সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: শুকনো পরিসংখ্যান আর কতটুকু ব্যাখ্যা করতে পারে ক্রিকেটারকে! ঠিক যেভাবে লোকাল কমিটির হিসেব-নিকেশ ধরতে পারে না সুভাষ চক্রবর্তীকে। তুলনার দুই বিন্দু আপাত দৃষ্টিতে আলাদা মনে হতে পারে। তবে এ রাজ্য তো দেখেছিল কীভাবে জননেতার প্রয়াণে ঢল নেমেছিল সাধারণ মানুষের। মুছে গিয়েছিল শাসক-বিরোধী পরিচয়। অতএব পার্টির ইশতেহারও ব্যর্থ হয় জননেতার জনপ্রিয়তার সামনে। যেমন ক্রিকেটারের সামনে এসে গাধা হয়ে যায় স্কোরবোর্ড। স্যার নেভিল কার্ডাস ঠিকই বলেছিলেন, এ খেলার আবেগ, দক্ষতা পরিমাপের জন্য সত্যিই অন্য কোনও মাপকাঠি দরকার। বিশেষত যদি ক্রিকেটারের নাম হয় এবি ডিভিলিয়ার্স, তবে পরিসংখ্যানের সত্যিই গাধা হওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।
এবি মানে তো কটা রেকর্ড নয়, স্কোর বোর্ডের সংখ্যা নয়। এবি মানে শাসনের ঔদ্ধত্য, ক্রিকেট উপবনে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নতুন করে লেখা। এবি মানে উইলো হাতে তৈরি করা নিজস্ব সভ্যতা। তাই ক্রিকেট দুনিয়াকে যখন তিনি বিদায় জানাচ্ছেন, তখন মন খারাপের মেঘ জমেছে গোটা বিশ্বের অনুরাগীদের মনে। তাঁর বিদায়ে নস্ট্যালজিয়ার যে বৃষ্টি, কোনওভাবে তা মাপা সম্ভব হলে দেখা যেত, ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকায় ধারাপাতে কোনও ফারাক নেই।
অথচ কী আশ্চর্য, ডিভিলিয়ার্স তো ভারতের হয়ে কোনওদিন খেলেননি। বরং ভারতের প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলেন তিনি। এই সেদিনও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভারতের সিরিজ জয় ছিল দূরাগত কোনও স্বপ্ন। এমন একটা সময়ে এবি খেলেতে এলেন যখন ভারতীয় ক্রিকেট সোনালি শীর্ষ ছুঁয়েছে। নীল জার্সিতে স্বমেজাজে সম্রাট শচীন। বাঁ-হাতে অফ সাইডের ঈশ্বর সৌরভও সেরা ফর্মে। আজহারউদ্দিন পরবর্তী পর্যায়ে স্টাইলিশ হায়দরাবাদি লক্ষ্মণ কবজির মোচড়ে যেন রোমান্সের খোলা চিঠি পাঠাচ্ছেন ভারতীয় ক্রিকেট অনুরাগীদের মনে। অন্যদিকে বিনীত পরাক্রমেই ক্ল্যাসিক রচনা করছেন দ্রাবিড়। সুতরাং ভারতীয়দের ভাঁড়ারে ঐশ্বর্য তো কম নয়। আজ ভাবতে অবাক লাগে এবি যখন ব্যাট-প্যাড গুছিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন এত ভারতীয়র মনে কুয়াশা কেন? এখানেই আসলে জিতে যায় ক্রিকেট। যে এবির জন্য সকলের মন খারাপ তিনি নিঃসন্দেহে সবুজ-হলুদ জার্সি গায়েই খেলতেন। কিন্তু গোটা বিশ্ব আজ সে রং ভুলে গিয়েছে। শুধু মনে রেখেছে, কীভাবে তিনি মাথা উঁচু করে বেপরোয়া লাফিয়ে ওঠা বলকে শিশুকে শাসনের ভঙ্গিতেই পাঠিয়ে দিয়েছেন