সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক : নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা চালানোর ঘটনায় ধৃত অস্ট্রেলিয়ান যুবককে শনিবার সকালে ক্রাইস্টচার্চ হাইকোর্টে তোলা হয়। এরপর কোনও শুনানি ছাড়াই তাকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারপতি। বর্তমানে ওই বন্দুকবাজের নামে একজনকে খুনের মামলা দায়ের হলেও পরবর্তী সময়ে বাকিদের খুনের অভিযোগ অর্ন্তভুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে। আদালতে শুনানির সময় যাতে কিছু বলতে না হয়, তাই নিজের ঠোঁটও কেটে ফেলেছিল ধৃত ব্রেন্টন হ্যারিসন টারান্ট।
শহরের বুকে দু’টি মসজিদে ঢুকে নির্বিচারে গণহত্যা। ফেসবুকে তার সরাসরি সম্প্রচার করে গোটা বিশ্বে আতঙ্ক তৈরি করা। তাতেই ক্ষান্ত ছিল না ক্রাইস্টচার্চের বন্দুকবাজ ২৪ বছরের অস্ট্রেলীয় যুবক। হামলার কিছুক্ষণ আগেই ইন্টারনেটে ৭৪ পৃষ্ঠার একটি ইস্তাহার পোস্ট করে সে। যার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য, মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ও নিজের কট্টরপন্থী মতাদর্শের কথা। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে এশিয়া, আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে প্রবল ঘৃণায় অন্ধ ছিল ব্রেন্টন হ্যারিসন টারান্ট।
তার নামে যে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে একাধিক মানুষকে খুনের দৃশ্য সম্প্রচার করা হয়, সেই একই ছবি ও পরিচয়ে টুইটার অ্যাকাউন্ট ছিল টারান্টের। ফেসবুকেও সে নিজেই ১৭ মিনিট ধরে এই হামলা চালানোর ভিডিও দেখিয়েছে। সেখানেই দেখা গিয়েছে, গোঁফ-দাড়ি কামানো এক ককেশীয় যুবককে। ছোট করে ছাঁটা চুল। গাড়ি চালিয়ে আল নূর মসজিদে ঢুকছে। তার কিছুক্ষণ পরেই প্রার্থনা করতে আসা নারী-পুরুষ-শিশু লক্ষ্য করে নির্বিচারে শুরু করছে গুলি চালানো।
[স্বামীকে বাঁচিয়ে খোয়ালেন নিজের প্রাণ, ক্রাইস্টচার্চে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বাংলাদেশি মহিলার]
ক্রাইস্টচার্চ থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুনেদিনর বাসিন্দা টারান্টের এই নৃশংস হামলার নেপথ্যে চরমপন্থী ভাবধারা রয়েছে। যেটা সে ৭৪ পাতার ইস্তাহার আকারে শুক্রবার সকালেই টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছে। পরে অবশ্য সেই ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। ব্রেন্টন টারান্ট যে অস্ট্রেলীয় নাগরিক, তা জানিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনও। ঘটনার কড়া নিন্দা করে এই বন্দুকবাজকে তিনি বলেছেন, “চরমপন্থী, দক্ষিণপন্থী, খুনি এবং একজন হিংস্র জঙ্গি।” সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বন্দুকবাজ যে মতাদর্শ প্রকাশ করেছে, তাতে রয়েছে মোট ৭৪টি পাতা এবং প্রায় ১৬,৫০০ শব্দ। এই ইস্তাহারটিকে সে প্রকাশ করেছে ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ নাম দিয়ে। সেখানে মুসলিমদের আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে সে। এই মতাদর্শের মাধ্যমে ‘নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে পদক্ষেপ’ করার কথা বলা হয়েছে। ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ নামে একটি ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব এক সময় ফ্রান্সেও তৈরি হয়েছিল। যাতে বলা হয়েছে, অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থীদের জন্য নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ছে ইউরোপীয়রা। তাদের উচ্চ হারে সন্তান জন্মের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে ইউরোপীয়দের। পৃথিবী জুড়ে সমস্ত সংকটের মূল কারণ হিসেবে শরণার্থীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
নিজেকে নিম্ন আয়ের শ্রমিক শ্রেণির মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে টারান্ট জানিয়েছে, ২০১৭ সালে ফ্রান্সের চরম দক্ষিণপন্থী নেত্রী মারিন লা পেঁ-র পরাজয় এবং ওই বছরেই স্টকহোমে ট্রাক হামলায় ১১ বছরের এব্বা অকুরলাঁদের মৃত্যু পর সে কট্টরপন্থায় আকৃষ্ট হয়। টারান্টের লাইভ ভিডিও থেকে দেখা যায়, তার বন্দুকে লেখা আছে আলেসান্দ্রে বিসনেত্তা এবং লুকা ত্রাইনির নাম। ২০১৭ সালে কানাডায় একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয় নিরপরাধকে হত্যা করেছিল বিসনেত্তা। ২০১৮ সালে ইতালিতে আসা শরণার্থী আফ্রিকানদের উপর গুলি চালিয়েছিল লুকা ত্রাইনি। এর থেকেই স্পষ্ট, কৃষ্ণাঙ্গ এবং মুসলিম বিদ্বেষই ছিল এই শ্বেতাঙ্গ বন্দুকবাজের মতাদর্শের মূল কথা।
ইউরোপের মাটি থেকে বিদেশিদের তাড়াতে এবং ইউরোপের লক্ষ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে টারান্টের ইস্তাহারে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য নিয়ে একটি স্লোগানও দেওয়া হয়েছে এই ইস্তাহারে। বলা হয়েছে, ‘আমাদের শ্বেতাঙ্গ শিশুদের ভবিষ্যৎ আমাদেরই হাতে।’ কৃষ্ণাঙ্গ এবং মুসলিম বিরোধী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হলেও কোনও দলের সঙ্গে সে যুক্ত নয়, এমনটাই জানানো হয়েছে ইস্তাহারে। এমনকী, নিজের কাজের জন্য তার কোনও অনুশোচনা থাকবে না বলেও জানিয়েছে এই বন্দুকবাজ। প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, এই অস্ট্রেলীয় নাগরিক বেশ কিছু দিন ধরেই ঘাঁটি গেড়েছিল নিউজিল্যান্ডে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে চরমপন্থী মতাদর্শের কথা প্রচার করলেও তাকে কেন নজরদারির তালিকায় রাখা হয়নি, তা নিয়ে সরব হয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি।
The post ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে গণহত্যার খলনায়কের পুলিশ হেফাজত appeared first on Sangbad Pratidin.