‘ডিপফেক’ আসলে ‘ডিপ লার্নিং’ প্রক্রিয়ার পরিণতি। যে ‘ডিপ লার্নিং’ ব্যবহার করে বিমানচালনায় ‘অটো পাইলট’ এসেছে, তা ব্যবহার করেই ‘আর্মাড ট্যাঙ্ক’ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালনা করা যায়। কাল্পনিক ভিডিও দেখিয়ে শত্রুপক্ষকে বিপথে চালনা করাও সম্ভব। কলমে কিংশুক বন্দ্যোপাধ্যায়
তুমুল যুদ্ধ বেধেছে। শত্রুপক্ষ আক্রমণ করেছে। তাদের সাঁজোয়া বাহিনী এগিয়ে আসছে রাজধানীর দিকে। যুদ্ধবিধস্ত অঞ্চল থেকে আতঙ্কিত মানুষরা পালাচ্ছে। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের আর্ত চিৎকার। কিন্তু আক্রান্ত দেশের সেনারা মোটেই পিছু হঠেনি। প্রাথমিক আক্রমণের ধাক্কা সামলে তারা প্রতি-আক্রমণে নেমেছে। জঙ্গি বিমান আকাশে উড়েছে শত্রুনিধনের জন্য। সব মিলিয়ে চারিদিকে যুদ্ধের চরম উত্তেজনাকর পরিবেশ।
এটা কিন্তু কোনও সত্যিকারের যুদ্ধের ধারাবিবরণী নয়। হলিউডের পরিচালক ব্যারি লেভিনসনের ১৯৯৭ সালের সিনেমা ‘ওয়াগ দ্য ডগ’-এর গল্প এটি, যেখানে চূড়ান্ত কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়া এক মার্কিন প্রেসিডেন্টের গদি বাঁচাতে হলিউডের এক পরিচালককে ডাকা হয়েছে, যিনি সেট বানিয়ে কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সাহায্যে একটি ‘নকল যুদ্ধ’ তৈরি করলেন। টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হলে যাতে আমজনতার নজর ওদিকে ঘোরানো যায়।
এখন হালফিলের দু-দুটো যুদ্ধকে (রাশিয়া ও ইউক্রেন, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন) ছাপিয়ে সোশাল মিডিয়ায় একটি কল্প-মাধ্যমের উড়ান দেখে বছর ২৬ আগের রবার্ট ডি নিরো, ডাস্টিন হফম্যান, অ্যান হেচের তারকাখচিত ওই কল্পযুদ্ধ-সমৃদ্ধ সিনেমার কথা মনে এসে গেল। তফাত এই যে, এখন তো আর কোনও উপলক্ষ বা বিশেষ উদ্দেশ্য লাগছে না কল্পকাহিনির ভিডিও, অডিও বা সিনেমা তৈরি করতে। নিছক ফোটোশপ বা কম্পিউার গ্রাফিক্সের মধ্যেও আর সীমাবদ্ধ নেই বিষয়টা। এখন যুদ্ধের কল্পচিত্র আরও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনা করা যাবে যাতে সত্যিই শত্রুপক্ষ হতচকিত হয়ে পড়ে। কল্পনার মায়াজাল বুনে এমন ভিডিও বানানো হতে পারে যা আদতে হয়ইনি, কিন্তু সেটা বুঝতে ঝানু সমর-বিশেষজ্ঞরাও ঘোল খেয়ে যাবেন। তখন আর এটা নিছক প্রচার না-থেকে রীতিমতো যুদ্ধের কৌশলে পর্যবসিত হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা ‘এআই’-এর হাত ধরে এসব নিখুঁত কাল্পনিক ছবি, অডিও, ভিডিও করার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিপফেক’। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিছক বিনোদন তো বটেই, ‘ডিপফেক’ প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও বিপ্লব নিয়ে আসতে চলেছে।
কী এই ‘ডিপফেক’?
