shono
Advertisement

প্রথমবার দূর থেকে শচীনকে লুকিয়ে দেখেছিলেন সৌরভ! জানেন কী করছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার?

শচীন-সৌরভ জুটি রাতের ঘুম কেড়েছিল বোলারদের।
Posted: 04:47 PM Jul 06, 2022Updated: 04:51 PM Jul 06, 2022

সঞ্জয় দাস: ক্রিকেট পৃথিবীর কাছে, আমজনতার কাছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) একজন মহাতারকার নাম হলেও আমার কাছে কখনওই নয়। আমার কাছে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় একজন অভিন্নহৃদয় বন্ধুর নাম, যার ক্রিকেট-জীবনের মুখবন্ধ থেকে এখনও পর্যন্ত, অনেকটা আমার দেখা। প্রিয় বন্ধুর ৫০তম জন্মদিনের আগে যার কিছু কিছু অংশ আমি শেয়ার করলাম এই পরিসরে। 

Advertisement

আড়াল থেকে শচীন দর্শন
বেশ কিছু দিন আগের কথা, ’৮৭-’৮৮-র মরশুম। বিজয় হাজারে ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে কানপুর যাচ্ছি, পশ্চিমাঞ্চলের বিরুদ্ধে ম্যাচ। বিজয় হাজারে তখন অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট, আঞ্চলিক ভিত্তিতে খেলা হত। সেই সময় দারুণ টিম পশ্চিমাঞ্চলের। শচীন তেণ্ডুলকর (Sachin Tendulkar), বিনোদ কাম্বলি (Vinod Kambli), যতীন পরাঞ্জপে। কানপুর যাওয়ার আগে শচীন নিয়ে প্রচুর শুনেছিলাম। সমস্ত কাগজে লেখালেখি চলছিল যে, সুনীল গাভাসকরের ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ওর মধ্যে। পূর্বাঞ্চল আর পশ্চিমাঞ্চল– প্রায় পিঠোপিঠি সময়ে কানপুর পৌঁছল। ফাইভ স্টার হোটেলের চল ছিল না তখন, আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছিল স্টেডিয়াম ডরমেটরিতে। আজও মনে আছে, তখন সন্ধে হব-হব। সামনে চাতালের মতো একটা জায়গা ছিল। সেখানে দেখেছিলাম, স্যান্ডো গেঞ্জি পরে একটা ছেলে নকিং করছে, একা একা। শচীন! আমি আর সৌরভ আড়াল থেকে দেখছিলাম ওকে। আসলে একটা কৌতূহল ছিল আগাম। শচীন সেঞ্চুরি করলেও সেই ম্যাচটায় আমরাই জিতি শেষ পর্যন্ত।
সেই বছরই ‘স্টার ক্রিকেট ক্লাব’-এর হয়ে লন্ডনে খেলতে যাই আমরা। শচীনও গিয়েছিল। বেশ ঠান্ডা ছিল সেই সময়। আর সেখানেও একই দৃশ্য। ওয়েস্ট মিনিস্টার স্কুলে আমাদের রাখা হয়েছিল, যার সামনেই একটা উঠোনের মতো জায়গা। আর সেখানে হুবহু কানপুরের রিপিট টেলিকাস্ট দেখেছিলাম। অত ঠান্ডাতেও শচীনের গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি, কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। একমনে যে শুধু একটাই জিনিস করে চলেছে– নকিং!

[আরও পড়ুন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজের দল ঘোষণা ভারতের, অধিনায়ক ধাওয়ান, বাদ কারা?]

টেস্ট অভিষেক দেখবি না, হয়?
’৯৬-এ লর্ডস। লিভারপুল ক্রিকেট লিগে তখন খেলছি আমি। জয়দীপদা (জয়দীপ মুখোপাধ্যায়) তখন লন্ডনে। শুনেছিলাম, মহারাজ এই টেস্টটা খেলবে। কিন্তু ওই যে, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। আসলে সেই সময় একজন বাঙালি টেস্ট খেলছে, বিশ্বাস করতেও প্রভূত কষ্ট হত। আমার সবে তখন ছেলে হয়েছে। ঠিক করলাম, আমি, আমার স্ত্রী আর সস্ত্রীক জয়দীপদা– মাঠে বসে টেস্ট দেখব। মোবাইলের যুগ ছিল না তখন। মহারাজ ল্যান্ডলাইনে ফোন করে বলল, হোটেলে চলে আয়। আমি খেলছি। তা, গিয়ে ওকে বললাম, ভাই টিকিট ম্যানেজ করে দে। বলার পর দেখলাম, টিকিট আগে থেকে রাখা আছে! সেদিন একটা কথা বলেছিল মহারাজ, জীবনে যা ভুলব না। বলেছিল– তোরা আমার কেরিয়ারের প্রথম বল থেকে দেখছিস। টেস্ট অভিষেক দেখবি না, হয়? এটুকু বলতে পারি, লর্ডস টেস্টের আগের রাতে মহারাজের মধ্যে উত্তেজনা ছিল, কিন্তু টেনশন ছিল না। ভারতীয় টিমের অনেকে (যাদের মধ্যে শচীনও আছে) আমাকে বলেছিল, দাদা ইজ ব্যাটিং ওয়েল। তবে সেঞ্চুরির এফেক্টটা কী, সৌরভ লর্ডসে বোঝেনি। বুঝেছিল, কলকাতা ফেরার পর। 

