shono
Advertisement

নাছোড় কেন্দ্রের প্রতাপ

কেন্দ্রীয় সরকার অর্ডিন্যান্স এনে দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষমতা হাতে রাখা সুনিশ্চিত করেছে।
Posted: 04:18 PM May 24, 2023Updated: 04:30 PM May 24, 2023

যে-দেশের এক পূর্ণ রাজ্য একলহমায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়ে যেতে পারে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার অধিকার নেই সাংসদদের, সংবিধানের উপরে আইনসভাকে বসাতে মন্ত্রী-সান্ত্রিরা গলা ফাটান, সংসদের অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও নতুন সংসদের উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতিকে ব্রাত্য রাখা যায়, সে-দেশে দিল্লিকে মুঠোয় রাখতে অর্ডিন্যান্স জারি তেমন অবাক করে কই! কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

 

সুপ্রিম কোর্টকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার অর্ডিন্যান্স এনে দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষমতা হাতে রাখা সুনিশ্চিত করেছে। তা করেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে, চাতুরির সঙ্গে, ঘুণাক্ষরেও কাউকে টের পেতে না দিয়ে। এই ত্বরিত রাজনৈতিক চাল সুপ্রিম কোর্টকেও নিশ্চয়ই বিস্মিত করেছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের সর্বসম্মত রায় অস্বীকার, অবজ্ঞা ও নস্যাতের বার্তা এটাই- তোমরা কিচ্ছুটি করতে পারবে না। সাংবিধানিক মূল্যবোধ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো চুলোয় গেলে যাক, দিল্লিতে অন্য কাউকে ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে আমরা দেব না।

সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে সেই সময়- সর্বোচ্চ আদালত যখন গ্রীষ্মাবকাশে চলে গিয়েছে। কতটা চাতুরির সঙ্গে ব্যাপারটা করা হল বোঝা যায় অবকাশে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টকে রায় পুনর্বিবেচনার আরজি পেশের মধ্য দিয়েই। সুপ্রিম কোর্ট সরকারের আরজি গ্রহণ করল এবং অবকাশে চলে গেল। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অর্ডিন্যান্স জারি করল সরকার! হতচকিত মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিহ্বলতা কাটিয়ে এখন যেভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাইছেন, তাতে তরী কতটা তীরে ভিড়বে, বলা কঠিন। কারণ, এখনও কেউ কেউ জেগে ঘুমচ্ছে। কেউ বাকি জীবন নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাতে পছন্দ করছে। কেউ বা বোধবুদ্ধি বিকিয়ে স্বস্তি অর্জনের আশায় নতমুখ থাকা শ্রেয় মনে করছে। ঝাড়ে বাঁশ সাধ করে কে-ই বা ঘরে তুলতে চায়? তাই, রাজ্যসভায় বিরোধীদের বিরোধিতার মুখে বিলটি খারিজ হবে, গণতন্ত্রের মহিমার নতুন বিচ্ছুরণ ঘটবে এবং পশ্চিমি পরিভাষায় ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ হোঁচট খাবে, সে-কথা জোর দিয়ে বলা কঠিন। যদিও কর্ণাটক জয়ের পর এই ঘটনা ছন্নছাড়া বিরোধীদের হয়তো আরও খানিকটা কাছাকাছি আনবে। কেন্দ্রের সঙ্গে লড়াইটা কেজরিওয়াল লড়ছেন ২০১৫ থেকেই। বিজেপি ও কংগ্রেসকে নাস্তানাবুদ করে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক উপ-রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর সেই যে সংঘাতের শুরু, আজও তা থেকে নিস্তার পেলেন না। মুখ্যমন্ত্রিত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন যখন, তখন উপ-রাজ্যপাল তখন নাজীব জং।

তার একবছর আগে দেশের ক্ষমতা দখল করেছেন নরেন্দ্র মোদি। দিল্লিকে আস্তিনের ভাঁজে আটকে রাখতে না-পারা তাঁর নিদারুণ রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তাঁর রাজত্বেই দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি ‘অজ্ঞাতকুলশীল’ কেজরিওয়াল দখল নেন। সেই থেকে দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রকৃত মালিক নির্ধারণের টানাপোড়েনের যবনিকা পতন ঘটল সুপ্রিম কোর্টে। কিন্তু নাছোড় কেন্দ্রের দৌলতে তা-ও হতে চলেছে ক্ষণস্থায়ী। কী করবেন কেজরিওয়াল?

[আরও পড়ুন: জেলে আত্মহত্যাার চেষ্টা, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কে বাঁচিয়েছিল কুণাল ঘোষকে?]

এই আট বছর ধরে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে মোকাবিলা করতে হয়েছে মোদি সরকারের পছন্দের দুই উপ-রাজ্যপালের সঙ্গে। প্রথমে ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত দুঁদে আমলা অনিল বাইজাল, তারপর পোড়খাওয়া রাজনীতিক বিনয়কুমার সাক্সেনা। কেজরিওয়াল ও তাঁর সরকার কোণঠাসা হয়েছেন অন্যভাবেও। সত্যেন্দ্র জৈন ও মনীশ সিসোদিয়ার মতো মন্ত্রী জেলে। তাঁকেও তিহার-বন্দি দেখতে মুখিয়ে রয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রের সাঁড়াশি আক্রমণ কতদিন ঠেকাতে পারবেন, জানেন না। যেটুকু আশার আলো সুপ্রিম কোর্ট দেখিয়েছিল, বুদ্বুদের মতো তাও দ্রুত মিলিয়েছে। স্ফটিক জলের আশায় চাতকের মতো কেজরিওয়াল তাকিয়ে আছেন রাজ্যসভার বিরোধীদের বোধ, বুদ্ধি ও বিবেচনার দিকে। গত ন’-বছরের খতিয়ান যদিও ভরসাযোগ্য নয়।

কী করবে সুপ্রিম কোর্ট, তাও বোধের অতীত। অর্ডিন্যান্স জারির অধিকার কেন্দ্রের আছে। সেই অর্ডিন্যান্স সংসদে পাস করিয়ে আইন করার অধিকারও সংবিধানসম্মত। এক্ষেত্রে যে-অধিকার সরকার প্রয়োগ করল, তা পুরোপুরি সুপ্রিম কোর্টের সর্বসম্মত রায়ের পরিপন্থী। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ ও জমি ছাড়া সব ক্ষমতা (আমলাশাহির নিযুক্তি ও বদলির অধিকার-সহ) থাকবে নির্বাচিত সরকারের হাতে। পাঁচ বিচারপতির সর্বসম্মত রায়ের নির্যাস, অনির্বাচিত উপ-রাজ্যপাল নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে চালনা করতে পারেন না। তা গণতন্ত্রর পরিপন্থী। তাছাড়া অনির্বাচিতের হুকুম আমলাশাহির যথেচ্ছাচারিতাকেই প্রকট করবে। তারা দায়বদ্ধ থাকতে পারবে না। কিন্তু সরকার নিজস্ব যুক্তি ধরে অন্য পথে এগিয়ে কর্তৃত্ব ফলিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট শাঁখের করাতের মুখোমুখি। এই সাংবিধানিক সংকটের হাল কী হবে, কারও জানা নেই। বিতর্কের অবসান দু’ভাবে ঘটতে পারে। আইনি লড়াই ও রাজনৈতিক লড়াই। আইনি লড়াইয়ের ফল যা-ই হোক, ভারতীয় গণতন্ত্রে তা বিতর্কের অবকাশ রেখে যাবেই। বিজেপি এই লড়াইকে নতুন আঙিনায় টেনে নিয়ে গিয়েছে বলেই নয়, আইনসভার উপরে বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব তারা কিছুতেই ফলাতে দেবে না। বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে মোদি সরকারের কট্টর অবস্থান সেই অনড় মনোভাবেরই পরিচয় দেয়। রাজনৈতিক লড়াইয়ে সমাধান হতে পারে দিল্লি ও কেন্দ্রে এক দলের সরকার কায়েম হলে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস সেই অবস্থানে ছিল বলেই শীলা দীক্ষিত নির্বিবাদে রাজত্ব করে গিয়েছেন। সেই সময় বিজেপির প্রধান স্লোগান ছিল, ক্ষমতায় এলে দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দান। এখন ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে নতুন তত্ত্ব, নতুন যুক্তি, নতুন উদ্যোগ, নতুন অর্ডিন্যান্স, নতুন লড়াই।

দিল্লি রাজধানী। রাজধানীর ভাল থাকা, মন্দ থাকার উপর দেশের ভাবমূর্তি নির্ভরশীল। সরকার তাই এমন কিছু করতে দিতে চায় না, যাতে রাজধানী দিল্লির জীবনযাত্রা দেশকে অহেতুক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

বছর পাঁচেক আগে কেন্দ্র-কেজরিওয়াল কাজিয়া নিয়ে এই স্তম্ভেই যে-যুক্তির অবতারণা করেছিলাম, আজ তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কেন্দ্রে যে-দলই ক্ষমতায় থাকুক, রাজধানী দিল্লির উপর কর্তৃত্বের রাশ কিছুতেই আলগা হতে দেবে না। সে সময় লিখেছিলাম, যে-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অধিকার নেই মুখ্য সচিব পছন্দ ও নিয়োগ করার, দুর্বিনীত আমলাকে সরানোর, অধিকার নেই সরকারি জমিতে স্বেচ্ছায় কিছু স্থাপনার, যে-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘হুকুম’ পুলিশ হেলায় অগ্রাহ্য করতে পারে, সেই রাজ্য থাকাটাই তো অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন! সেই রাজ্যে বিধানসভা থাকা তো বিলাসিতা!

নির্বাচন কি শুধুই গণতান্ত্রিক প্রহসন? মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা নিধিরাম সর্দার ও করুণার পাত্র? কেন তবে এই বিপুল অর্থ অপচয়? এসব বাদ দিয়েও তো দিব্যি চালানো যায় দিল্লি। সেই দিল্লি হবে পুরোপুরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। চালক হবেন উপ-রাজ্যপাল। তাঁর অধীনে থাকবে পুরসভা, একটি অথবা একাধিক। মেয়ররা চালাবেন দৈনন্দিনের কাজ। চাবি থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের জিম্মায়। কেজরিওয়ালদের তাহলে দৈনন্দিন অসম্মানিত হতে হবে না। ভারত সরকারকেও দিল্লির দরুন ভাবমূর্তি খোয়ানোর আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় ভরা বিনিদ্র রজনী কাটাতে হবে না। কাউকে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে হবে না। বেঁচে যাবে করদাতাদের কোটি কোটি টাকা। কোনও একদিন এমন যে হবে না, হলফ করে বলি-ই বা কী করে?

যে-দেশের এক পূর্ণ রাজ্য একলহমায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয়ে যেতে পারে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার অধিকার সাংসদদের দেওয়া হয় না, সংবিধানের উপরে আইনসভাকে বসাতে মন্ত্রী-সান্ত্রিরা গলা ফাটান, নিজের নামে স্টেডিয়ামের নামকরণে প্রধানমন্ত্রী অসম্মানিত বোধ করেন না, সংসদের অভিভাবক হওয়া সত্ত্বেও নতুন সংসদের উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতিকে ব্রাত্য রাখা যায়, সে-দেশে দিল্লিকে মুঠোয় রাখতে এই দাওয়াই তো নস্যি?

বিতর্ক অবসানের তৃতীয় পন্থা অবশ্যই রাজ্যসভায় বিলটির অপমৃত্যু। সে চেষ্টা শুরু হয়েছে, অবশেষে অনেক দাম দিয়ে দেরিতে হলেও কেজরিওয়ালের বোধোদয় ঘটেছে বলে। কিন্তু আগেই বলেছি, জাগরুক নিদ্রিতের নিদ্রাভঙ্গ অসম্ভব! মায়াবতী, নবীন, জগনমোহনরা মূক, বধির ও অন্ধ সেজে থাকা শ্রেয় মনে করতেই পারেন। অন্তত নিজের ঘরে আগুন যতদিন না লাগছে। তাতে প্রলয় কিন্তু বন্ধ থাকবে না।

(saumyabandyo@gmail.com)

[আরও পড়ুন: কর্ণাটকের সহজপাঠ, দুর্নীতিতেই ধাক্কা খেয়েছে ব্র্যান্ড মোদি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement