সরোজ দরবার: ইলেক্ট্রিক বিল জমা দিতে হবে। দেখা করতে হবে সুকুমার বাবুর সঙ্গে। ঠিক তার পাশেই লেখা রবি ঠাকুরের এক অমোঘ পংক্তি। পরের পাতাতে আবার নিজেই লিখে ফেলেছেন একটি কবিতা। পাশে স্কেচ। কে এই বহুমুখী প্রতিভা? বাঙালি জানে, বর্তমান সময়ে এই বৈচিত্র, এই বহুমুখিনতা যদি কারও থাকে, তবে তিনি এক ও অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
[ কিংবদন্তির কীর্তি, ‘ময়ূরাক্ষী’ ছবিতে গান গাইলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ]
তিনি বাঙালির আন্তর্জাতিক অহঙ্কার৷ সচেতনভাবে সমসমায়িক৷ সময়ের ধুলো যেন তাঁর আভিজাত্যের সৌন্দর্য স্পর্শ করে না৷ এ চেনা পৃথিবী থেকে তিনি দূরে থাকেন না৷ এই তো তিনি অভিনয় করছেন, কবিতা লিখছেন-পড়ছেন৷ থিয়েটারি আলো-আঁধারিতে এই তো মাত্র কয়েক হাত দূরে তাঁর অবস্থান৷ তবু তাঁকে ঘিরে থাকে এক আশ্চর্য আলোকবৃত্ত৷ মন আর মননের সেই অনুশীলিত আলোর জোরেই অতি চেনা পৃথিবীর ক্লিশে তাঁকে গ্রাস করে না৷ এ এক যেন আশ্চর্য নাগরিক উপন্যাস৷ যার পরতে পরতে মিশে আছে শহরের ঘাম-ধুলো৷ আর সেই চেনা পৃথিবীর পথ ভাঙতে ভাঙতেই তা পৌঁছে যাচ্ছে মেধার সেই আকাশে, যেখান থেকে তাঁকে মনে হয় দূরতম কোনও নক্ষত্র৷ যে নক্ষত্রদ্যুতি কয়েক দশক ধরে আমাদের অভিভূত করে রেখেছে৷
তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়৷ বয়স তো সংখ্যামাত্র৷ চুরাশিতে পা দিয়েও আজও তিনি যুবকের প্রেরণায় কাজ করে চলেছেন অনায়াসে৷
এই সেই ব্যক্তিগত খাতা
বস্তুত বাঙালির জীবনের ছোট গল্পের পরিসর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে যেন মাঝে মধ্যেই ধরে উঠতে পারে না৷ এমন বহুমুখী বাঙালির দেখা মেলা ভার৷ প্রথমত তিনি অভিনেতা৷ তারপর হয়তো তিনি কবি, নাট্য ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু আসলে তিনি বাঙালির অভিজাত সংস্কৃতির সার্থক ধারক৷ আসলে তিনি বাঙালির শিক্ষিত চেতনার জাগপ্রদীপ৷ বহু বৈচিত্রেও তাই অদ্ভুত নির্লিপ্তি যেন তাঁর সহজাত৷ পর্দা ও পর্দার বাইরে মিলেমিশে যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির মননে জায়গা করে নিয়েছেন তাঁকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা বৃথা৷ বরং বহু স্তরভেদে তাঁকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়ে টের পাওয়া যায় বাঙালির সংস্কৃতির ঐশ্বর্য৷ কোন জাগরূক অবস্থা আমাদের প্রার্থিত ছিল, আর কোথায় আমাদের পৌঁছানোর ছিল সেই রেখাচিত্র যেন তিনি তাঁর জীবনব্যপী কাজকর্মে তুলে ধরেন৷ দাদাসাহেব ফালকে সেখানে একটি মাইলস্টোন মাত্র, আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মঙ্গলকাব্যের এক চরিত্র, যিনি বাঙালিকে ভবিষ্যতেও চিনিয়ে দেবেন তার স্মৃতি ও সত্তা৷
চিত্রনাট্য
এ যেন তাঁর কর্তব্যই ছিল৷ নির্লিপ্ত হয়েই তিনি এই গুরুকাজ অবলীলায় করে চলেছেন৷ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় তাই যথার্থই বলেন, “সকলে নন, কেউ কেউ পারেন অভিনেতা হতে৷ তাদের স্বাক্ষর নির্জন৷ তেমন নির্জনতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আছে৷ কোনও তুলনা ও প্রতি তুলনা তাঁর নির্বাক কিংবা মুখর মুখের সৌন্দর্যে ছায়া ফেলতে পারবে না৷” এ তাঁর সযত্নে রচিত প্রাসাদ৷ সঞ্জয়বাবু যেমন বলেন, “বলতে চাইছি নিজের মুদ্রাদোষে একা ও আলাদা হয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব ও সাহস তাঁর আছে৷ শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের কাছে নিশ্চিতভাবে ঋণী কিন্তু সত্যজিৎ-সর্বস্ব নয়৷” দশকের পর দশক পেরিয়ে বাঙালি হয়তো এতদিনে ক্রমশ চিনে নিতে পারছে সংস্কৃতির এই অভিজাত ধারকমুদ্রাটিকে৷
পুরনো সেই পোস্টার
আর এই পথে হাঁটতে হাঁটতে তাঁকেও হয়ে উঠতে হয়েছে নীলকণ্ঠ৷ বলেন তাই, “আমার সম্ভাবনা, আমার অভিনয় করার ক্ষমতা, আমার শ্রম- আমি বিক্রি করি-এই আমার পেশা৷ কিন্তু এই শ্রম বেশিরভাগ বাঙালির সংগ্রাম সংগঠনে কোনও কাজেই আসে না৷ কারণ আমার শ্রম ও সৃষ্টিশীলতা যারা কেনে তারা আমার বাসনা, আমার মানসিকতা, আমার আদর্শকে কেনে না৷ তারা আমার থেকে আমার অভিনয় করার ক্ষমতাটুকু নিষ্কাশিত করে নেয়৷ এবং তা দিয়ে ব্যবসা করে৷ অতএব এক সুদীর্ঘ বিছিন্নতার জন্ম হয় আমার ব্যক্তিত্ব ও আমার স্বাভাবিক বৃত্তিগুলির মধ্যে৷ আমার ভাবনা ও আমার কাজের মধ্যে দূরত্ব দুস্তর হয়৷” এই দ্বন্দমুখরতা তাঁকে রক্তাক্ত করে৷ তবু প্রকৃত শিল্পীই পারেন সেই রক্তকে রক্তগোলাপ করে ফুটিয়ে তুলতে পারে৷ আপামর জনগণ তাতে মুগ্ধ হয়৷ তবু সময় সময় আসে যখন এ আমি’র আবরণ সরিয়ে চিনে নিতে হয় মানুষটিকে৷ আমরা দেখতে পাই এই নাগরিক বৃত্তের মধ্যেই তিনি জেগে আছেন এক শাপভ্রষ্ট দেবদূত হয়েই৷ অথবা ময়ূরাক্ষীর সেই স্নেহপরবশ বাবাটি। যিনি ছেলের জন্য জানলাটি এঁকে রেখে যান। মনখারাপ হলে যেখানে বসতে পারে আর্যনীলরা। আসলে সে জাবলা তো ভাবীকালের জন্যই।
জন্মদিনে প্রণাম কিংবদন্তিকে৷
সংবাদ প্রতিদিন ও দেজ পাবলিকেশন নিবেদিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রদর্শনী থেকে ছবিগুলি সংগৃহীত৷
দেখুন ভিডিও:
The post হিসেবের পাশেই রবি ঠাকুরের পংক্তি, দেখেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের খেরোর খাতা? appeared first on Sangbad Pratidin.