেরিকার জনসমষ্টির ৯৫% কোনও না কোনও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ঈশ্বরবিশ্বাসী বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথাক্রমে ২১% প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ১০% ক্যাথলিক; জনসাধারণের মধ্যে সংখ্যাটা যথাক্রমে ৫১ এবং ২৪। একটা স্পষ্ট মেরুকরণের চেহারা ফুটে ওঠে। সিদ্ধান্ত একটাই: আমেরিকায় বিজ্ঞানী আর বিজ্ঞান-অনবহিতরা যেন দুটো স্বতন্ত্র প্রজাতি। বিজ্ঞানে আমেরিকার অগ্রগতি যত ত্বরান্বিত হয়েছে, ততই বেড়েছে এই মেরুকরণ। ২০১৪ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বিজ্ঞানের মধ্যে ধর্মের নাক গলানো উচিত কি না, সে-প্রশ্নে আমেরিকার জনসাধারণের মধ্যে পরিষ্কার একটা বিভাজন রেখা আছে। মোটের উপর বয়ঃপ্রাপ্ত জনসমষ্টির অর্ধেক মনে করে, চার্চগুলোর উচিত বৈজ্ঞানিক বিষয়ের পলিসি নিয়ে মত প্রকাশ করা; এদের মধ্যে ইভ্যানজেলিকাল প্রোটেস্ট্যান্ট আর কৃষ্ণাঙ্গ প্রোটেস্টান্টরা প্রধান। অপর দিকে ৪৬%-এর মতে, চার্চগুলোর উচিত এসব থেকে সরে থাকা। এদের মধ্যে আছে সেসব গোষ্ঠী যাদের কোনও ধর্মীয় আনুগত্য নেই।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞান-বিরোধিতার মূল কারণটা রাজনৈতিক। মাত্র দু’-একটি ক্ষেত্রেই ধর্মীয় কারণে বিজ্ঞান-বিরোধিতা ব্যাপক রূপ ধারণ করে। ধর্মীয় কারণগুলির অন্যতম হল সেই আদি ও অকৃত্রিম জেনেসিস বনাম বিবর্তনবাদ।
[আরও পড়ুন: দেবালয় পুড়ছে, মণিপুরে পুড়ছে জনপদও, এই হিংসার শেষ কোথায়?]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিজ্ঞানবিমুখ ধর্ম-প্রীতির বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা একটু আশ্চর্যের এই কারণে যে, তাদের মাতৃভূমি ইংল্যান্ড-সমেত সমগ্র পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপে, এমনকী, পড়শি দেশ কানাডাতেও, সমাজের একটা বিরাট অংশের কাছে ধর্ম- খ্রিস্ট ধর্ম- জিনিসটা কার্যত প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। একটা নতুন শব্দ চালু হয়েছে এসব দেশের সমাজের চরিত্র ব্যাখ্যা করার জন্য: ‘পোস্ট-ক্রিশ্চিয়ান সোসাইটি’, খ্রিস্টোত্তর সমাজ; অনেকে পোস্ট-রিলিজন (ধর্মোত্তর) কথাটাও ব্যবহার করছেন। খোদ আমেরিকাতেও ঘটনাটা ঘটছে না, তা নয়, সেখানেও জনসমাজে নিরীশ্বরবাদীর অনুপাত ৩৯%। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চায় অগ্রগতির নিরিখে বড় বেশি শ্লথগতিতে ঘটছে সেই ঘটনা।
কীসে আলাদা আমেরিকা?
আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার অত্যন্ত গভীরে ঢুকে বসে আছে এই বিবর্তনবাদ-বিরোধিতার বীজ। যেমন ধরুন, জগদ্বিখ্যাত প্রিন্সটন কলেজ। আদিতে প্রিন্সটন কলেজ তৈরি হয়েছিল প্রেসবিটারিয়ান সম্প্রদায়ের পাদ্রিদের প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু কিছুকাল পরে যখন দেখা গেল, খাঁটি ধর্মীয় মতাদর্শ থেকে কলেজ সরে যাচ্ছে, তখন কট্টর প্রেসবিটারিয়ান-পন্থীরা প্রিন্সটন ধর্মমহাবিদ্যালয় (সেমিনারি) নামে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করল। প্রিন্সটন সেমিনারি বা ধর্মমহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ (১৮৫১-১৮৭৮) মহাপণ্ডিত চার্লস হজ (১৭৯৭-১৮৭৮) বাইবেলকে সাক্ষাৎ ঈশ্বরের বাণী বলে মানতেন। ঠিক-বেঠিকের বিচারে বাইবেলই ছিল তাঁর কাছে একমাত্র অভ্রান্ত নিরিখ। যতক্ষণ না বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্ব বা তথ্য বাইবেলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, ততক্ষণ বিজ্ঞান নিয়ে, এমনকী, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান নিয়ে তাঁর কোনও আপত্তি তো ছিলই না, বরং সমর্থন ছিল। মুশকিল হচ্ছে, বিবর্তন-তত্ত্ব, বিশেষ করে প্রাকৃতিক চয়ন বা নির্বাচনের ধারণা, সরাসরি বাইবেলের সেই কর্তৃত্বকেই আঘাত করল।
১৮৭৪ সালে হজ লিখলেন ‘What is Darwinism?’ তাঁর মতে, ডারউইনবাদ ঐশ্বরিক পূর্বপরিকল্পনা স্বীকার করে না, সুতরাং তা নিরীশ্বরবাদী, সুতরাং বর্জনীয়। কলেজে কলেজে যেভাবে ডারউইনের মতবাদ প্রভাব বিস্তার করছে, সেটা দেখে তিনি আতঙ্কিত হলেন। ঠিক এই সময়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি জন ম্যাকলিন-ও বিবর্তনবাদকে প্রত্যাখ্যান করেন। হজ-এর হাত কিছুটা শক্ত হল। সেমিনারি আর কলেজ উভয়েই হয়ে উঠল বিবর্তনবাদ-বিরোধী, কট্টর বাইবেল-পন্থী।
কিন্তু ১৮৬৮ সালে ম্যাকলিন অবসর নেওয়ার পর স্কটিশ দার্শনিক জেমস ম্যাক্কশ হলেন প্রিন্সটন কলেজের সভাপতি। তিনি ডারউইনবাদের সঙ্গে ঐশ্বরিক পূর্বপরিকল্পনার একটা আপস রফার উদ্যোগ নিলেন। তাঁর যুক্তি, ডারউইনের আবিষ্কারই তো প্রমাণ করে যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূলে আছে এক প্রাক্-পরিকল্পনা, এক বিশেষ দক্ষতা আর উদ্দেশ্যমুখিতা। তা যদি হয়, ডারউইনবাদকে কেন নিরীশ্বরবাদী বলা হবে? বাইবেলের সঙ্গে সে-তত্ত্বের যেটুকু দ্বন্দ্ব, তা অসমাধেয় নয়, মোটেই বৈরিতামূলক নয়। ম্যাক্কশ-এর আপত্তি বিবর্তনবাদ নিয়ে নয়, প্রাকৃতিক চয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে।
ব্যাপারটা আশ্চর্যের হলেও ব্যাখ্যাতীত নয়। এখন আমাদের কাছে ‘বিবর্তন তত্ত্ব’ আর ‘প্রাকৃতিক চয়ন’ একাত্ম, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির কথা আমরা ভাবতেই পারি না। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বিবর্তনের ধারণা আর প্রাকৃতিক চয়নের ধারণা এক নয়। ‘বিবর্তন’ মানে ক্রমিক বা ধাপে-ধাপে পরিবর্তন; আর ‘প্রাকৃতিক চয়ন’ হল সেই ধীরগতি পরিবর্তন- কী করে ঘটে- সেই প্রক্রিয়াটির ব্যাখ্যা। বিশ্বজগৎ যে পরিবর্তনশীল, এটা এতই প্রত্যক্ষ এবং স্বয়ংসিদ্ধ একটা ব্যাপার যে, মতান্ধ ছাড়া আর সকলেই এটা মানতে বাধ্য। খ্রিস্ট ধর্মের কয়েকটি শাখা অবশ্য এখনও মনে করে, ঈশ্বর হাজার ছয়েক বছর আগে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডখানা তৈরি করে ঠিক আজকের রূপেই প্রাণীদের বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন; তারপর থেকে তারা চরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন যে কোনও মানুষই, খ্রিস্টধর্মের অধিকাংশ শাখা সমেত, মানে, যে, এদের এই ছেলেমানুষি কথায় গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না। সুতরাং ম্যাক্কশ-এর ব্যাখ্যাটা দাঁড়াল এইরকম: যেহেতু ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনও কিছুই ঘটতে পারে না, অতএব ঈশ্বরই নিশ্চয় সেসব ধীরগতি পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কিন্তু সেটা মানলে তো ডারউইনের তত্ত্ব মিথ্যা হয়ে যায়। কারণ, তিনি তো এটাই দেখিয়েছিলেন যে, বিবর্তন ঘটে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে, ‘ঈশ্বর’ নামক কোনও এজেন্সির সেখানে কোনও ভূমিকা নেই। অজস্র তথ্যপ্রমাণ সহযোগে তিনি দেখিয়েছিলেন, সেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ারই নাম ‘ন্যাচরাল সিলেকশন’। পরিবর্তনশীল প্রতিবেশের সঙ্গে যে মানিয়ে নিতে পারবে, প্রকৃতি তাকেই ‘যোগ্য’ বলে বেছে নেবে, সে-ই টিকে যাবে, তাদের বংশধররাই সংখ্যায় বাড়বে। যারা মানাতে পারল না, তারা প্রকৃতির বাছাই-পরীক্ষায় অকৃতকার্য হল। কাজেই বিবর্তনের ধারণা আর ঈশ্বরের ধারণা সহাবস্থান করতে পারে; কিন্তু প্রাকৃতিক চয়ন আর স্রষ্টা ঈশ্বরের ধারণা কখনও সহাবস্থান করতে পারে না। তাই শ্যাম এবং কুল, ঈশ্বর এবং বিবর্তন দু’দিকই বজায় রাখার জন্য ম্যাক্কশ প্রমুখ বিবর্তন-মানা খ্রিস্টানরা বললেন, বিবর্তন নিশ্চয়ই একটা বাস্তব ঘটনা, কিন্তু প্রাকৃতিক চয়ন ডারউইনের কপোলকল্পিত একটা গালগল্প ছাড়া আর কিছুই না। এই সুবিধাবাদী অবস্থানের ফলে বিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালাতে কোনও অসুবিধা হল না, অপর দিকে স্রষ্টা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিও অচলা রইল।
আমেরিকায় কর্মরত বিজ্ঞানীদের বিপুল সাফল্য আমেরিকার সাধারণ মানুষের মন থেকে জাল-বিজ্ঞানের প্রতি দুর্মর আকর্ষণকে মুছে দিতে পারেনি এই একুশ শতকেও। তার অন্তত একটা প্রমাণ হল তামাম আমেরিকা জুড়ে অনেক টাকা খরচ করে ক্রিয়েশন মিউজিয়াম স্থাপন। ক্রিয়েশনিস্টদের মিউজিয়ামগুলো ছড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা জুড়ে: ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, ইডাহো, মানটানা, নিউ ইয়র্ক, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহায়ো, সাউথ ডাকোটা, টেনেসি, টেক্সাস, ওয়াশিংটন। সবচেয়ে বড়টি আছে কেনটাকির পিটার্সবার্গে। ‘আন্সার্স ইন জেনেসিস’ (সব উত্তরই জেনেসিসে আছে) নামক সংস্থার অধীনে ২০০৭ সালে ২৭ কোটি ডলার খরচ করে কেন্টাকির পিটার্সবার্গে ৭৫০০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে স্থাপিত হয় ‘ক্রিয়েশন মিউজিয়াম’। এখানে ‘ইয়ং আর্থ ক্রিয়েশনিস্ট’ নামক গোষ্ঠী বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ের আক্ষরিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বসৃষ্টির বিবরণ তুলে ধরে। এই মিউজিয়ামে আছে আধুনিক বিজ্ঞানের নানা উপচার, যথা বিশেষ জাদুক্রিয়া প্রদর্শনের প্রেক্ষাগৃহ, নিজস্ব প্ল্যানেটোরিয়াম, বিশাল এক পতঙ্গ-প্রদর্শশালা প্রভৃতি। মিউজিয়ামের স্থায়ী কর্মীদের শপথ নিতে হয় যে, তাঁরা মালিক সংস্থার নীতিতে বিশ্বাসী। এখানে দেখানো হয়, বিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল হাজার ছয়েক বছর আগে, সে-বিশ্বে ডাইনোসর আর মানুষ সহাবস্থান করত। আমেরিকার বিজ্ঞানী মহল শুধু নয়, মিউজিয়াম-বিশেষজ্ঞরা, এমনকী, কোনও কোনও খ্রিস্টীয় মহল পর্যন্ত এর তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু তাতে এদের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধিই পেয়েছে।
হিসাব বলছে, ২০০৭ থেকে মধ্য-২০১৫ পর্যন্ত প্রায় ২৪ কোটি লোক টিকিট কেটে
এই মিউজিয়াম দেখেছে, তার মধ্যে অনেকেই স্কুলের ছাত্রছাত্রী। এই সাফল্যে উৎসাহিত
হয়ে পরিচালকরা আরও বিশাল আকারে, আরও আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে চতুর্মাত্রিক প্রেক্ষাগৃহযুক্ত মিউজিয়াম বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে, আমেরিকার আমজনতার কাছে ক্রিয়েশনিস্টদের এই কাঁচা হাতের কাজ যতই জনপ্রিয় হোক, তা পরিশীলিত ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন-পন্থীদের মোটেই পছন্দ নয়। জেনেসিস কাণ্ডের এত স্থূল ব্যাখ্যা না দিয়ে অনেক পরিশীলিত একটা রূপ তুলে ধরে তারা।
পূর্বোক্ত জেনেসিস রিমেকের উপর বেশ একটু আধুনিকতার পোঁচ লাগিয়েছে তারা। সরাসরি মহাপ্লাবন-ফ্লাবনের উল্লেখ করে না, এরা বাইবেলের ‘বংশাবলি’-র অনুষঙ্গে পৃথিবীর বয়স নির্ণয় করে না। তাদের এই নয়া রিমেকে তারা ‘ইনফরমেশন থিওরি’, জিনের তথ্য সঞ্চারণ, মৌল কণা, অভিকর্ষ, তড়িৎচুম্বক ক্রিয়া, নিউক্লীয় বল প্রভৃতি ভারী ভারী আধুনিক বৈজ্ঞানিক বুলি ঢুকিয়ে দিয়েছে, যাতে লোকে বলে, ‘বাবা, কত জানে!’
