বিশ্বদীপ দে: শ্রীরামচন্দ্রের (Shri Ram) অকালবোধনের ফলেই শরৎকালে দুর্গাপুজোর (Durga Puja) সূচনা। একথা কে না জানে! কিন্তু এই অকালবোধনেরই কত অজানা কাহিনি ছড়িয়ে আছে, আমরা তার খোঁজ রাখি না। যার মধ্যে অন্যতম হল, রাবণ নাকি রামচন্দ্রের পুজোয় পৌরোহিত্য করেছিলেন! হ্য়াঁ, এমন কাহিনিও শোনা যায় বইকি।
না। বাল্মীকির রামায়ণে (Ramayana) রামচন্দ্রের এই পুজোর উল্লেখ নেই। তবে কৃত্তিবাস ওঝা সবিস্তারে লিখেছেন অকালবোধনের কথা। এছাড়া দেবী ভাগবত পুরাণ ও কালিকাপুরাণেও রয়েছে এর উল্লেখ। তাছাড়া পুঁথি থেকে পুঁথিতে ভাষান্তর, নতুন ঘটনার সংযোজন তো ছিলই। তারপর লোকায়ত চর্চায় মিশে যায় নানা কাহিনি।
[আরও পড়ুন: অল্প সুরাপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল! মদের বোতলে ‘সতর্কবার্তা’ লেখার আরজি খারিজ সুপ্রিম কোর্টের]
কিন্তু রাবণ কেন রামের অকালবোধনের পুরোহিত হলেন? তিনি তো জানতেনই রামচন্দ্র তাঁকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করতে চান। নিজেই নিজের মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে কেন চাইলেন রাক্ষসরাজ? তার আগে আরেকটা বিষয়ে একটু বলে নেওয়া যেতে পারে।
অনেকেই ভাবতে পারেন, রাবণ কী করে ব্রাহ্মণ হলেন? আসলে রাবণের বাবা বিশ্রবা মুনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। তাই রাক্ষসী কৈকসীর পুত্র হলেও রাবণ ব্রাহ্মণ। এখানেই শেষ নয়, শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন তিনি। সংস্কৃতজ্ঞ, সুপণ্ডিত এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী করা রাবণকে তাই একজন উচ্চশ্রেণীয় ব্রাহ্মণ হিসেবেই ধরা হত। কেবল রাবণই নন, অহিরাবণ এবং মহিরাবণের মতো রাবণ বংশীয় অন্যদের সম্পর্কেও বলা হয়, তাঁরা রীতিমতো সাধক ছিলেন।
[আরও পড়ুন:সল্টলেকে বিজেপির দুর্গাপুজোয় মহিলা পুরোহিত, আসতে পারেন নাড্ডা-শাহ ]
যাই হোক, অকালবোধনের কাহিনিতে ফেরা যাক। রাম-রাবণের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে যখন একে একে লঙ্কার বড় বড় বীররা ধরাশায়ী, তখন রাবণ মা দুর্গার স্তব করলেন। দুর্গা কালীরূপে রাবণকে অভয় দিলেন। মা কালীর কোলে আশ্রিত রাবণ যুদ্ধে অপরাজেয় হয়ে উঠতে লাগলেন। এই পরিস্থিতিতে দুর্গাকে তুষ্ট করতে অকালেই (বসন্তকালের বদলে শরৎকালে) তাঁর পুজো করতে মনস্থ করলেন রাম। কিন্তু সেই পুজোয় কে করবেন পৌরোহিত্য?
রামের অকালবোধনের পুরোহিত হিসেবে রাবণের নাম উত্থাপন করেন স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা। তিনিই পরামর্শ দেন, ”তোমার এই পুজোর উপযুক্ত পুরোহিত হতে পারেন রাবণই।” অগত্যা রাক্ষসরাজ রাবণকেই পৌরোহিত্যের প্রস্তাব দেন রঘুনন্দন। আর রাবণও রাজি হয়ে যান।
বোধনের মন্ত্র বলার সময় রাবণ উচ্চারণ করেন, ”রাবণস্য বধার্থায়…” অর্থাৎ নিজের মৃত্যুর জন্য পুজোয় নিজেই পৌরোহিত্য করলেন, সংকল্প করলেন তিনি। আসলে রাবণ জানতেন, রাক্ষস বংশের উদ্ধারের জন্য রামের হাতেই তাঁর বধ হওয়া প্রয়োজন। আর সেই কারণেই এই পুজোয় পৌরোহিত্য করতে তাঁর রাজি হওয়া।
কিন্তু দেখা গেল, রাবণ যতই পৌরোহিত্য করুন, যুদ্ধে তিনি অপরাজেয়। রাম যতবার মুণ্ডচ্ছেদ করেন ততবার সেই ছিন্ন মাথা জোড়া লেগে যায় দেবীর আশীর্বাদে। এই পরিস্থিতিতে রাম বুঝতে পারলেন চণ্ডী অশুদ্ধ করতে হবে। আর উপায় নেই। এই ভার পড়ল হনুমানের উপর। মাছির রূপ ধরে পবনপুত্র গিয়ে চণ্ডীর উপরে। ঢাকা পড়ল একটি অক্ষর। ফলে মন্ত্র পড়তে গিয়ে ভুল করলেন রাবণ। তিনি ওই একটি অক্ষর উচ্চারণ না করায় চণ্ডী হল অশুদ্ধ।
চণ্ডী অশুদ্ধ হওয়ার এই কাহিনি কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে আলাদা। সেখানে বলা আছে, রাবণ রামের পুজোর কথা জানতে পেরে শঙ্কিত। তাই দেবীর কৃপা পেতে তিনি ডাক পাঠালেন দেবগুরু বৃহস্পতিকে। রাত্রিকালে চণ্ডীপাঠ নিষিদ্ধ। আর তাই বৃহস্পতি বেঁকে বসলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাবণের রক্তচক্ষু দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি শুরু করলেন পাঠ। আর তখনই সেখানে হাজির হলেন হনুমান। মাছির রূপ ধারণ করে। ‘যথা বৃহস্পতি আছে, উপনীত তাঁর কাছে,/ একমনে করে চণ্ডীপাঠ ।।/ মক্ষিকার রূপ ধরে, চাটিলেন দ্বি অক্ষরে,/ দেখিতে না পান বৃহস্পতি ।/ অভ্যাস আছিল তায়, পড়িল অবহেলায়,/ হনুমান সচিন্তিত অতি ।।’ স্বাভাবিক ভাবেই চণ্ডীপাঠে ত্রুটি হওয়ায় দেবী ক্রুদ্ধ হলেন। এদিকে রাবণও পালটা ক্রোধ দেখিয়ে বললেন, যেহেতু দেবী তাঁর শত্রুর পক্ষ নিয়েছেন, তাই দেবীও এখন তাঁর শত্রু। এমনই রাক্ষসরাজের অহং। আসলে মহাজ্ঞানী হলেও রাবণ শেষ পর্যন্ত ছিলেন রাক্ষসগুণসম্পন্ন, দাম্ভিক। সাধে কী বলেছে ‘অতি দর্পে হত লঙ্কা…’ ফলে দেবীর কৃপা আর রইল না রাবণের উপরে। প্রশস্ত হল তাঁর বধের পথ।
এর সঙ্গেই এসে পড়ে, মানস সরোবর থেকে আনা ১০৮টি নীলপদ্মের সেই কাহিনি। হনুমানের এনে দেওয়া পদ্মগুলি দেবীর উদ্দেশে অর্পণ করতে গিয়ে রামের নজরে পড়ল একটি পদ্ম কম। তখন তিনি নিজের নীলপদ্মের মতো চোখ দেবীকে নিবেদন করতে চাইলেন। এরপর? কৃত্তিবাস বলছেন, ”চক্ষু উৎপাটিতে রাম বসিলা সাক্ষাতে।/ হেনকালে কাত্যায়নী ধরিলেন হাতে।।/ কর কি কর কি প্রভু জগৎ গোঁসাই।/ পূর্ণ তোমার সংকল্প চক্ষু নাহি চাই।।” এরপর দেবীর বরপ্রাপ্ত রামের পক্ষে রাবণকে বধ করা ছিল কেবলই সময়ের অপেক্ষা।
বসন্তকালের বদলে শরৎকালে দেবীর সেই পুজোই আজকের দুর্গাপুজোর কাহিনি। যা বাল্মীকি রামায়ণে নেই। পরে সংযোজিত হয়েছে। আবার অকালবোধনে রাবণের পৌরোহিত্যের কাহিনিও একই ভাবে ঢুকে পড়েছে কোনও কোনও রামায়ণের কাহিনিতে। আসলে রামায়ণের নানা সংস্করণ ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিভিন্ন সংস্করণগুলির কথা ভাবতে বসলে সত্যিই অবাক হতে হয়। চেনা কাহিনি বদলে বদলে গিয়েছে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির আঁচে! রামায়ণ-মহাভারতের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘এত বড়ো বৃহৎ দুইটি গ্রন্থ, আমাদের সমস্ত ভারতবর্ষ-জোড়া দুইটি কাব্য, তাহাদের নিজের রচয়িতা কবিদের নাম হারাইয়া বসিয়া আছে— কবি আপন কাব্যের এতই অন্তরালে পড়িয়া গেছে।’ এভাবেই মহাকাব্য দেশের ভিন্ন সংস্কৃতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে।