নদী যখনই মরে, জল নির্ভরশীল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু সরে যায় মাটির উপরের জল থেকে মাটির তলার জলের দিকে। নদী-নির্ভর সভ্যতা নদীর জলের উপর আস্থা না রেখে তেল ও বিদ্যুতের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আমরা সত্যি ভাবি, সত্যি উদ্বিগ্ন?
মাথায় টুপির মতো করে গোল টোকা পরেই বাজারে এসেছে কৃষক (Farmer)। পায়ে কাদা। খালি গা। হাড় লিকলিকে পাঁজর বেরিয়ে। চামড়া বাদামি। হাতে একটা বড় টিনের ঢপ। ডিজেল কিনতে এসেছে। খুব তাড়াহুড়োয় রয়েছে কৃষকটি। জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য মাটির তলার জল তোলার ছোট পাম্পে হঠাৎ করে তেল ফুরিয়ে গেল। কাজেই জল তোলা যাচ্ছে না। যে-কৃষক আগে জমির পাশের নদী-নালা থেকে জল তুলে সেচ দিত, সে-ই কৃষক খোঁজ করছে মাটির নিচের জল তোলার জন্য তেলের। নদীর মৃত্যু তাহলে আাদের বেপরোয়াভাবে তেলনির্ভর করে তুলছে?
হারিয়ে যাওয়া নদীর (River) সংখ্যা নেহাত কম নয় বিশ্বে, বঙ্গে। এই বঙ্গে মরা নদীর শরীরগুলো রিক্ত হয়ে মাঠ-ঘাট-পথের ধারে পড়ে রয়েছে। সেগুলো বর্তমানে কোথাও চাষের জমি। কিংবা নদীর বুককে দখল করেই তৈরি হয়েছে বসতবাড়ি। এমন এক নদীর খোঁজ পেতেই যাওয়া উত্তর দিনাজপুর জেলায়। রায়গঞ্জ থেকে কম—বেশি ২৪ কিলোমিটার দূরে কালিয়াগঞ্জ, এক মফস্সলি শহরে। এই শহরের গা-ঘেঁষে একসময় বয়ে চলত শ্রীমতী নদী। লোকমুখে ‘ছিরামতী’। বাংলাদেশের বিল থেকে তার জন্ম। তারপর কাঠন্দরের কাছে উত্তর দিনাজপুরে প্রবেশ। এই নদীর চলার পথ নালাগোলা, বামনগোলা হয়ে মালদহ জেলায় টাঙন নদীতে শেষ হয়। এই যাত্রাপথে নদীটা আর ‘নদী’ নেই। নদীটা মরে গেল।
[আরও পড়ুন: ওভার রেট স্লো হলে শাস্তি পেতে হবে ম্যাচ চলাকালীনই, নয়া নিয়ম আনছে আইসিসি]
কেন? প্রাকৃতিক কারণের থেকেও মানুষ-সৃষ্ট কারণ নদীর মরার নেপথ্যে অনেক বেশি দায়ী। নদীর চলার পথে মানুষ বানাল রাস্তা। নদীর বহু জায়গা দখল করে তৈরি হল বসতবাড়ি। নদীর বুকে গড়ে উঠল ছোট ছোট সেতু। কাজেই নদীর চলার পথ হল সংকীর্ণ। বর্ষা হলে আশপাশের উঁচু এলাকা থেকে জল নেমে আসে। তখন মরা নদীর বুকে জল জমে। বৃষ্টির মরশুম ফুরয়। জলে টান ধরে। জল নামতে শুরু করলেই নদীর মরা শরীর তখন ধানের ‘বীজতলা’। তারপর আরও জল নামে। পুরো নদীর বুক হয়ে ওঠে চাষের জমি।
পরিমল দাস, ৪৬, ভাগচাষি। শ্রীমতী নদীর বুকে চাষ করেন। ভূমি দফতরের রেকর্ডে নদীর বুকের জমির মালিকের নাম অন্য। সেই জমি দু’-হাজার টাকা বিঘা দরে লিজ নিয়ে বছর দশেক চাষ করছেন পরিমল। বছর ২৫ আগেও নদীর বুকে চাষ হত। তখন বর্ষার সময় নদীর বুকের জমা জলকেই ব্যবহার করা হত চাষের জন্য। জনরোই, ঝিঙাশাল, মাগুরশাল, চেঙা প্রভৃতি ধান হত। স্থানীয় ধানগুলো নদীর বুকে জমা হঁাটুজলে কিংবা তার থেকে কম ‘ছিপছিপানি’ জলেই হত। সেই ধানের বীজ তুলে রেখে পরের বছর চাষ করা, এটাই ছিল এই এলাকার পরম্পরা। এখন আর সেই ধানের কোনও বীজ নেই। কোম্পানির লোকেরা চাষিদের কাছে এসে বুঝিয়েছিল, দেশি ধানের ফলন কম, আবার লাভও কম। কাজেই নদীর বুকে ‘সংকর’ ধানের চাষ করে শেরগ্রাম, ভেলাই, কুঁকড়ামণি, ধনকৈল এই এলাকার মানুষ।
শ্রীমতীর পাশে পিরবন্ধ মোড়ের কাছে পেয়েছিলাম বছর ৫৫—র কৃষক শিবনাথকে। সেচ কীভাবে দেন জমিতে? প্রশ্নটা করতেই উত্তর আসে, ছোট ছোট ডিজেলচালিত পাম্প নদীর বুকে বসিয়ে দিলেই মাটির তলা থেকে জল ওঠে। সার, কীটনাশক ও তেল মিলিয়ে চাষের খরচ বেশ অনেকটা বেড়ে যায়। অনেক সময় ছোট পাম্প চালিয়েও জল ওঠে না। তখন নদীর একেবারে মাঝখান থেকে জল তুলতে হয়। আবার, কোনও কোনও চাষি ডিপ টিউবওয়েল থেকেও জল কেনে।
এ তো গেল নদীর বুকে চাষের কথা। কিন্তু নদীর জমি দখল, নদীর জমির হস্তান্তর– সেটা কখন বা কীভাবে হল? শান্তি কলোনির শ্মশানের কাছে পাওয়া গেল এলাকার স্থানীয় বেশ কিছু মানুষকে। কথা বলে জানা গেল, এক সময় নদী সংস্কার করে মাছচাষের কথা ভাবা হয়েছিল। ফারাক্কা ব্যারেজের আধিকারিকরা শ্রীমতী নদীর সমীক্ষায় এলে তাঁদের ঘিরে শুরু হয় প্রতিবাদ। এরপরই রাতারাতি জমির হস্তান্তর শুরু হয়। নদী জুড়ে পাট্টা পড়ে যায়। নদীর জমির এখন যাঁরা মালিক, তাঁরা পেশায় কেউই কৃষক বা মৎস্যজীবী নন– বেশিরভাগই বড় বড় ব্যবসাদার। তাঁরা-ই মূলত লিজে জমি দিয়ে চাষ করাচ্ছেন। শ্রীমতী বাঁচানোর লড়াই কিছু স্থানীয় মানুষ শুরু করলেও দানা বাঁধেনি।
মুর্শিদাবাদের গোয়াসে নেমে যে-রাস্তাটা ঘোষপাড়ার দিকে যাচ্ছে, সেখানেই পাওয়া যাবে আর-একটা হারিয়ে যাওয়া নদী। গুমানি। শিয়ালমারি ও ভৈরবের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করত এই নদী। কিছু এলাকার প্রবীণ মানুষ ছাড়া এই নদীটার নাম স্থানীয় বেশিরভাগ লোকই জানে না। যেদিন থেকে শিয়ালমারি মরে গেল, সেদিন থেকেই গুমানি নদীটাও আস্তে আস্তে মরে যায়। আর, মরা নদীটার এই শরীরটা এখানেও চাষের জমি। তবে বর্ষায় যেটুকু জল জমে, তারা সেই জলটাকে সেচের কাজেও লাগায়। অনেক জায়গায় নদীটার বুকে আস্ত একটা পুকুর বানিয়ে নিয়েছে এলাকার মৎস্যজীবীরা।
নদীর জল শুকালে স্থানীয় কৃষকরা সেখানে গিয়ে ধানের চাষ করছে। কিছু জায়গায় পাটও চাষ হচ্ছে। এখানে নদীর জমি হস্তান্তরিত হয়নি। চাষিরা স্বচ্ছন্দ তুলনায়। নদীর বুকে জলটা জমে থাকে বলে বহু জায়গায় পাট জাগ দিচ্ছে চাষিরা নদীর বুকে। বৃষ্টি কম হলে মরা নদীতে জল জমে না। জল তখন আসছে কোথা থেকে? মাটির তলার জল পাইপ দিয়ে তুলে নদীর বুকে পাট জাগ দেওয়া হয়।
বোরো চাষের সময় ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে বেশি জল তুলে নিলে ছোট শ্যালো দিয়ে নদীর বুক থেকে জল ওঠে না। পুরনো মানুষদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, আজ থেকে দু’-দশক আগেও এই নদীর জলে কম-বেশি ৩০টি গ্রাম নির্ভরশীল ছিল। কয়েকটা রিভার লিফটিং পাম্প ছিল নদীর ধারে। নদী মরেছে। কীভাবে মারা গিয়েছে? অভিযোগ, নদীর বুকে অবৈধ দখলদারি নদীর স্বাভাবিক জলের প্রবাহপথকে নষ্ট করে দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছে বড় নদীর জল ঢোকার পথ।
আসলে, নদী যখনই মরে, জল নির্ভরশীল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু সরে যায় মাটির উপরের জল থেকে মাটির তলার জলের দিকে। নদী-নির্ভর সভ্যতা নদীর জলের উপর আস্থা না রেখে তেল ও বিদ্যুতের উপর বেশি নির্ভরশীল।
‘তেল পোড়ানো’-র অর্থ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো। আর বিদ্যুৎ পোড়ানোর অর্থ কয়লা পোড়ানো, কম-বেশি এক কথা। তেল কিংবা কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি যত পোড়ে, তত ‘গ্রিন হাউস’ গ্যাসের জন্ম দেয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ে। একের পর এক ক্লাইমেট সামিট হয়। ক্ষমতাশালী দেশের লোকেরা বড় বড় কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত ক্লাইমেট চেঞ্জের নাম করে কে কতটা ফান্ড আদায় করে নিতে পারেন তারই নাকি আয়োজন চলে, এমনই অভিযোগ। আর, অচিরাচরিত শক্তির উৎস ও ব্যবহারের কথা বলা হলেও সেগুলোর দাম এবং পরিকাঠামো নির্মাণ অনেক ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে প্রান্তিক কৃষকের কাছে। সরকারি ভরতুকি পায় জমির মালিক। কাজেই ভাগচাষির তাতে কিছু লাভ হয় না। খাতায়-কলমে এক সত্য। আর, মাঠের সত্য সম্পূর্ণ আলাদা।
সমাধানের পথে প্রথমে প্রয়োজন কৃষকের জন্য জলের সুরক্ষা প্রদান করা। এলাকা ভিত্তিতে ‘ওয়াটার বাজেট’ তৈরি করতে হবে প্রশাসনকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের পরিকাঠামোকে আরও নিপুণভাবে গড়ে তুলতে হবে। ১০০ দিনের কাজের মধ্য দিয়ে মরা নদীগুলোকে সংস্কার করা দরকার। আর, এলাকা ভিত্তিতে ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জিং পিট’ তৈরি করা যেতে পারে। যে পরিমাণ জল পৃথিবীর তলপেট থেকে তোলা হচ্ছে, কিয়দংশ যদি পূরণ করা সম্ভব হয়! (মতামত নিজস্ব)
লেখক নদী বিশেষজ্ঞ
karmakarsupratim@gmail.com