shono
Advertisement

সাচ্চা মরদ কা বাচ্চা!

বোল্টের মন্তব্য আজ যাঁদের চূড়ান্ত ‘সেক্সিস্ট’ মনে হচ্ছে, তাঁরা ভেবে দেখুন তো সংবাদমাধ্যমে মৃদুভাবে আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বেপরোয়াভাবে খেলোয়াড়দের ‘পৌরুষদৃপ্ত ইমেজ’ নির্মাণের এই প্রক্রিয়া কতদিন ধরে চলছে? The post সাচ্চা মরদ কা বাচ্চা! appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 07:52 PM Aug 26, 2016Updated: 02:23 PM Aug 26, 2016

খেলার মাঠের বিজয়ী বীরদের সাফল্যের শেষে সবসময়ই অপেক্ষা করে থাকে ট্রফি, প্রচুর আর্থিক পুরস্কার এবং অবশ্যই নারী-সান্নিধ্য!  বিজ্ঞাপনে সেলিব্রিটি পুং-খেলোয়াড় ঠিক ব্র্যান্ডটি বেছে নিলেই ‘ফাউ’ পান মডেল সুন্দরীদের উষ্ণ সাহচর্য৷ বোল্টের মন্তব্য আজ যাঁদের চূড়ান্ত ‘সেক্সিস্ট’ মনে হচ্ছে, তাঁরা ভেবে দেখুন তো সংবাদমাধ্যমে মৃদুভাবে আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বেপরোয়াভাবে খেলোয়াড়দের ‘পৌরুষদৃপ্ত ইমেজ’ নির্মাণের এই প্রক্রিয়া কতদিন ধরে চলছে? শান্তনু চক্রবর্তী

Advertisement

পেঁচো-পাতি পাবলিককে নিয়ে এই এক লাফড়া! সেলেব জীবনের যাবতীয় কেচ্ছা এরা ভেলপুরি-ফুচকা-আলুকাবলি-পাপড়ি চাটের মতো গপগপিয়ে গিলবেও–আবার ‘কী ঝাল, কী ঝাল’ বলে উঃ-আঃ-হুশ-হাশও করবে! আরে সেলিব্রিটির লাইফ-কেতা, তাঁর বাত্তেলাবাজি গরগরে, রগরগে, ঝাল-ঝাল হবে না তো কি আপনাদের মতো ভ্যাদভেদে ফ্যাটফেটে-ফ্যাকাশে, পানসে হবে? যে-লোকটা ওলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিণ্ট ইভেণ্টের ফাইনালে দৌড়তে দৌড়তে পাশ ফিরে, ক্যামেরার দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকাতে-তাকাতেই ফিনিশিং লাইনটা সোঁ করে পেরিয়ে যান, তাঁর সম্পর্কে আপনি কী আশা করেন? তিনি কি ‘স্টেডি’ গার্লফ্রেন্ড ছাড়াও অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে রাত কাটিয়ে ধরা পড়ে, আপনার-আমার মতোই মাথা চুলকোবেন, মেঝেয় বুড়ো আঙুল ঘষবেন, আর ‘না মানে আমি তো ঠিক মানে যা ভাবছেন এটা ঠিক তা নয়’ জাতীয় আমতা-আমতা করবেন? উসেইন বোল্ট তাই ঠিক সেটাই বলেছেন, যেটা তিনিই বলতে পারেন৷ তিনি বলেছেন, ‘সেলিব্রিটি হিসেবে শুধু একজন মাত্র মহিলার সঙ্গে থাকাটা খুবই কঠিন…৷’ তিনি তো বলতেই পারতেন–আমার মতো ওলিম্পিকে ‘তিন-তিন ট্রিপল’ করা সেলিব্রিটির শুধু একটাই গার্লফ্রেন্ড–পোষায় না কি? ঔত্যের যে ‘ব্র্যান্ড’ তিনি এতদিনে বানিয়ে ফেলেছেন, এরকম যে কোনও স্টেটমেণ্ট-ই তার সঙ্গে খাপে খাপ৷ কিন্তু তিনি বলেননি৷ আবার মিডিয়া তিলকে তাল করেছে–গোছের ভীতু-ভীতু, বোকা-বোকা, পাশও কাটাননি৷ বরং বেশ বিনম্রতার সঙ্গে সেলেব স্টেটাস-এর ‘অসহায়তা’ ও বাধ্যবাধকতার কথা পেশ করেছেন৷ সত্যিই তো মেয়েরা তাঁদের উপর ‘ঝাঁপিয়ে পড়লে’ তাঁরা কী করবেন? কাউকে ‘না’ বলাটা কী কঠিন কাজ, বুঝতেই তো পারছেন! যে-মেয়েকেই ফেরাবেন, তারই তো রাগ হবে, অভিমান হবে! ঠোঁট ফুলিয়ে-ফুঁপিয়ে চোখের জলে কাজল-মাসকারা লেপে-ধেবড়ে একসা করবে! সেলিব্রিটি-হৃদয় কি তা সইতে পারে! তাছাড়া ‘শিভালরি’ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে৷ নারীর প্রত্যাশা ফেরানো মানে তো তাকে অসম্মান করাই! কোনও সমর্থ পুরুষ সেটা করতে পারে? তাছাড়া যে-সে পুরুষ তো নয়, উসেইন বোল্টের মতো পৃথিবীর দ্রূততম পুরুষ! মিডিয়ারও, দেখুন, ব্যাপারটায় কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে৷ জেডি ডুয়ার্টে নামে যে রিও সুন্দরীর সঙ্গে বোল্টের ঘনিষ্ঠ ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে, বোল্ট তাঁকে কীভাবে কতটা ‘বোল্ড’ আদর করেছেন, তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি৷ এবং আদৌ ঘামাতও না, যদি না, মেয়েটি ব্রাজিলের এক কুখ্যাত ড্রাগ-মাফিয়ার বিধবা স্ত্রী হতেন! মিডিয়া মাথা ঘামাত না বা ঘামায় না, কারণ, মাইক টাইসন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো বা উসেইন বোল্টদের তারা বক্সিং রিং, ফুটবল স্টেডিয়াম বা অ্যাথলেটিক্স ট্র্যাকের বাইরে এভাবেই দেখতে অভ্যস্ত–দুঃসাহসী, মাচো, রঙ্গিলা অ্যাডভেঞ্চারাস!

