বিশ্বদীপ দে: ফুটবল (Football)! একবার উচ্চারিত হলেই বুকের মধ্যে গমগম করে বেজে ওঠে শব্দব্রহ্ম। হর্ষধ্বনির মধ্যেই ধারাভাষ্যকারের টিপ্পনী, ‘আজ স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ।’ শুক্রবার আইএসএলের (ISL 2020) দামামা বেজে গিয়েছে। মরশুম শুরুর প্রথম দিনেই এমন এক ঝকঝকে গ্যালারির মাঝখানে ঝকঝকে সবুজ মাঠের ছবিই বোধহয় ভিড় করে আসছে সব ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে।
কিন্তু ভাবুন তো, ফুটবল স্টেডিয়াম আছে অথচ মাঠের বুক চিরে পাসের পর পাসের সম্মোহনী দৃশ্যমালা রচিত হচ্ছে না! লাল কার্ড, ফ্রি কিক কিংবা জালের মাঝখানে বল জড়িয়ে যাওয়া মায় গোটা ফুটবল ব্যাপারটাই অদৃশ্য হয়ে গেছে! তার বদলে গমগমে স্টেডিয়ামে হচ্ছে অন্য সব ব্যাপার। ফুটবল সেখান থেকে নিরুদ্দেশ! মনে হচ্ছে না, পুরো ‘হযবরল’? ছিল রুমাল হয়ে গেল একটা বিড়াল! ব্যাপারটা যেন ঠিক তেমনই।
[আরও পড়ুন: আইএসএলের প্রথম ম্যাচের আগে ‘প্রস্তুত’ এটিকে-মোহনবাগান, খানিকটা সংশয়ে কিবুর কেরালা]
ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু দেখা যাবে, ব্যাপারটা মোটেই বিরল কিছু নয়। অনেক সময়ই ফুটবল মাঠে অ-ফুটবলীয় কোনও না কোনও ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। বলতে পারেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা কোনটি? সেটার কথা বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে পাঁচ দশক।
১৯৭০ সাল। লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম (Wembley Stadium)। যে স্টেডিয়াম সম্পর্কে পেলে বলেছিলেন, ‘ওয়েম্বলি হল ফুটবলের হৃদয়।’ সেই মাঠে এফএ কাপের ফাইনালের মতো হাই ভোল্টেজ ম্যাচের ঠিক আগে আয়োজিত হয়েছিল ‘হর্স অফ দ্য ইয়ার শো’! ফুটবল মাঠে ঘোড়ার খুড়ের দাপাদাপিতে দফারফা হয়েছিল খেলার। লিডস ইউনাইটেড ও চেলসির ম্যাচ ২-২ ফলাফলে শেষ হওয়ার পরে রিপ্লে ম্যাচটি বাধ্যত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। ফুটবল মাঠে অন্য কোনও খেলা বা অনুষ্ঠান আয়োজনের কী পরিণাম হতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ সেদিনের সেই ঘটনা।
যদিও তা থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। খোদ ওয়েম্বলিও না। বেসবল থেকে শুরু করে মোটর রেসিং, গ্রেহাউন্ড কুকুরদের দৌড় থেকে বক্সিং কী না হয়েছে এই স্টেডিয়ামে। সে ১৯৭০ সালের আগে হোক বা পরে।
ফুটবল মাঠে মিউজিক কনসার্টও আকছার হয়। ইংল্যান্ডের আরেক ক্লাব কার্ডিফ সিটির ঘরের মাঠ নিনিয়ান পার্কে সাতের দশকে পারফর্ম করে গিয়েছেন বব মার্লের মতো কিংবদন্তি শিল্পী। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি রয়েছে। তবে এসবের মধ্যেই উজ্জ্বল এক উদাহরণ ইউরোপের সবচেয়ে আধুনিক স্টেডিয়াম, যা অবস্থিত জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরে। অন্যান্য খেলা ও পপ কনসার্টও দিব্যি অনুষ্ঠিত হয় এখানে৷ এবং মাঠের ক্ষতি না করেই! আসলে শালকে ক্লাবের এই স্টেডিয়ামে হাইড্রলিক ড্রাইভের সহায়তায় ঘাসে ঢাকা পাত মসৃণ গতিতে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় ১১ হাজার টনের ঘাস সরে গিয়ে মাঠ কনসার্টের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে! এমনও হয়েছে, মার্কিন গায়ক ব্রুস স্প্রিংস্টিন হাজার ষাটেক দর্শকের সামনে গান গেয়েছেন। আবার দু’দিনের মধ্যেই সেখানে বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে ম্যাচ হয়েছে।
[আরও পড়ুন: নিয়ম বদল ICC’র, সর্বোচ্চ পয়েন্ট থাকা সত্ত্বেও টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে দু’নম্বরে নামল ভারত]
কিন্তু এত আধুনিক প্রযুক্তি সব মাঠে কোথায়? তবু তো ফুটবলকে সরিয়ে রেখে অন্য অনুষ্ঠানের খামতি নেই। ঘরের পাশে আরশিনগর বাংলাদেশের কথাই ধরুন। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ফুটবল এবং অ্যাথলেটিক্স মাঝে মাঝে যেন গৌণ হয়ে যায় অন্য খেলার চাপে। খেলা এবং খেলার বাইরের অনেক অনুষ্ঠান বুকে ধারণ করতে বাধ্য হয় মাঠটি।
এবং যুবভারতী স্টেডিয়াম (Salt Lake Stadium)। আমাদের সকলের প্রিয় এই মাঠে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত ‘হোপ ৮৬’-এর কথা একটু পুরনো প্রজন্মের মানুষদের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল। মিঠুন, অমিতাভ বচ্চন ও রেখার মতো বলিউড তারকাদের অংশগ্রহণে সাড়া ফেলে দেওয়া সেই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল বন্যা ত্রাণের তহবিলের জন্যে টাকা তোলা। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে হয়েছিল এআর রহমানের ‘জয় হো’ কনসার্ট। তখন সবে কৃত্রিম অ্যাস্ট্রো টার্ফ বসানো হয়েছে মাঠে। অনুষ্ঠানের শেষে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হয়ে ঘোষণা করেন, আর নাচ-গানের কোনও অনুষ্ঠান হবে না এই মাঠে। অবশ্য পরে আইপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেডিয়ামে। আমেরিকান গায়ক পিট বুল থেকে বলিউডের শাহরুখ, ক্যাটরিনা, দীপিকাদের জমকালো পারফরম্যান্স দেখা গিয়েছিল এখানেই।
এভাবেই ফুটবল মাঠে ফিরে ফিরে আসে এই সব অনুষ্ঠান। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ময়দানে বইমেলা আয়োজন বন্ধ হল কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে। সেবারও এগিয়ে এসেছিল এই যুবভারতীই। তবে স্টেডিয়ামে নয়, তার চারপাশ ঘিরে ১০ একর জায়গা আয়োজিত হয়েছিল সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালির প্রাণের বইমেলা। কোনও ফুটবল স্টেডিয়ামকে ছুঁয়ে এমন কোনও বই পার্বণের উদাহরণ বোধহয় গোটা বিশ্বে আর নেই।