দায়িত্ব বাড়ল রে…
ভারত অধিনায়ক হিসেবে ওর নাম ঘোষণার পর ফোনে কথা ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি। মহারাজ শুধু বলেছিল, দায়িত্ব বেড়ে গেল। কীভাবে সামলাব, জানি না। কিন্তু সামলেছিল ঠিক।

ইট্‌স অল অ্যাবাউট কনফিডেন্স…
স্পিনারকে সুইপ করে ব্যাটার ছয় মারছে, বিশ্বাস হয়। কিন্তু পেসারকে? তাও আবার শন পোলক, আন্দ্রে নেল, মাখায়া এনতিনি নিয়ে গড়া দক্ষিণ আফ্রিকা পেস অ্যাটাককে? ওয়ান্ডারার্সে ওয়ান ডে ম্যাচে ঘটনাটা ঘটেছিল। শচীন-সৌরভ দু’জনেই সেঞ্চুরি করে ম্যাচটায়। মহারাজ পেসারকে সুইপে ছয়ও মারে! পরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা করলি কীভাবে? উত্তরে বলেছিল, ইট্‌স অল অ্যাবাউট কনফিডেন্স। খেলতে খেলতে আপনাআপনি হয়ে যায়। কোন পর্যায়ের ডেডিকেশন থাকলে এ জিনিস সম্ভব?

মনে আছে, আমরা এখানে ট্রায়ালে আসতাম…
২৩ অক্টোবর, ২০১৯। সকালের কলকাতা-মুম্বই ফ্লাইট, বিজনেস ক্লাস। মহারাজ বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়েছে। ও আর আমি একসঙ্গে মুম্বই যাচ্ছি। যেতে যেতে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। একটু আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছিল মহারাজ সেদিন। আমিও উত্তেজিত, বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওকে কাজ করতে দেখব। তা, হঠাৎ ফ্লাইটে যেতে যেতে আমাকে মহারাজ বলল, ‘শোন যা পাবি, খেয়ে নে।’ শুনেই বুঝলাম, বাকি দিনটা কেমন যেতে চলেছে। আর হলও অবিকল তাই। এয়ারপোর্ট থেকে নেমে হোটেল যাওয়ারও সময় পেলাম না। সোজা বিসিসিআই হেডকোয়ার্টার্স। সেদিন অবাক লেগেছিল, সৌরভের দক্ষতা দেখে। যে যে বিভাগের সঙ্গে বসা দরকার, যাদের সঙ্গে কথা বলার দরকার– প্রত্যেকের সঙ্গে দশ-পনেরো মিনিট করে বলে নিল। দেখুন, সিএবি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছিল তার আগে মহারাজ। কিন্তু সিএবি এক জিনিস, আর বোর্ড আর এক। ভেবেছিলাম, বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম দিনটা সবার সঙ্গে কথা বলে কাটাবে। গল্প-টল্প করবে। দু’তিন পর থেকে কাজ শুরু করবে। কিন্তু কোথায় কী? শুরুতেই কনফারেন্স রুমে একপ্রস্থ বৈঠক করে ফেলল মহারাজ। দেখে মনে হল, কখন ক্রিকেট অপারেশনস ম্যানেজারের সঙ্গে বৈঠক করবে, কখন ফিনান্সের সঙ্গে বসবে– সব আগে থেকে ছকে রেখেছে। পরের দিনের ঘটনাটা আরও সুন্দর। সৌরভের সুইট ছিল মুম্বইয়ের ট্রাইডেন্ট হোটেলের একত্রিশ তলায়। পরের দিন সকালে আমাকে বলল, ‘চলে আয় সঞ্জয়। একসঙ্গে চা খাব।’ আসলে ট্রাইডেন্ট থেকে ওয়াংখেড়েটা দেখা যায় ভালভাবে। সেদিন ওয়াংখেড়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ বলে উঠল– ‘সঞ্জয়, মনে করে দেখ, আমরা এখানে একসময় ইন্ডিয়া ট্রায়াল দিতে আসতাম। সেদিন কি আর ভেবেছিলাম, একদিন বোর্ড প্রেসিডেন্ট হব?’ প্রিয় বন্ধুর জন্য, একজন বাঙালির জন্য খুব গর্ব হয়েছিল সেদিন। অনেকে সৌরভ-বিরাটের সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর কথা বলে। আমি শুধু একটা ঘটনা বলি। সৌরভ প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিরাট যেদিন প্রথম বোর্ড অফিসে আসে, মহারাজ আমাকে বলেছিল, তুই নিজে গিয়ে ওকে উপরে নিয়ে আয়। যা ওর না করলেও চলত কিন্তু। মুশকিল হল, এটাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বিশ্বসেরাকে যে সম্মান দিতে জানে।