তফাতের মধ্যে এই, ইউরো কাপের আগে স্বল্পবসনা একাধিক সুন্দরীর সঙ্গে তাঁর নৌকাবিলাস নিয়ে সি আর সেভেন যেখানে মিডিয়ার সামনে একলাইনও মুখ খুলবেন না, চিরপ্রগলভ বোল্ট সেখানে হড়বড়িয়ে বড়-বড় হরফের হেডলাইন-উপযোগী গরমাগরম ‘কোট’ দিয়ে যাবেন! বিয়ে হব-হব করছে, এমন একটা সম্পর্কের পাশে, নিভৃত হোটেলে অন্য মেয়েকে হামি (এবং আরও কিছু) খাওয়ার ওজর হিসেবে জামাইকার মুক্ত-উদার, ‘পারমিসিভ’ জীবন-সংস্কৃতির দোহাই দেবেন! এক্ষেত্রেও ধরেই নেওয়া যায়, বোল্ট তাঁর স্বভাবগত ঔদ্ধত্যেই ‘রাজনৈতিকভাবে সঠিক’ থাকার কোনও চেষ্টাই করেননি–এবং মুখ ফসকে বা না-ফসকে যা বলেছেন, তাতে পুরুষবাদী যৌন আধিপত্যের গন্ধ ম-ম করছে৷ কিন্তু বোল্টের মন্তব্য যাঁদের চূড়ান্ত ‘সেক্সিস্ট’ মনে হচ্ছে, তাঁরা একটু ভেবেচিন্তে বলুন তো, আমাদের ছাপা-অক্ষরের সংবাদমাধ্যমে একটু লাজুক, মৃদু-মৃদুভাবে আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমে আরও খুল্লামখুল্লা বেপরোয়াভাবে, খেলোয়াড়দের পৌরুষদৃপ্ত ‘ইমেজ’ নির্মাণের একটা প্রক্রিয়া বহুদিন ধরেই চলে আসছে কি না! দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে এবং খেলার ইভেণ্টটার ধরন অনুযায়ী, এই নির্মাণের রকম-সকমটা হয়তো পাল্টে-পাল্টে যায়–কিন্তু ফর্মুলাটা একই থাকে৷

মার্কিন টেলিভিশনের বিভিন্ন্ ক্রীড়া চ্যানেলের সম্প্রচারে ‘রিয়েল ম্যান’ বা সাচ্চা মরদ-বাচ্চার একটা ছবি খাড়া করাই আছে৷ সেই ইভেণ্টটা বাস্কেটবল, আমেরিকান ফুটবল, পেশাদার বক্সিং, কার-রেসিং বা কুস্তির বিশ্ব সিরিজ, যাই হোক না কেন, তাতে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়রা সবসময়ই হবেন শৌর্য-বীর্যময় এক আগ্রাসী বীরপুরুষ, যিনি প্রতি মুহূর্তে জেতার আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর টগবগ করছেন৷ এবং খেলার মাঠের বিজয়ী বীরদের সাফল্যের শেষে সবসময়ই অপেক্ষা করে থাকে ট্রফি, প্রচুর আর্থিক পুরস্কার এবং অবশ্যই সুন্দরী মেয়েদের সান্নিধ্য! ট্র্যাকে-কোর্টে-রিংয়ে-মাঠে নেমে যাঁরা খেলছেন বা গ্যালারিতে বসে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় যাঁরা সেটা দেখছেন, দু’তরফেই এটাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নেওয়া হয়৷ এমনকী, টেলিভিশন খেলার অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাঝখানে ব্রেক-এ যেসব বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তার আখ্যানগুলোও মোটামুটি এইরকমই৷ সেখানে সেলিব্রিটি খেলোয়াড়রা সঠিক পণ্য-ব্র্যান্ডটি বেছে নেওয়ার সঙ্গেই ‘ফাউ’ হিসেবে পেয়ে যাচ্ছেন মডেল সুন্দরীদের উষ্ণ সাহচর্য৷ একটা গবেষণাপত্রের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন মুলুকে ২৩ ঘণ্টার ক্রীড়া সম্প্রচারে অন্তত ৫৮ বার মেয়েদের ‘যৌন-পণ্য’ বা সফল ক্রীড়াবিদদের অনিবার্য প্রাপ্য ‘যৌন-ট্রফি’ হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে৷ আর একটা হিসেবে সেটা ঘণ্টা পিছু দু’বার এবং সেটা সবসময় যে শুধু বিজ্ঞাপনী কমার্শিয়ালেই দেখানো হচ্ছে, তা নয়৷ সরাসরি ক্রীড়া সম্প্রচারের মধ্যেই ওরকম মুহূর্ত বারবারই আসে, যেখানে মনে হবে, মাঠের সাফল্যের জন্য অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যে, ক্রীড়াবিদদের অধিকার!

আমাদের দেশে শরীর-যৌনতা নিয়ে ঢাকঢাক-গুড়গুড় অনেক বেশি আর ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনও খেলার ব্র্যান্ড ভ্যালুও নেই৷ তাই ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় ইয়ান বোথাম বা শেন ওয়ার্ন-এর গোপন রতিক্রীড়ার উগ্র ‘মাচোয়ানা’য় হোটেলের খাট ভেঙে পড়ার মতো ‘দুষ্টু’ খবর আমাদের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে সেভাবে শোনা যায় না৷ কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের বিরাট পুরুষ হিসাবে বিরাট কোহলির ইমেজ নির্মাণে মাঠ ও মাঠের বাইরে তাঁর পুরুষালি মেজাজ, উগ্র-আগ্রাসী আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষার প্রচারটা নীরব যত্নেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ টেস্ট বা একদিনের সিরিজে ভারতের ‘ব়্যাঙ্কিং’ উপরের দিকে রাখতে গেলে এইরকম পুরুষকার ছাড়া চলবে না, সেটাও মোটামুটি প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হয়৷ এবং বিভিন্ন্ বিজ্ঞাপনী ছবিতেও বিরাট বা তাঁর মতোই ভারতীয় ক্রিকেটের নবযৌবনের যে ব্র্যান্ডদূতদের দেখা যায়, তাঁদের চারপাশেও কিন্তু কারণে-অকারণে দুর্ধর্ষ শরীরের, দুরন্ত আবেদনময়ী সুন্দরীদের লেপ্টে-চেপ্টে থাকতেই দেখা যায়৷ ইঙ্গিতটা কিন্তু সেই অর্ধেক রাজস্ব আর রাজকন্যারই! সফল ক্রীড়া-পুরুষের যেটা অবশ্যই প্রাপ্য৷ আর আমেরিকান ফুটবল ও বেসবলের ময়দান থেকে আমদানি করা ‘চিয়ারগার্ল’রা তো আইপিএল ক্রিকেটে মাচো-পৌরুষের ঠোকাঠুকি, যৌনতা ও বিনোদনকে একাকার করে দেয়৷

এতক্ষণে নিশ্চয়ই এটুকু পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, উসেইন বোল্টের ওই যৌনগন্ধী মন্তব্যের উৎস খুঁজতে আমাদের হ্যারি বেলাফণ্টের জামাইকান লাভবার্ডদের পিছনে দৌড়নোর কোনও দরকার নেই৷ আমাদের গ্লোবাল ক্রীড়া-সংস্কৃতিই যে কোনও ‘বিজয়ী’ ক্রীড়াবিদকে ওই ছাড়পত্রটা এমনিতেই দিয়ে রেখেছে৷ বীরভোগ্যা ক্রীড়া-বসুন্ধরায় নারী চিরকালই ‘পণ্য’ এবং ‘ভোগ্য’৷ এবং সেই অ্যাথলিট যদি বোল্টের মতো কোনও সুপার প্রতিভাবান হন, তো তিনি ধরাকে সরা-ই দেখবেন৷ আর সেজন্য লজ্জিত বা কুণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণও খুঁজে পাবেন না! আমাদের মতো রোগা-ভোগা, আসলি পৌরুষের জোশ, পেশী ও দাপটহীন ভীতু-গোবেচারারাই নিরাপদ দূরত্ব থেকে শুধু নৈতিকতার ভুরু কোঁচকাবে!

The post সাচ্চা মরদ কা বাচ্চা! appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement