সর্বত্রই দারিদ্রের কান্না, কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি। পাঁচতারা হোটেল থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গঙ্গাসাগরের প্রত্যন্ত দ্বীপ- সব জায়গায় দেখি, মানুষ দিশাহারা। আর্থিক সমীক্ষা ভবিষ্যৎবাণী করছে, আগামী বছরে শতকরা ৮ থেকে ৮.৫ হারে অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু এই বৃদ্ধির জন্য বাজারে জিনিসপত্রের জন্য যে-চাহিদা বাড়া দরকার, ততটা বাড়বে কী করে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
আমি এক উভচর প্রাণী। দিল্লিতেও থাকি, কলকাতা-হাওড়াতেও থাকি। ব্যাঙের মতো। জলেও। ডাঙাতেও। রাজপথ থেকে গিয়েছিলাম জনপথে। দেড়মাস সেখানে কাটিয়ে আবার রাজপথে। এর মধ্যেই ভারতের আর-একটি বাজেট পাস হয়ে গেল। চ্যানেলে-চ্যানেলে, সংবাদমাধ্যমে শিরা ফুলিয়ে, মুষ্টি পাকিয়ে ‘গ্ল্যাডিয়েটর’-দের লড়াই দেখলাম। যেদিন বাজেট পাস হল, সেদিন ছিলাম হাওড়ার শিবপুরে। গঙ্গার পশ্চিম কূল। বারাণসী-সমতুল। বিই কলেজের সামনেই সনৎদার ছোট চায়ের দোকান। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৬ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক একবছর আগে। তা সনৎদার বাজেট নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। বললে, জেনে কী হবে আমার? বললাম, দুধ-চিনির দাম বাড়ল কি না, তা-ও জানতে চাও না? সনৎদা বলল, বাড়লে তো জানা যাবেই। বাজেট জেনে আর আমার কী হবে? আমরা তো যেখানে আছি, সেখানেই থাকব। বরং বিই কলেজটা খোলা দরকার। ৫০০০ খদ্দের।
বাজেট যা-ই হোক, দেশজুড়ে অর্থনৈতিক অবস্থা যে শোচনীয়, তা নিয়ে তো বিতর্কের অবকাশ নেই। বাজেটের দিন সকালে হোয়াটসঅ্যাপে কেউ একটা মেসেজ পাঠালেন। বাজেটের পর কোন রাজনৈতিক দল কী প্রতিক্রিয়া দেবে, তা আগাম ঘোষণা করেছেন তিনি। বিজেপি বলবে, এ এক ঐতিহাসিক বাজেট। সিপিএম বলবে, আম্বানি-আদানির বাজেট। কংগ্রেস বলবে, উন্নয়নবিরোধী বাজেট। তৃণমূল বলবে, মানুষবিরোধী বাজেট। কিন্তু রাজপথ থেকে জনপথ- সর্বত্রই দারিদ্রের কান্না, কর্মহীনতা, মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি। পাঁচতারা হোটেল থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গঙ্গাসাগরের প্রত্যন্ত দ্বীপ- সব জায়গায় দেখি, মানুষ দিশাহারা। সরকারের নিজের হিসাবই বলছে, ২০ কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। প্রত্যেক দিন আমিই গড়ে চার থেকে পাঁচজন ছেলেমেয়ের করুণ আর্তি শুনি, চাকরি চাই। নানা প্রতিষ্ঠান থেকে মাস কমিউনিকেশন পাশ করে শয়ে শয়ে ছাত্রছাত্রী চাকরি চাইছে। মন খারাপ হয়ে যায় প্রতিদিন। চাহিদা আর জোগানের সমস্যা তীব্র।
[আরও পড়ুন: আবিদ, শাহ, হাবিবুররা ছিলেন নেতাজির বিশ্বস্ত, বিজেপি যেন না ভোলে]
বাজেটের পরের দিন আমি রাজপথে। পাঁচতারা একটি হোটেলের কফিশপে। দেখি ওয়াই-ফাই নেই। অনেক ডাকাডাকির পর, বেশ কিছুক্ষণ পরে এক যুবক এসে জানালেন, আর্থিক সংকট ও করোনা-বিপর্যয়ের জন্য, শুধুমাত্র যাঁরা আমাদের হোটেলে থাকছেন, তাঁদের মধ্যেই আমরা ওয়াই-ফাই পরিষেবা সীমাবদ্ধ রাখছি। রুম নম্বরকে পাসওয়ার্ড করে এ-পরিষেবা পাবেন। বাইরের অতিথিরা এই সুযোগ পাবেন না। আরও শুনলাম, আগে দু’টি টেবিলের জন্য একজন কর্মী ছিল। এখন কফি শপে রয়েছে মোট কর্মীসংখ্যার অর্ধেক।
হাওড়ার রামরাজাতলা বাজারে এক মনোহারি দোকানে এসে কেদারনাথ স্কুলের এক অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই পোস্ত চাইলেন। দোকানদার বললে, ভাল ব্র্যান্ডের পোস্ত নিন। দাম একটু বেশি। কিন্তু একদম মিহি। ভাল কোয়ালিটি। তা মাস্টারমশাই বললেন, বাপু ওসব কেতায় আর কাজ নেই। এমনিতেই পোস্তর খুব দাম। শখ হয়েছে তাই অনেক দিন পর গিন্নি আলুপোস্ত বানাবে, ওসব ব্র্যান্ড দরকার নেই বাপু। পেনশনে ব্র্যান্ড পোস্ত হয় না।
কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলাম। ৪৪ বাসে চেপে হাওড়া এলাম হ্যারিসন রোড দিয়ে। দুপুরবেলা। বাসে ভিড় নেই। ব্যান্ড পার্টির দোকান থেকে বড় বড় আড়তদার দোকান পেরিয়ে বড়বাজার-পোস্তা হয়ে হাওড়া ব্রিজে উঠলাম। একটি ছেলে ও মেয়ে সহযাত্রী। সাঁকরাইল যাবে। একই গ্রামের বাসিন্দা। কলেজের বন্ধু। মেয়েটি জিজ্ঞেস করছিল, কী করবে এবার কলেজ পাস করে? মানে সম্ভবত, গ্র্যাজুয়েট হয়ে? ছেলেটি জানলা দিয়ে চলন্ত বাজার দেখতে দেখতে বলল, আমি ঠিক করেই ফেলেছি প্রোমোটারি করব। অনেক টাকা। আমাদের ছাত্রজীবনে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত মা-বাবা প্রায় প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখতেন, ছেলে আমার ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। ছেলেমেয়েরা অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখত। স্বপ্নভঙ্গ হলে পর অমলকান্তির মতো হয়তো কেউ বাড়ির দালালি করতে পারে, কিন্তু তা’ বলে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনা লেখার সময় কেউ এতটা প্র্যাকটিকাল ছিল না!
রাজনীতিতে স্বপ্ন বিক্রি করতে হয়। এখন তো আমরা এক ধরনের নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্রে বসবাস করি। সারা বছর ধরে ভোট। বড়, মেজো, ছোট- নানা ধরনের। আর্থিক সমীক্ষা ভবিষ্যদ্বাণী করছে, আগামী বছরে শতকরা ৮ থেকে ৮.৫ হারে অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু এই বৃদ্ধির জন্য বাজারে জিনিসপত্রের জন্য যে-চাহিদা বাড়া দরকার, ততটা বাড়বে কী করে? সাড়ে চার কোটি মধ্যবিত্ত দারিদ্রসীমার নিচে নেমে গিয়েছে। ১০ কোটি কৃষকের আয় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগে শুরু হল ‘অমৃত কাল’। ২৫ বছরের পরিকল্পনা।
এ সবটাই করোনার জন্য বলে এই বহিরাগত ভাইরাসকে ‘কেষ্টা ব্যাটা’ বলে চিহ্নিত করাও ঠিক না। হতে পারে, এই ভাইরাস পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে দিয়েছে। কিন্তু আর্থিক অসাম্য তো দুনিয়াজুড়ে বহুদিন আগে থেকেই ক্রমবর্ধমান। ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। পশ্চিমে বলা হচ্ছে, ‘প্লুটোক্রেসি’। একদা ছাত্রজীবনে ভাবতাম, পার্লামেন্ট ‘শুয়োরের খোঁয়ার’। বড়লোকদের ঢাক তৈরি হয় গরিব লোকের চামড়ায়। অতএব, ধনীদের খতম করলেই সর্বহারাদের গণতন্ত্র এসে যাবে। গণসংগীত গেয়ে সে-সময়ে বিপ্লব আনতে চেয়েছিলাম। এখন বুঝি, বড়লোকদের শেষ করতে গিয়ে মাওবাদীরাই ‘প্রচণ্ড’ হয়ে ক্ষমতার কুর্সিতে বসে পড়লেন। অথচ দারিদ্র নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পেলেন বাঙালি। আর আমি এক রিপোর্টার ভূতনাথ, হরিদাস পাল, গালে হাত দিয়ে ভাবছি, বাজেটটির মাধ্যমে কি তবে আর্থিক সংকট মোচন হবে? পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ, ইজরায়েলের মতো দেশের কাছ থেকে মোসাদ আর স্টার্ট আপ দুটোই শিখে আমরা স্বনির্ভর হয়ে যাব? ’৪৭ সাল থেকে তো স্বনির্ভর হয়েই চলেছি। সরকারি বিজ্ঞাপনের মতো করে আমরা গরিব মানুষ, মধ্যবিত্ত সবাই হাতে হাত ধরে হাসছি।
তবে এটা কাণ্ডজ্ঞান থেকে এই রিপোর্টার বুঝেছে, বড়লোকরাও যদি কিপটে হয়ে যায়, তবে কিন্তু ধনী সমাজের সঞ্চিত সম্পত্তি আরও বাড়বে। গরিবরাও বিপদে পড়বে। এই যে দিল্লির খান মার্কেট, এখানে এসে যদি কোনও ব্যবসায়ী বা রাজনেতা কয়েক কোটি টাকা দিয়ে একটা রোলেক্স ঘড়ি না কেনে, তবে তো সে দোকানের মালিকের রোজগার হবে না। মালিক গরিব হয়ে গেলে কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে হবে। দুর্গাপুজোয় উৎসব কমিটির কতিপয় তস্কর নেতা নিজের ঝোলায় কিঞ্চিৎ রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারে। সে তো ‘মৃচ্ছকটিক’-এর সময়ও ছিল, কিন্তু দুর্গাপুজোর মোচ্ছব বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকির অন্নসংস্থান থেকে পুজো প্যান্ডেলে ঝালমুড়ি-ফুচকা-তেলেভাজা বিক্রেতারও রোজগার বন্ধ হয়ে যায়।
এ এক জটিল অঙ্ক। কে. সি. নাগ থাকলে সমাধান করতে পারতেন কি না জানি না। বেশ হত, রাজনৈতিক নেতারা বাজেটে যেসব প্রতিশ্রুতি দেন, সেগুলো যদি সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়ে যেত। সিনেমার মতো। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো মানে শুধু ধনীর লাভ? না কি শিল্পপতির লাভ হলে কিছুটা হলেও কোম্পানির অন্য কর্মীদের ছাঁটাই কমবে, ইনসেনটিভ বাড়বে? আবার গরিব মানুষদের ভর্তুকি বন্ধ করে দিলেই ধনীদের লাভ? জিডিপি-র ভাল? আরে বাবা, গরিব আর মধ্যবিত্তের হাতে টাকা না এলে বাড়ি কিনবে কে? গাড়ি কিনবে কে? ছাত্রজীবনে সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষের ‘মেট্রোপলিটন মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’ পড়ে প্রথম জেনেছিলাম, বিজ্ঞাপন কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে কীভাবে। গ্রামের মেয়েটা চূড়ান্ত দারিদ্রে দিনাতিপাত করে, কিন্তু খেতে না-পেলেও ব্র্যান্ডেড প্রসাধন ব্যবহার করতে শিখেছে। কিন্তু এখন বিজ্ঞাপনেও কাজ হচ্ছে না। জোগান নেই, উপভোক্তার বাসনা-কামনা নেই।আর, আমি আপাতত এক উভচর প্রাণী, সাংবাদিকতার পেশার বেসাতি করি বটে, কিন্তু মনের কষ্টগুলোও জানাতে ব্যাকুল। আপাতত ভাবছি, রাজপথ থেকে জনপথে গিয়ে শিবপুরের ছোট চায়ের দোকানের সনৎদার কাছ থেকে ডিজিটাল আর ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া নেব। এক্সক্লুসিভ!