বাউন্ডারির খেলাঘরে। কিংবা অফ স্ট্যাম্পের অনেকখানি বাইরে ফেলে রাখা প্রলোভনকে হাঁটু মুড়ে উড়িয়ে দিচ্ছেন গ্যালারির দিকে। যেন বুঝিয়ে দিচ্ছেন চাইলেই যে কোনও অপ্সরী তাঁর ধ্যান ভাঙাতে পারেন না। বরং প্রতিভাবলে কেউ কেউ যে কোনও প্রলোভনকেই বিনয়ী হতে শেখায়। ফলে বোলার দিশেহারা হয়েছে। রেকর্ড বুকে নয়া কীর্তিগাথা গড়ে উঠেছে। আর ক্রিকেটবিশ্ব পেয়েছে তার ঈশ্বরের সফলতম দূতকে। ফলে আজ যখন তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাচ্ছেন তখন এক হয়ে গিয়েছে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা, বলা ভাল গোটা ক্রিকেটবিশ্ব।
ফ্ল্যামবয়েন্ট তো নন। ওয়ার্নের মতো সমালোচিতও তিনি নন। গেইলের মতো কালারফুল কেরিয়ারও নয় তাঁর। ওদিকে শচীনের মতো ঈশ্বরপ্রতীমও নন তিনি। কিংবা সৌরভের মতো নেতার সাফল্যের মুকুটও তাঁর নেই। কিন্তু স্যার কার্ডাস ক্রিকেটকে যে আবেগের ব্যারোমিটারে ফেলার কথা বলেন, সেখানেই তিনি সিদ্ধহস্ত। দেশের হয়ে খেলতে খেলতে তিনি তাই গড়ে তোলেন তাঁর আদরের সাম্রাজ্য। তৈরি করেন নিজস্ব নিয়মকানুন। জন্টি রোডস যেমন ফিল্ডিংকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাবীকাল তেমনই বলতে বাধ্য হবে, শট নেওয়ার দক্ষতা ও উদ্ভাবনে ডিভিলিয়ার্সও একখানা আস্ত রুলবুক। যে কোনও বলের গায়ে যে বাউন্ডারির ঠিকানা লেখা যায় তা দেখিয়েছেন এবি। যে কোনও পরিস্থিতিতে যে ক্রিকেটকে ভালবাসা আর উপভোগ্য করে তোলা যায়, নিছক অঙ্কের বাইরে, হিসেবের নিগড় থেকে বের করে ক্রিকেটকে যে প্রেমের উপন্যাস করে তোলা যায় তা তিনি জানতেন। হাতে-কলমে করেও দেখিয়েছেন। এ উপন্যাসে চরিত্র বহু। তবে নায়ক তিনি একাই। একের পর এক পাতা যোগ করে চলেছিলেন এই চোদ্দটা বছর ধরে। আর চমৎকৃত হয়েছিল বিশ্ব। ক্রমে ক্রমে মুছে গিয়েছিল দেশ-কাল সীমানার গণ্ডি। আজ যেন আপনমনেই সে উপন্যাসের শেষ লাইনটি লিখে ব্যাক কভারটি বন্ধ করে দিলেন এবি। অনুরাগীরা তাই সফর শেষের বেদনায় ভারাক্রান্ত। কিন্তু এবি বোধহয় জানেন শেষ পাতার ফাঁকা জায়গায় যে সম্মানটুকু লেখা থাকল তাঁর জন্য, কোনও পরিসংখ্যানই তা কখনও ছুঁতে পারে না।
এবি তাই জানাচ্ছেন, বিদায় নেওয়ার এটাই সঠিক সময়। তবু শিল্পকে কে ছাড়তে চায়! কে না চায় সৌন্দর্যের উপবনে নান্দনিক ভ্রমণ! এবির ব্যাট যা উপহার দিত অনায়াসে। আর তাই এবি যাই বলুন না কেন, অনুরাগীরা মনে মনে আজ শুধু বলছেন, ‘সমানে মনে হয় হয়নি সময়’। ক্রিকেটবিশ্বকে গরিব করে এভাবেই কি ব্যাট-প্যাড তুলে রাখতে হয় এবি!
The post এভাবে ব্যাট-প্যাড গুটিয়ে রাখলেন এবি! ক্রিকেটবিশ্ব আরও গরিব হল appeared first on Sangbad Pratidin.