তারা বলে, ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ হল প্রাণের উদ্ভব বিষয়ক ‘সাক্ষ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক এক তত্ত্ব’। তাদের মতে, অমিতবুদ্ধিশালী কোনও এক সত্তার বানানো ‘প্রোগ্রাম’ মেনেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি। খোদ বিজ্ঞানও সেই ‘প্রোগ্রাম’-এর অন্তর্গত। তাদের যুক্তি, বিশ্ব জুড়ে এই যে এত লোক নাওয়া-খাওয়া ভুলে ধর্মের পিছনে ছুটছে, তা থেকেই তো প্রমাণ হয়, মনুষ্যপ্রজাতির টিকে থাকার পক্ষে ধর্ম অপরিহার্য। ঈশ্বর মেনে যদি মানুষের ক্ষতিই হত, তাহলে কি সে-বিশ্বাস এতদিন ধরে টিকে থাকত? প্রকৃতি কবেই তাকে টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিত অঁাস্তাকুড়ে। ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ কোম্পানির আখড়া হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক রক্ষণশীলদের চিন্তা-চৌবাচ্চা হিসাবে সুপরিচিত ‘ডিসকভারি ইনস্টিটিউট’, যার সদর ঘঁাটি সিয়াটেল-এ।
কী তাদের অভীষ্ট? তাদের ওয়েব সাইটে লেখা আছে: বস্তু নয়, মনই সৃষ্টির উৎপত্তিমূল আর পরোৎকর্ষ, মনই মানুষের সকল সিদ্ধির উৎসমুখ। প্রাচীন হিব্রু, গ্রিক আর খ্রিস্টানদের মানসজাত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমেরিকা পত্তনের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই সংস্কৃতি সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করেছে, আবিষ্কারকে সম্ভব করে তুলেছে, মানুষের অনন্যতা আর মর্যাদাকে উচ্চে তুলে ধরেছে। এর বিপরীতে বর্তমানের বস্তুবাদী বিশ্বদর্শন, মানুষের অন্তর্নিহিত মর্যাদা আর স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছে, বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিশীলতা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনশীলতাকে খর্ব করেছে। মানুষের সম্ভাবনাকে একটি সীমাবদ্ধ চৌহদ্দিতে আবদ্ধ গ্রহের ক্ষীয়মান বৃত্তের মধ্যে আটকে ফেলে ওই বিশ্বদর্শন অভাব, সংঘর্ষ, পারস্পরিক সন্দেহ আর হতাশার মারাত্মক মতাদর্শগুলিকে ডেকে এনেছে। খ্রিস্টান আর ইহুদি ধর্মকে এক করে, বাইবেলের ওল্ড আর নিউ টেস্টামেন্টের মিলনে, সারা পৃথিবীর ওপর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সার্বিক আধিপত্য কায়েম করে যাবতীয় বস্তুবাদী মতাদর্শকে ধ্বংস করা এদের অন্বিষ্ট।
এরা চেয়েছিল, বিবর্তনবাদ-বিরোধী শিক্ষাক্রমকে আমেরিকার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে চালু করতে। একসময় বিবর্তনবাদ-বিরোধী ডাক্তারদের একজোট করার চেষ্টা করেছিল। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায় সে-চেষ্টা আইনত সফল না হওয়ায় এরা জেনে-বুঝেই একটা ‘গোঁজ কৌশল’ প্রণয়ন করে। যার অর্থ হল, সরাসরি বিবর্তনবাদকে ভুল এবং জেনেসিসের গল্পকে ঠিক বলে প্রচার না-করে মানুষের মনের মধ্যে বিবর্তনবাদ সম্বন্ধে একটা সন্দেহের গোঁজ ঢুকিয়ে দেওয়া। যাতে আর কিছু না হোক, অল্পবয়সিরা আর অল্প-বিজ্ঞান-জানা লোকেরা বিবর্তনবাদ সত্য কি না তা নিয়ে সন্দেহে ভোগে এবং বিকল্প হিসাবে বাইবেলের দিকে ঝোঁকে।
এই কূটচক্র থেকে মুক্তির পথ আমেরিকার বিজ্ঞানী মহল আর মানুষকেই বের করতে হবে। তবে ততদিন আমরা আমেরিকার বিপুল বৈজ্ঞানিক সাফল্যর সঙ্গে অবিজ্ঞান-অপবিজ্ঞানের ব্যাপক সহাবস্থান দেখে বেদনাহত ও বিস্মিত হতেই থাকব।
পুনশ্চ আমাদের দেশেও সম্প্রতি নবম-দশম শ্রেণির সিলেবাস থেকে চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে বাদ দেওয়া হল। অর্থাৎ বলা যায়, বিবর্তনবাদ-বিরোধী শিক্ষাক্রমকে এখানেও পরিকল্পিতভাবে গোঁজ ব্যবস্থার মাধ্যমে সুপরিপক্ব করার প্রয়াস চলছে। বৈজ্ঞানিক সাফল্যে পাশাপাশি সহাবস্থান করতে না পারুক, অপবিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের পল্লবিত শাখায় ভারত কিন্তু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পাশেই বসতে পারে। একে কীর্তি বলব, না অপযশ, আপনারাই বলুন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক
ashish.lahiri@gmail.com