ইন্দ্রনীল শুক্লা: নব্বই বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গিয়েছে সেই ঘটনার। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর। বেলা তখন বারোটা। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে গেলেন ‘বিলাতি’ পোশাক পরিহিত তিন বাঙালি যুবক। হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন অত্যাচারী কর্নেল সিম্পসনের ঘরে। সিম্পসন কিছু বোঝার আগেই গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেলেন। এভাবে যাঁরা ব্রিটিশের পাঁজরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাই বিনয়কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশচন্দ্র গুপ্ত। সেই তাঁদেরই দেখা গেল অরুণ রায় পরিচালিত ‘৮/১২ বিনয় বীদল দীনেশ’ ছবিতে। গোটা দেশ যখন সাধারণতন্ত্র দিবসে মেতে, তখন তিন বিপ্লবীরূপে পর্দায় এলেন কিঞ্জল নন্দ, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, রেমো। কিন্তু এ তো কেবল ছবি নয়। তাই নিছক এক সিনেমা হিসাবে তো দেখা চলে না। মনে মনে বুঝে নিতে হবে সেই সময়টাকে।
কেমন সে সময়? কেমন সে বাঙালি? কোন দেশের হয়ে অলিন্দে লড়ে প্রাণ দিয়েছিলেন এই তিন যুবক? কলকাতাই—বা তখন কেমন ছিল? এই প্রশ্নগুলো এই অবসরে জারিয়ে নেওয়া বড় প্রয়োজন।
সেদিনের লড়াইয়ের পর কেউই বাঁচেননি। বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খান। আর বিনয় ও দীনেশ মাথায় গুলি করেন। বিনয় হাসপাতালে সবার অলক্ষে নিজের ক্ষতস্থানে আঙুল চালাতে চালাতে সেপটিক করে ফেলেন। মারা যান। আর দীনেশের ফাঁসি হয়। আর কেউ কোনও দিন ফিরে আসবেন না। কিন্তু যদি আবার কলকাতা আসতে চাইতেন তাঁরা, তবে কেমন করে আসতে হত? এর উত্তর, পাসপোর্ট—ভিসা দেখিয়ে। না, হেঁয়ালি নয়। তিনজনই যে ছিলেন অধুনা বাংলাদেশের। শুনলেই আজও বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠে, তাই না! বেঁচে থাকলে ওই তিন জনকে হয়তো বলতে হত, তাঁদের দেশ ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট নয়, স্বাধীন হয়েছে পঞ্চাশ বছর আগে! প্রসঙ্গটা তোলায় ছবির পরিচালক অরুণ রায় বললেন, ‘‘আসলে বাঙালির বিপ্লবের গল্প বলতে গেলে তো অবিভক্ত বাংলার কথা আনা ছাড়া উপায় নেই। আমি মোহনবাগান ক্লাব নিয়ে যখন ‘এগারো’ ছবিটা বানিয়েছিলাম তাতেও দেখা গিয়েছে যে, সেই দলে এখনকার ভৌগোলিক হিসাবে এপার বাংলার মাত্র দু’জন আছেন। বাকি সবাই অধুনা বাংলাদেশের। আবার আমি তো হীরালাল সেনকে নিয়ে ছবি বানিয়েছি। সেই বাঙালিও তো এখনকার হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ। দেশভাগের কষ্ট বাঙালির বুক থেকে কোনও দিনই যাওয়ার নয়।’’
[আরও পড়ুন: সাদা লালপেড়ে শাড়িতে কনের সাজে মৌনী রায়, দক্ষিণী রীতিতে সাত পাকে বাঁধা পড়লেন অভিনেত্রী]
বিনয় জন্মেছিলেন মুন্সিগঞ্জ জেলায়। মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুলে ডাক্তারি পড়েন, যেটি বর্তমানের স্যর সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ। এ সময়ই তিনি ঢাকা-কেন্দ্রিক বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে এসে যুক্ত হন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলে। দীনেশের জন্ম মুন্সিগঞ্জ জেলায়। ঢাকা কলেজে থাকাকালীন তিনিও যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে। আর বাদল ছিলেন বিক্রমপুরের ছেলে। বানারিপাড়া স্কুলে শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের মাধ্যমে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স! কলকাতায় গড়ে ওঠা সে সংগঠনের কথাই—বা ক’জন মনে রেখেছেন! কিন্তু এই সংগঠনের কর্মকাণ্ড অনেকটাই আমরা ঝালিয়ে নিতে পারি ‘৮/১২’ ছবির সঙ্গে। আসলে সেই কলকাতা তো আজকের কলকাতা নয়।
১৯৩০ সালের কলকাতা হল সেই শহর, যার গা থেকে অবিভক্ত ভারতের, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার রাজধানী হওয়ার অভিজাত গন্ধ তখনও ভুরভুর করছে। আর তখন টগবগ করে ফুটছে যে জাতি, তার নাম বাঙালি। সে জাতি যা ভাবছে, বাকি অবিভক্ত ভারত তখন সেটাই অনুসরণ করছে।
জানা যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় সুভাষচন্দ্র বসু গঠন করেন বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় মেজর সত্য গুপ্তর কাঁধে। উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়া। সত্য গুপ্ত সারা বাংলা ঘুরে উদ্যমী, দেশপ্রেমী তরুণদের একাট্টা করতে থাকেন। সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষও। এক সময় এই সংগঠনের সঙ্গেই যুক্ত হন বিনয়—বাদল—দীনেশরা।
পরিচালক অরুণ রায় বলছেন, ‘‘আজকের তরুণদের জানা দরকার, আজ সকলে স্বাধীনতার যে আনন্দ উপভোগ করছেন, তাতে অনেক মানুষের বলিদান আছে। বাঙালির আত্মত্যাগ আছে।
বিনয়—বাদল—দীনেশ আসলে যোদ্ধা বাঙালির গল্প। এ গল্প বাঙালির সেই ত্যাগের গল্প, যারা ডাক্তারির কেরিয়ার ছেড়ে বন্দুক হাতে দৌড়ায় গোরা সাহেবকে মারবে বলে। তাই ছবি দেখে বেরিয়ে ভুলে গেলে চলবে না বাঙালির ফেলে আসা এই সাহস, এই আত্মত্যাগ।’’ এমন বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে উদ্যোগী হয়েছেন যিনি, সেই কান সিং সোধা জয়পুরের আজমেঢ় অঞ্চলের মানুষ। কর্পোরেট জগতে কাজের সূত্রে কুড়ি বছর ধরে কলকাতার বাসিন্দা। এমন ছবি কেন প্রযোজনা করলেন? সোধা প্রায় স্পষ্ট বাংলায় বললেন, ‘‘এই ছবি আমি ব্যবসা করার জন্য বানাইনি, বিশ্বাস করুন। আমি বাংলায় এসে বাংলাকে ভালবেসে ফেলেছি। আমার এই ছবি বিপ্লবীদের প্রতি ট্রিবিউট। আমি শুধু চাই মানুষ এই ছবি দেখুন এবং বিবিডি বাগকে শুধু একটা বাসস্ট্যান্ড কিংবা অফিসপাড়া না ভেবে সেই বিপ্লবীদেরও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করুন।’’
অতএব, রাইটার্স বিল্ডিং, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, জিপিও, টেলিফোন ভবন, লালদিঘির গমগমে ‘ডালহৌসি স্কোয়্যারে’ দাঁড়ালে ‘আত্মবিস্মৃত’ বাঙালির একবার যেন মনে পড়ে সেই মারাত্মক ট্রায়ো ‘বিবিডি’-র কথা। বুকের ভয়টা কমে যাবে। লড়াইয়ের বল ফিরে আসবে অবক্ষয়ের সময়ে। সেই যে স্বামীজি বলতেন, ‘একবারই তো মরবে’!