‘ডিপফেক’ এই নামটা আদতে এসেছে ‘ডিপ লার্নিং’ আর ‘ফেক’ শব্দ দুটোকে জুড়ে। ‘এআই’ বিশেষজ্ঞ নীনা স্কিক তাঁর ‘ডিপফেক অ্যান্ড দ্য ইনফোক্যালিপ্স’ বইয়ে ডিপফেকের জন্মবৃত্তান্ত প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, গত শতকের পাঁচের দশকে যন্ত্রকেও যাতে বুদ্ধিমান করা যায়, যাতে পরিস্থিতি অনুসারে মানুষের মতো সে-ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে– এরই খোঁজে নেমে পড়েন বিজ্ঞানীরা। শুরু হয় ‘এআই’ নিয়ে গবেষণা। আটের দশকে এসে ‘এআই’ গবেষণা দুটো স্বতন্ত্র খাতে বইতে শুরু করে। একদল বিজ্ঞানী নির্দিষ্ট ‘প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ’ অনুসারে কম্পিউটারকে কাজ করানোর দিকে মন দেন। অর্থাৎ যা নির্দেশ দেওয়া হবে, ‘এআই’ সেই ধরাবাঁধা রাস্তায় চলবে। কিন্তু আর-একদল বিজ্ঞানী এই ধরাবাঁধা ‘এআই’-এর পথে যেতে চাইলেন না। চাইলেন, মানুষের মতোই অভিজ্ঞতা বা ‘লার্নিং’ সঞ্চয় করে ‘এআই’ এগিয়ে যাক। ২০০০ সাল নাগাদ বিজ্ঞানীরা দেখেন, এই ‘মেশিন লার্নিং’-এর পথে এআই গবেষণাকে প্রকৃতই সমৃদ্ধ করা সম্ভব। দেখা গেল, যদি মানুষের মস্তিষ্কের আদলে কৃত্রিম নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা যায়, আর সেই নেটওয়ার্কে যথেষ্ট তথ্য দেওয়া যায়, তবে যন্ত্রও তখন তার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। একে ‘ডিপ লার্নিং’ আখ্যা দেওয়া হল।
একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আরও দ্রুত গতিতে ‘এআই’ গবেষণা এগল। দেখা গেল, সংশ্লিষ্ট সব তথ্য যদি যন্ত্রকে দেওয়া যায়, তবে ‘ডিপ লার্নিং’-এর সাহায্যে সে প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজে নিয়ে ঠিক কাজটা করতে পারছে। ‘ফেস রেকগনিশন’ বা মুখ দেখে পরিচয় বের করা হল– এর প্রথম সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির মুখের ছবি আর পরিচয় সমেত তথ্য তার তথ্যভাণ্ডারে থাকলে শত-শত মানুষের ভিড়েও ‘ফেস রেকগনিশন’ পদ্ধতির সাহায্যে যন্ত্র ঠিক লোককে খুঁজে বের করতে পারবে। প্রথমে এর জন্য নির্দেশ দিতে হলেও পরে ‘ডিপ লার্নিং’-এর প্রভাবে ক্রমে যন্ত্র কোনও নির্দেশ ছাড়াই নিজে থেকেই এই মুখ দেখে পরিচয় বের করায় সমর্থও হল। দুনিয়ায় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজে এই পদ্ধতি ভীষণ কাজে এল।
‘ডিপ লার্নিং’-এর অশ্বমেধের ঘোড়া এবার ছুটেই চলল। দেখা গেল, ‘ডিপ লার্নিং’-এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যান চালানো সম্ভব। রাস্তার যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য, ট্রাফিক সিগনালের জায়গা, জেব্রা ক্রসিং প্রভৃতি তথ্য গাড়ির কম্পিউটারকে দিলে ‘ডিপ লার্নিং’-এর সাহায্যে সে নিজেই চালাতে সক্ষম। একইভাবে বিমানচালনার ক্ষেত্রে ‘অটো পাইলট’ পদ্ধতি এল। বহু ক্ষেত্রেই তা ‘কো পাইলট’-এর সমগোত্রীয় কাজও করল। দেখা গেল, ‘ডিপ লার্নিং’ যে শুধু কাল্পনিক ছবি বা ভিডিও করতে পারে তা-ই নয়, স্বয়ংক্রিয় যানও চালাতে পারে।
[আরও পড়ুন: বিশ্বকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে অনুন্নত বিশ্বের কণ্ঠস্বর ভারত]
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘ডিপ লার্নিং’-এর এই স্বয়ংক্রিয়ভাবে যান চালানোর সক্ষমতা সামরিক ক্ষেত্রে এক বিপুল সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিয়েছে। যেমন– যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও শত্রুপক্ষের বিষয়ে বিশদ তথ্য সার্ভারে থাকলে ড্রোন ঠিকই তার নির্দিষ্ট কাজ করতে পারবে। যে কোনও ‘আর্মর্ড কার’ বা ট্যাঙ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালনা করা সম্ভব। ফলে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ট্যাঙ্ক ডিভিশনও গঠন করা সম্ভব। একইভাবে স্বয়ংক্রিয় রোবট সেনা দল গঠন করাও সম্ভব। পেন্টাগন এই ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়েছে বলে খবর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ডিপফেক’-কে সমরকৌশল হিসাবেও ব্যবহার করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ‘ডিপফেক’ যেহেতু বিশ্বাসযোগ্য কাল্পনিক ছবি বা ভিডিও তৈরি করতে সক্ষম, তাই শত্রুপক্ষকে বিপথে চালিত করার জন্য তা ব্যবহার করা হতেই পারে। কোনও কাল্পনিক যুদ্ধও দেখানো যেতে পারে। দেখানো যেতে পারে কোনও কাল্পনিক সেনা চলাচল, যা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়া যায়। অর্থাৎ কল্পবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘বিকল্প ব্রহ্মাণ্ড’ গঠন করা সম্ভব।
বর্তমানে সোশাল মিডিয়ায় ‘ফেক নিউজ’ নিয়ে যখন সবাই উদ্বিগ্ন, কীভাবে এই ভাইরাসের হাত থেকে সংবাদ জগৎকে বাঁচানো যায়, তা নিয়ে যখন বিস্তর মাথা ঘামানো চলছে, তখনই ধূমকেতুর মতো জনমানসে আবির্ভাব ঘটেছে ‘ডিপফেক’-এর। দক্ষিণী সুপারস্টার রশ্মিকা মান্দানা আর বলিউড সুপারস্টার ক্যাটরিনা কাইফ-সহ আরও অনেকের ভিডিও ‘ডিপফেক’ করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন আশঙ্কা।
‘ডিপফেক’-নির্মাতার উদ্দেশ্য যদি হয় জনমানসের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তাহলে বলতেই হবে ভারতের সংবাদমাধ্যমের দুনিয়ায় তার ‘ধুঁয়াধার এন্ট্রি’ হয়েছে। ঠিক যেভাবে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নকল ভিডিও বানিয়ে ‘ডিপফেক’ পশ্চিমি দুনিয়ার নজর কেড়েছিল। এলভিস প্রিস্লে বা নিহত জন লেননকে ‘ডিপফেক’ ভিডিওয় জীবন্ত দেখিয়েও তাক লাগিয়েছিল সবার।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ডিপফেক’-কে নিছক বিনোদন হিসাবে ভাবলে ঠিক আছে। ফোটোশপ করে একজনের মুণ্ড আর-একজনের ধড়ে বসানো বা কোনও ছবিতে ফোটোশপ করার মতো ঘটনা এখন আকছার ঘটে এবং এরকম ঘটনা নজরে এলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। তবে সিনেমার মতো মিডিয়াতেও কাল্পনিক অডিও, ভিডিও বা ছবি চলে এলে আশঙ্কা অন্য জায়গায়। পর্নোগ্রাফি, ব্ল্যাকমেল, শাসানো, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মতো অপরাধমূলক কাজেও ‘ডিপফেক’-কে ব্যবহার করা হতে পারে। তাছাড়া, ডিপফেক ‘ভুয়া খবর’ ছড়িয়ে মিডিয়া ও জনমানসে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। মনস্তত্ত্ববিদদের একাংশ ‘ডিপফেক’-কে মানসিক অবসাদের সম্ভাব্য কারণ হিসাবেও দেখছেন।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, ‘ডিপ লার্নিং’ এমন পর্যায় যেন না আসে, যেখানে সার্ভারে রাখা তথ্যের বাইরে গিয়েও যন্ত্র ‘নিজের মতো ভাবতে পারে’। কথাটা কল্পবিজ্ঞানের মতো শোনালেও বিজ্ঞানীরা কিন্তু এর মধ্যেই চিন্তিত। মানব সভ্যতা এখন যন্ত্র-নির্ভর। তাই ‘এআই’ স্বাধীন হলে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। যাবতীয় মারণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ যেহেতু যন্ত্রের সাহায্যে করা হয়, কাজেই সেগুলির নিয়ন্ত্রণ এআইয়ের হাতে গেলে বিশ্বব্যাপী সভ্যতার সর্বস্তরে প্রলয় আসতে পারে। সত্যি-মিথ্যের মধ্যে ব্যবধানকে ধূসর করে দেওয়ার মতো হাতিয়ার– যেমন, ‘ডিপফেক’– এআইয়ের কবজায় চলে এলে চিন্তা হয় বইকি।
ফলে আপাততত সব পক্ষই কম-বেশি ‘ডিপফেক’-কে নিয়ন্ত্রণের জন্য নড়েচড়ে বসেছে। যেমন, গুগ্লের তরফে জানানো হচ্ছে– যঁারা ‘ডিপফেক’ দিয়ে কিছু বানাচ্ছেন তাঁদের বিশেষ সতর্কতা নেওয়ার কথা বলা হবে। যাতে তাঁদের তৈরি ‘কনটেন্ট’ অপরাধমূলক কাজে না ব্যবহার করা যায়, তা-ও দেখতে হবে। প্রয়োজনে এ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেবে গুগ্ল। সংস্থা জানিয়েছে, ভিডিও বা অডিওর বিষয়বস্তু বাস্তবতার বাইরে গেলেই জানাতে হবে তাদের। অডিও বা ভিডিওতে ‘ডিপফেক’ ব্যবহার করা হলে তা-ও সেখানে স্পষ্ট করে জানাতে হবে। ‘ডিপফেক’ যাতে লাগামছাড়া না হয়ে যায় তার জন্য কেন্দ্রও আইন আনছে। এ নিয়ে গুগ্ল আর মেটা-সহ তথ্যপ্রযুক্তি জগতের তাবড় মাথাদের সঙ্গে কেন্দ্রের বৈঠকও হয়েছে। তবে যন্ত্রের উপর মানুষের কর্তৃত্ব থাকবে, না, যন্ত্রের হাতে মানুষ হবে পুতুল মাত্র, তার উত্তর এককথায় এখনই দেওয়া সম্ভব নয়।
পুনশ্চ ২০২৩ সালে ‘ওয়াগ দ্য ডগ’ ছবিটা ফের বানালে ব্যারি-র ‘নকল যুদ্ধ’ বানানোর জন্য আর হলিউডের পরিচালককে সিনেমার চরিত্রে অভিনয় করতে হত না। ওই কাজ ‘ডিপফেক’-ই করে দিত অনায়াসে।