যুদ্ধের থেকে অনেকেই সরাসরি লাভ করে, যেমন অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা, বা সেসব নির্মাণ কোম্পানি, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্নির্মাণের বরাত পাওয়ার আশা রাখে। এদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীর অতিবৃহৎ কোম্পানিগুলির মধ্যে পড়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চলে যুদ্ধ ও অশান্তির উপর- যত বেশি যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, মাফিয়ারাজ- তত বেশি ব্যবসা। কারণ যাই হোক, এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অনেকেই চাইছে এই যুদ্ধটা চলুক।
যে-সময় একটি গণতান্ত্রিক দেশের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ রাজ্যের ভোট ও তার ফলাফল নিয়ে ব্যস্ত ভারতের মানুষ, সেই সময়েই যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়েছে ইউক্রেনের আকাশে। সেসব ছবি ক্রমাগত স্মৃতিবদ্ধ হচ্ছে, যা বারবার দেখলেও বিশ্বাস করা কঠিন। সহসা ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে এসে পড়ছে একটি ব্যস্ত আধুনিক শহরের মাঝখানে, সামরিক কিংবা অন্যান্য সরকারি ইমারতে। কখনও দিক্ভ্রষ্ট হয়ে, কখনও বা ইচ্ছাকৃত। হাসপাতালে, স্কুলে, সাধারণ মানুষের বাড়িতে আগুন দাউদাউ। কখনও একটি সমগ্র পরিবার ঘরের উঠোনে বসে হঠাৎ ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে। দলে দলে মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা, ঘরবাড়ি ছেড়ে কখনও গুলি-বোমার মাঝখান দিয়েই ছুটে যাচ্ছে অন্য শহরে বা দেশে। সঙ্গের শিশুটি তো আর এখনও সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর স্তর পার করেনি। সে বেচারি বুঝতেই পারছে না যে কোথায় যাচ্ছে, আর কেনই বা যাচ্ছে।
আবারও বলি, এই ছবি বারবার দেখলেও বিশ্বাস করা কঠিন এই কারণে যে, মানুষই মানুষের এই দশা করছে। যারা পরস্পরকে চেনেও না, যাদের মধ্যে কোনও ভালবাসা কিংবা শত্রুতা নেই। একদল সাদামাঠা লোকই একদল সাধারণ মানুষের দিকে ছুড়ে মারছে ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্র। এখন যে আমরা ঠান্ডা ডাল-ভাত গেলার সময় বোকা বাক্সর সামনে বসে যুদ্ধের আচারে জিভ জড়াচ্ছি, তারাই বা যে আগামীতে এই চক্করে পড়ব না, তা কে জানে? সেজন্যই এই সহজ নীতিকথার উপস্থাপনা। মানুষ কী করে দিনের-পর-দিন বিশ্বের ভিন্ন প্রান্তরে এই ধরনের হিংস্রতা ও বোকামোর সঙ্গী হচ্ছে এবং নিজেদের অবোধ পৃথিবীকে অকারণ গোলমালের, এমনকী ধ্বংসের সম্ভাবনার সামনে ফেলে দিচ্ছে, সে-প্রশ্ন আর চালাকির আবরণে ঢেকে রাখা মুশকিল।
[আরও পড়ুন: ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’: ক্ষমতা বদলায়, তবুও ফাইল চাপা আগুন নিভল কই?]
‘যুদ্ধ’ বিষয়ে কথা বলতে গেলে এখন শুরুতেই এই যুদ্ধ এবং এক্ষেত্রে আগ্রাসী শক্তি রাশিয়ার নিঃশর্ত নিন্দা করতেই হয়। কোনও প্রতিবেশী সম্পর্কে চিন্তিত হওয়ার কারণ কিছু থাকলেও, সরাসরি নিজে আক্রান্ত না হলে কোনও কারণই যুদ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর, এক্ষেত্রে পুতিনের রাশিয়া জেলেন্সকি-র ইউক্রেনের তুলনায় বহুগুণ বেশি শক্তিশালী এবং তাদের নিজেদের আক্রান্ত হওয়ার আশু সম্ভাবনা ছিল না। তা-ও তারা বিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে ইউক্রেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং শান্ত জনপদের উপর টানা গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে।
এরপর এই বিষয়ে উল্টো দিকটাও দেখা প্রয়োজন। এই যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হল কীভাবে? এই সময়ে টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেকেই ওই অঞ্চল এবং পূর্ব ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। গুছিয়ে লিখলে বেশ কয়েকটা থিসিস হবে। তবে খুব বেশি গভীরে না গিয়েও বোঝা যাচ্ছে যে, রাশিয়া কয়েকটি দাবি করেছিল। যার মধ্যে একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেটা মেনে নিলেই রাশিয়া বলেছিল তারা যুদ্ধে বিরত থাকবে, সেটি হচ্ছে যে, ইউক্রেনকে কথা দিতে হবে যে, তারা ‘ন্যাটো’-র সদস্য হবে না। কারণ, রাশিয়া মনে করে ইউক্রেন ন্যাটো-র সদস্য হলে তা রাশিয়ার ভৌগোলিক সুরক্ষাকে সরাসরি খর্ব করবে।
যাঁরা রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করছেন, তাঁদেরও অনেকেই কিন্তু রাশিয়ার এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। ‘ন্যাটো’ সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পরে, ১৯৪৮ সালে। কারণ নাকি যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতি! হিটলারের জার্মানির মতো কোনও শক্তির হাতে হঠাৎ করে পুরো ইউরোপ আবার যাতে পর্যুদস্ত না হয়, সেই কারণে পশ্চিম ইউরোপের অনেকগুলি এবং উত্তর আমেরিকার দু’টি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা) দেশ মিলে এই জোট তৈরি হয়।
তখন শক্তির ভারসাম্য অন্যরকম। একদিকে তথাকথিত পশ্চিমি দুনিয়া, যার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো, যার নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন। ন্যাটো-র ভূমিকা হয়ে দঁাড়ায় সামরিক শক্তির মাধ্যমে এই প্রথম দলের স্বার্থরক্ষা। অন্যদিকে ন্যাটো-র কলেবর-বৃদ্ধির সঙ্গে, বিশেষত পশ্চিম জার্মানি ন্যাটো-র অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে, ১৯৪৮ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ মিলে একটি জোট তৈরি করে। সে চুক্তিটির নাম ‘ওয়ারশ প্যাক্ট’। ন্যাটো বা ওয়ারশ গোছের পশ্চিমি নাম শুনে আমরা শ্রদ্ধাবনত। আদতে কয়েক দল গালকাটা সমাজসেবী পেটো হাতে শেওড়াফুলি চুক্তি করলেও হয়তো তা একই মানের হত। সে কারণেই এসব চুক্তির নেপথ্যে যেসব যুক্তি আছে, তার পক্ষে এবং বিপক্ষে গাদা গাদা কথা লেখা যায়, এবং সেগুলো যে খুব গভীর ভাবনার ফসল, এমনও নয়। তবে শুধু দল বানালে তো হবে না। পাড়া-বেপাড়ার মধ্যে হালুমহুলুম করাও জরুরি। তাই এরপর প্রায় সাড়ে তিন দশক তথাকথিত ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলে দুই শিবিরের মধ্যে।
সময়ের লেখচিত্রে ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতন এবং ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূর্চ্ছা। তার অল্প আগে-পরে ইউরোপের বাকি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও উলটপুরাণ এবং সেই সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরপরে ওয়ারশ প্যাক্ট স্বভাবতই অর্থহীন হয়ে গেল। তাহলে তো যুক্তি অনুযায়ী ন্যাটো-র প্রয়োজনও ফুরনোর কথা। কিন্তু আদতে হয় তার উল্টো। একমেরু পৃথিবীতে ন্যাটো-র কলেবর বাড়তে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যেমন- ইরাক, বসনিয়া, কসোভো, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি। ন্যাটো-র সীমানা উত্তর আটলান্টিকের উপকূল থেকে ক্রমশ পূর্বদিকে বাড়তে থাকে। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলি দেশ গত তিরিশ বছরে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়ার মাধ্যমে বাল্টিক সাগরের উপকূলে ন্যাটোর পূর্ব সীমান্ত এখন রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে এসে উপস্থিত। এটুকু সত্যি যে, রাশিয়া এই নিয়ে ক্রমাগত আশঙ্কা প্রকাশ করে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ কিছু হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনেরও ন্যাটো-য় যোগ দেওয়ার কথা আলোচিত হচ্ছে, আর সেই নিয়েই এই যুদ্ধ।
এখানেই রাশিয়া একদমই বেঁকে বসে এবং জানায় যে ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। তাদের যুক্তির মূলকথা ন্যাটো কোনও ক্লাব বা সমাজসেবামূলক সংস্থা নয়। এটি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ও আগ্রাসী দেশগুলির সামরিক জোট। ইউক্রেন ন্যাটো-র সদস্য হলে সেই জোটের সমরাস্ত্র ইউক্রেনে এসে উপস্থিত হবে এবং তার মূল নিশানা হবে রাশিয়া। ন্যাটো-র গত ৩০ বছরের কার্যকলাপকে সরাসরি সামরিক শক্তিবৃদ্ধি, শক্তিপ্রয়োগ এবং সম্প্রসারণের ইতিহাস বলা যায়। সেই কারণে ইউক্রেনের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার আশঙ্কা তাদের দিক থেকে অর্থহীন নয়। সুতরাং, এটা বলা যায় যে, এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ দায় রাশিয়ার উপর বর্তালেও দীর্ঘদিন ধরে এই যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরির দায়িত্ব ন্যাটো এবং ইউক্রেনের উপরেও আসে।
এখানে অনেকেই একটি যুক্তি দিচ্ছেন যে, ইউক্রেন একটি স্বাধীন দেশ, সুতরাং সে যে-জোটে খুশি যোগ দেবে। প্রতি-যুক্তি হল, যদি আমি স্বাধীনভাবে এরকম কোনও সিদ্ধান্ত নিই যা সরাসরি আমার প্রতিবেশীর সুরক্ষা বিঘ্নিত করে, তাহলে সেই প্রতিবেশীর চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে এবং সে যথেষ্ট শক্তিশালী হলে তার চোটপাট করার সম্ভাবনাও যথেষ্ট। এখানে সেটাই ‘রাশিয়ার আগ্রাসন’। তবে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে আবারও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ইউক্রেনের ন্যাটো-য় অন্তর্ভুক্তি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কারণ থাকলেও, রাশিয়ার এই যুদ্ধকে কখনওই সমর্থন করা যায় না। যে কোনও বিষয়ের মতোই এই অবস্থার মীমাংসা নিশ্চয়ই আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে হতে পারত, যদি দু’পক্ষের রাষ্ট্রনেতাদের বুদ্ধি, সদিচ্ছা এবং অপর পক্ষের কথা শোনার এবং বোঝার ক্ষমতা থাকত। কিন্তু এই আপাত-সরল জিনিসগুলি আসলে খুবই দুর্লভ এবং তাই যুদ্ধ লেগেছে। এবং যে কোনও যুদ্ধের মতোই রাশিয়ার এই আক্রমণ বয়ে নিয়ে আনছে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ও দুর্ভোগ।
আর যে-কথাটি এই যুদ্ধ সম্পর্কে বোঝা যাচ্ছে, তা হল কোনও দেশেরই, বিশেষ করে পশ্চিমি প্রথম বিশ্বের যারা, তাদের এই যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে ঐকান্তিক উৎসাহ নেই। বেশিটাই লোক-দেখানো। তারা রাশিয়ার উপর বিভিন্ন ‘নিষেধাজ্ঞা’ জারি করছে, ইউক্রেনকে উসকানি দিচ্ছে, তাদের প্রেসিডেন্ট এবং সাধারণ মানুষকে নায়কের সম্মান দিচ্ছে (এক যুক্তিতে সে সম্মান তাদের সত্যিই প্রাপ্য), প্রচুর অস্ত্র পাঠাচ্ছে এবং আরও পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যে সামান্য শান্তি প্রক্রিয়া ও আলোচনা চলছে, সে ব্যাপারে তাদের খুব একটা উৎসাহ নেই। পাড়ায় কোনও ঝামেলা হলেও আমরা দেখেছি যে, দর্শকদের মধ্যে দু’-রকমের লোক থাকে। একদল যুযুধান দু’পক্ষকে টেনে সরিয়ে আনতে চায় এবং মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলে। অন্যদল মারামারি চালাতে উৎসাহ দেয়। এক্ষেত্রে পশ্চিমি দুনিয়ার ভূমিকা এই দ্বিতীয় দলের মতো। সব মেলালে এই সন্দেহ হতে বাধ্য যে, ইউক্রেনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়।
কেন চায় তা বলা মুশকিল, তবে কয়েকটি সম্ভাবনার কথা অনুমান করা যেতেই পারে। প্রথমত, রাশিয়া যদি জেতে এবং ইউক্রেন দখল করে নেয়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি দেশগুলির পৃথিবীর উপর যে একাধিপত্য (তথাকথিত একমেরু পৃথিবী), সেখানে একটি বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন বসে যাবে। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের থেকে অনেকেই সরাসরি লাভ করে, যেমন অস্ত্র-ব্যবসায়ীরা, বা সেসব নির্মাণ কোম্পানি, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে পুনর্নির্মাণের বরাত পাওয়ার আশা রাখে। এদের মধ্যে অনেকেই পৃথিবীর অতিবৃহৎ কোম্পানিগুলির মধ্যে পড়ে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের ব্যবসা চলে যুদ্ধ ও অশান্তির উপর- যত বেশি যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, মাফিয়ারাজ- তত বেশি ব্যবসা। কারণ যাই হোক, এটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অনেকেই চাইছে এই যুদ্ধটা চলুক।
এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে শেষ যে-কথাটি বোঝার চেষ্টা করার দরকার, সেটিই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন। সেই প্রশ্নটির প্রথম অংশ, যুদ্ধ হয় কেন? যে কোনও যুদ্ধের নিরিখে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এসব বিষয়ের পণ্ডিতদের এই প্রশ্ন করলে তাঁরা সেই যুদ্ধের কারণ গভীরে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। তুলনায় আমাদের প্রশ্নটা সাধারণ অর্থে করা, এবং এটি একটি বিশেষ যুদ্ধ নিয়ে নয়। সাধারণ মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে পাণ্ডিত্যের আবরণ সরিয়ে রেখে, কেবল সরল এবং সবল মানবতার দৃষ্টিতে। সাধারণভাবে আমরা সবাই যুদ্ধর হৃদয়বিদারক ছবি দেখে ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ এবং বিষণ্ণ। সবাই চাইছি এই যুদ্ধের সমাপ্তি। বস্তুত, আমরা প্রায় কাউকেই চিনি না যে অন্যকে মেরে, তার সম্পত্তি দখল করে, ব্যক্তিগতভাবে ধনী হতে চায়। অর্থাৎ প্রায় কেউই যুদ্ধ চায় না, যদি না তা একান্ত আক্রান্ত মানুষের বাঁচার লড়াই হয়। সবাই খোঁজে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অধিকার, কাজের সুযোগ এবং শান্তিপূর্ণ জীবন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বারবার এই পৃথিবীতে যুদ্ধ হয়। তাহলে কে যুদ্ধ ও ধ্বংস চায়, কার স্বার্থে যুদ্ধ হয়?