[আরও পড়ুন: জন্মদিনের আগে টিভির পর্দায় চোখ সৌরভের, ডোনা ও সানার সঙ্গে বসে কী দেখছেন?]

পৃথ্বী-ঋষভদের ব্যাটিং টিপস…
দিল্লি ক্যাপিটালসের সময়কার কথা। সৌরভ দিল্লির মেন্টর হয়েছে। তার আগে ক্রিকেটার সৌরভ, ক্যাপ্টেন সৌরভকে দেখেছি। কিন্তু মেন্টর সৌরভ কেমন, দেখব বলে একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। দিল্লির কোচ তখন ছিল রিকি পন্টিং। কিন্তু টিম তৈরি করা থেকে শুরু করে সব কিছু বোঝার দায়িত্ব ছিল সৌরভের। দিল্লির প্রথম প্র্যাকটিসের দিন আমি মাঠে। মহারাজ আর আমি– দু’জনেই দিল্লি নেটে সেদিন পৃথ্বী শ’কে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন নেটে কয়েক জনকে বলও করেছিল সৌরভ। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, কারণ প্রায় এক দশক পর মহারাজকে সেদিন বল করতে দেখছিলাম! আর ক্রিকেট গুরু হিসেবে সৌরভ অসম্ভব পারফেকশনিস্ট। কার কোথায় ভুল হচ্ছে, চোখে ধরা পড়লে দু’মিনিট দাঁড়াত না। এমনও হয়েছে, রাত দুটোয় পৃথ্বী-ঋষভদের নিজের রুমে ডেকে ভিডিও অ্যানালিস্টের সঙ্গে বসে পড়েছে। কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়তাম আমি। কিন্তু ঘুমের ঘোরেই শুনতাম সৌরভ বলছে– ‘আরে, না ঘুমিয়ে এগুলো দেখ সঞ্জয়। কাজে লাগবে!’ মেন্টর হিসেবে দেড় মাস ছিল সৌরভ। কিন্তু কী মারাত্মক সিরিয়াস যে ছিল, বলে বোঝানো মুশকিল। ইয়ার্কি-ঠাট্টা, গল্পের মধ্যেও ক্রিকেট থাকত সবসময়। গল্প করলেও ওর মাথায় চলত, কীভাবে বিপক্ষের কোন বোলারকে আটকাবে? কোন ব্যাটারের জন্য কী দাওয়াইয়ের বন্দোবস্ত করবে? জানি না কোচ বা মেন্টর হিসেবে আর কখনও সৌরভকে দেখব কি না? কিন্তু দেখলে, দেশের ক্রিকেটেরই উপকার হবে।

ভাবমূর্তি নষ্ট হলে চুক্তি নয়…
সৌরভকে এই অবতারে খুব কম লোকই দেখেছে। ব্যবসায়ী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু অসম্ভব খুঁতখুঁতে। সব রকম চুক্তি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়। কোনও কম্প্রোমাইজ করে না। কখনও কোনও চুক্তিতে যদি মহারাজের মনে হয়, ওর ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তাহলে যত বড়ই চুক্তি হোক, সই ও করবে না। চুক্তির আগে পর্যন্ত সৌরভ অসম্ভব কঠোর। কিন্তু চুক্তি হয়ে গেলে সম্পূর্ণ অন্যরকম। তখন দেখলে মনে হবে, নিজের প্রোজেক্টে নেমেছে!

কী পাঠক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে আর একটু চেনাতে পারলাম?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement