শুধু বর্তমান যুগে নয় একসময় ট্যাটু বিভিন্ন আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। শরীরের বিশেষ অংশকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ফ্যাশন জগতে ট্যাটু এখন বহুল প্রচলিত। লিখছেন অন্তরা ঘোষ।
ফ্যাশন জগতে ট্যাটু বা উল্কি শব্দটি বহুল প্রচলিত। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী হোক বা ক্রিকেটার অনেককেই শরীরের বিভিন্ন স্থানে ট্যাটু করাতে দেখা যায় স্টাইলের অঙ্গ হিসেবে। আবার কম বয়সী অনেক যুবক-যুবতীদের অনেককে দেখা যায় হাতের ট্যাটু করে প্রেমিক বা প্রেমিকার নাম চিরস্থায়ীভাবে লিখে রাখতে প্রেমের নিদর্শন হিসেবে। আবার অনেকে শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ট্যাটুর ব্যবহার করেন।
আইডেনটিটি কার্ড!
আসলে সৃষ্টির শুরু থেকেই নিজেকে সুন্দর দেখানোর মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। নিজেকে সবার থেকে আলাদা ও আকর্ষণীয় করে তুলতে ট্যাটুর প্রচলন কিন্তু বহু আগে থেকেই আছে। ট্যাটুকে অনেকে আইডেন্টিটি কার্ড হিসেবেও ব্যবহার করেন। নানান ধরনের নকশা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চিরস্থায়ীভাবে খোদাই করে নিজের একটা অন্য পরিচয় গড়ে তোলেন। আমাদের দেশে কিন্তু নানা কারণে ট্যাটুর চল শুরু হয়। যেমন সামাজিক পদমর্যাদার চিহ্ন হিসেবে, আবার কখনও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে ,কখনও বা ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে ট্যাটুর ব্যবহার আমরা দেখতে পাই।
[ আরও পড়ুন: মনে পড়ছে আলাদিনের পোশাকের কথা? নয়া ফ্যাশন ট্রেন্ডে মজেছে নেটদুনিয়া ]
উৎসের খোঁজে
আমরা যদি বেশ কিছু বছর পিছিয়ে যাই ট্যাটুর উৎস খুঁজতে তাহলে দেখব ট্যাটু বিশেষত বিভিন্ন আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। অনুপ কুমার দত্তের লেখা “Tattoos- a tribal heritage” বইটা পড়লে জানা যায় যে কিভাবে বিভিন্ন আদিবাসী জাতির মধ্যে ট্যাটুর ব্যবহার ও প্রচলন ছিল।
অপহরণ রুখতে
অরুণাচল প্রদেশের আপাতানি আদিবাসীদের মধ্যে ট্যাটুর প্রচলন ছিল। আপাতানি সুন্দরী যুবতী আদিবাসী মেয়েদের মুখে ট্যাটু বানিয়ে মুখটা কুৎসিত করে দেওয়া হতো যাতে প্রতিবেশী নিশি আদিবাসী পুরুষরা সুন্দরী যুবতীদের অপহরণ করে নিয়ে না যায়। আপাতানি মেয়েরা মুখে ট্যাটু করার সাথে সাথে নাকে বিরাট গোলাকৃতি নোলক বা নথ পড়ত। যদিও সত্তরের দশক থেকে আদিবাসীদের শরীরে ট্যাটু করার প্রথা সরকার থেকে বন্ধ করা হয়েছে কিন্তু আজও আপাতানি মেয়েরা থুতনি ও ঠোঁট বরাবর নাক অব্দি ট্যাটু করে নীল রেখা টানে। অসম ও অরুণাচল প্রদেশের সিংফো আদিবাসীদের মধ্যে বিবাহিত মহিলারা নিজেদের পায়ের গোড়ালি থেকে নিয়ে হাঁটু পর্যন্ত ট্যাটু করত। আর পুরুষরা দুই হাতে ট্যাটু করত। সিংফো অবিবাহিত মেয়েরা শরীরে ট্যাটু করা থেকে বিরত থাকত।
শৌর্যের প্রতীক
যদিও ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যে ট্যাটু প্রথার মধ্যে অনেক পরিবর্তন ও আধুনিকতা এসেছে কিন্তু আজও ট্যাটু করানোর মুখ্য উদ্দেশ্য পরাক্রম শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। আদিবাসীদের মধ্যে উল্কা বা ট্যাটু কখনও কখনও কোনও ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান বা পদমর্যাদাও নির্দেশ করত। আমরা এই ব্যাপারে আদিত্য আর্য ও বিভা যোশীর লেখা “The land of nagas” বইতে উল্লেখ পাই।
হেডহান্টার
নাগা উপজাতিদের মধ্যে যারা হেডহান্টারস ছিল তারা মুখে উল্কি বা ট্যাটু করে নিজেদের হেড হান্টার হিসেবে পরিচয় দিত। এই হেডহান্টারসরা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের মাথা কেটে নিয়ে আসতো ও নিজেদের বাড়ির কঞ্চির দেওয়ালের ঘরে বাঁশের ছুঁচালো ফলাতে মাথা গুলি গেঁথে রাখতো। ট্যাটু বা উল্কি আদিবাসীদের পরিচয়, সামাজিক অবস্থান ও সম্মানের প্রতীক। আদিবাসীদের মধ্যে কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে তার ট্যাটু দেখে শনাক্ত করা যায় যে তার পরিচয় কি, সে কিভাবে মারা গেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে নাকি কোনও দুর্ঘটনায়।
গোদনা
ছত্রিশগড়ের গন্ড উপজাতির মধ্যে ট্যাটুর প্রচলন এখনও আছে। এখানে ট্যাটুকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় গোদনা। শুধুমাত্র ভারতীয় আদিবাসীদের মধ্যে ট্যাটুর প্রচলন ছিল তা কিন্তু নয়, পুরো বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির মধ্যে এই ট্যাটুর প্রচলন দেখা যায়।
বাঁচার জন্য
জাপানের আইনু, ছত্রিশগড়ের গন্দ, উত্তর আফ্রিকার তামাজঘার বারবারস, নিউজিল্যান্ডের মায়োরিস, তাইওয়ানের আতায়াল আদিবাসী উপজাতিরা শরীরে উল্কি বা ট্যাটুর ব্যবহার করত। এক সময় চীনে মহিলারা নিজেদের কুৎসিত দেখানোর জন্য ও তৎকালীন রাজাদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য মুখে বা শরীরে ট্যাটু আঁকতো। কিন্তু বর্তমানে ট্যাটু ফ্যাশন ও শরীরের অলংকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
নানা ভাবনা নানা চিন্তা
প্রথমদিকে চীনাদের ধারণা ছিল ট্যাটু মূলত অপরাধী বা সন্ত্রাসী দল বা ডাকাতদের সঙ্গে সম্পর্কিত। জাপানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পের অঙ্গ হল ট্যাটু। আবার থাইল্যান্ডের মানুষ শুধুমাত্র শরীরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যই ট্যাটু ব্যবহার করেন না, তারা এও বিশ্বাস করেন যে ট্যাটু কোন অশরীরী আত্মা বা শয়তান অথবা খারাপ শক্তির হাত থেকে তাদের রক্ষা করবে। ট্যাটু হলো একটা শক্তির প্রতীক। স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে যে ট্যাটু আঁকা হয় তার নকশায় বেশিরভাগ থাকে ভাইকিং ও সমুদ্র যাত্রার কাহিনি। এতক্ষণ ধরে আমরা আলোচনা করলাম বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীদের মধ্যে ট্যাটুর প্রচলন ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কিন্তু প্রাচীনকালে ট্যাটু কিভাবে করা হত আর এখনই বা কিভাবে করা হয় সেটা না জানলে একটু সম্পর্কিত এই আলোচনাটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
সরঞ্জাম
প্রাচীনকালে ট্যাটু মূলত এনিম্যাল ফ্যাট বা পশুর চর্বি দিয়ে করা হতো। সাধারণত কাঁটাওয়ালা গাছের কাঁটা ব্যবহার করা হতো চামড়াটা কাটার জন্য। ট্যাটুর রং কালো বা নীল হয়। বর্তমানে অনেক আধুনিক প্রক্রিয়ায় ট্যাটু করা হয়। ট্যাটু করতে যা যা লাগে তা হল ট্যাটু নিডলস, ট্যাটু মেশিন, ট্যাটু ইনক, ট্যাটু ডিজাইন পেন, কার্বন পেপার, পেট্রোলিয়াম জেলি ইত্যাদি। সাধারণত দু’ভাবে ট্যাটু করা যায়। প্রথমত: স্টিকার দিয়ে অর্থাৎ সাধারণভাবে স্টিকার লাগানোর মতো করে লাগিয়ে ট্যাটু করা হতো। দ্বিতীয়ত খোদাই করে অর্থাৎ মেশিনের সাহায্যে ছুঁচ ফুটিয়ে। এতে প্রথমে একটু ব্যথা লাগে কিন্তু পরে সেটা সহ্য হয়ে যায়।
প্রশ্ন ওঠে
একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সেটা হল ট্যাটু কি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর? যারা শরীরে ট্যাটু আঁকান তারা কিন্তু অনেকেই এই ব্যাপারে অবহিত নন যে ট্যাটু আঁকতে যে রং ব্যবহার করা হয় তার সাথে মেশানো হয় মারাত্মক একটা রাসায়নিক পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থ ট্যাটু মেশিনের সাহায্যে চামড়ার গভীরে গিয়ে শরীরে প্রবেশ করছে। যেহেতু এই উল্কি সারাজীবন শরীরে থেকে যায় তাই এই রাসায়নিক পদার্থটি ও সারা জীবন শরীরে স্থায়ী হয়ে যায়। এর ফলস্বরূপ নানারকম অসুখ হতে পারে। তাই ট্যাটু করার আগে অবশ্যই ভালোভাবে ভাবনা-চিন্তা করে নেওয়া উচিত। ট্যাটু করানোর সময় কতগুলো বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত ইনজেকশন সিরিঞ্জ যেন ভালোভাবে গরম জলে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় ট্যাটু করার জন্য যে রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে আসা হয়েছে সেটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। তবে শরীরের জন্য ট্যাটু যতটাই ক্ষতিকর হোক না কেন ফ্যাশন জগতে কিন্তু ট্যাটুর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
[ আরও পড়ুন: শ্লীলতাহানির হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারে কানের দুল, কীভাবে জানেন? ]
The post ট্যাটু করতে চান? ইতিহাস জেনে তবেই বাছুন ডিজাইন appeared first on Sangbad Pratidin.