যুদ্ধ হয় শাসকশ্রেণির ইচ্ছায়, সম্পদ দখল ও ক্ষমতাবিস্তারের লোভে, ব্যক্তিগত গরিমার আকাঙ্ক্ষায়। আর এই যুদ্ধে সর্বাধিক মূল্য দেয় সেসব অগুনতি সাধারণ মানুষ– কখনও যুদ্ধের সেনা হয়ে, কখনও সাধারণ নাগরিক হিসাবে। এরা কেউ যুদ্ধ চায়নি। তাদেরই জীবনের মূল্যে লাভবান হয় শাসকশ্রেণি, যারা একইসঙ্গে ক্ষমতা এবং সম্পদের বিপুল অংশ ভোগ করে। মজার কথা হল, প্রতিটি যুদ্ধের আগেই শাসকশ্রেণির প্রয়োজন হয় তার সাধারণভাবে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের কিছু একটা বুঝিয়ে পক্ষে নিয়ে আসা। তার জন্য তারা কখনও ব্যবহার করে উগ্র জাতীয়তাবাদ, কখনও ধর্মীয় জিগির, কখনও অন্য দেশ আর সেখানকার মানুষ সম্পর্কে মিথ্যা প্রচার। আর, আমরা অনেকেই এসব প্রচারে প্রভাবিত হয়ে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, শাসকের ফন্দিতে সম্মতি জানাই।
এখানেই ওঠে এই বিষয়ের পরবর্তী অংশের প্রশ্ন- আমাদের, অর্থাৎ এই পৃথিবীর বিপুল শান্তিকামী ‘সাধারণ’ মানুষের, শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর লক্ষ্যে কী করণীয়? শুধু ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ বলে আওয়াজ তোলা যথেষ্ট নয়, যদিও অন্তত এই আওয়াজটুকু তোলা প্রয়োজনীয়। আমরা প্রত্যেকেই বুঝি যে, দীর্ঘদিন শান্তিকামী মানুষের ইচ্ছাকে অস্বীকার করে এই পৃথিবীর ক্ষমতাবানরা নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে, যার মূল্য চুকিয়েছে সাধারণ মানুষ, জীবনের বিনিময়ে, শান্তির বিনিময়ে, স্বাধীনতার বিনিময়ে। তাই আজ আমাদের নতুন করে সাবধান হওয়া দরকার। দরকার রাষ্ট্র, সম্পদ ও ধর্মের ক্ষমতাবান অংশের দুরভিসন্ধি ও মিথ্যা প্রচারকে চিনতে পারা। প্রয়োজন উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের জিগিরের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করা।
মহাবিশ্বের একটি হারিয়ে যাওয়া কোণে পড়ে থাকা একটি যৎসামান্য কিন্তু অত্যাশ্চর্য গ্রহ এই পৃথিবী। তার জীবজগৎকে রক্ষা করাই সবথেকে বেশি জরুরি। এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ নেই। সমাজবদ্ধ জীবের প্রাথমিক শর্ত হিসাবে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে সবাই মিলেমিশে ভাগ করে বেঁচে থাকাটাই তো দস্তুর। সেই অভ্যাস চালু থাকা দরকার প্রত্যেক দিন, দঁাত মাজার মতো করে।
[আরও পড়ুন: ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ভারত কি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল ?]
মহাভারতে যুদ্ধের শুরুতে অস্ত্র পরিত্যাগ করে অর্জুন প্রশ্ন করেছিলেন: এই যুদ্ধে, এই বিপুল ধ্বংসে কী লাভ? সেই ছিল যুদ্ধ নিয়ে একাধারে শ্রেষ্ঠতম এবং সরলতম প্রশ্ন। উত্তরে কৃষ্ণ অর্জুনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু অর্জুন বুঝতে চান না। শেষ পর্যন্ত অর্জুনকে বোঝানোর জন্য কৃষ্ণকে একটি পরাবাস্তবের আশ্রয় নিতে হয়, ‘দেখাতে’ হয় ‘বিশ্বরূপ’। বুঝতে হবে যে জাদুবাস্তবের অলৌকিকতা আদতে মানুষেরই সৃষ্টি। তাই এগুলোকে বাদ দিয়ে যদি দেখা যায়, তাহলে অর্জুনের প্রশ্নটি এখনও একইরকম সত্য ও প্রাসঙ্গিক। বাস্তবের মাটিতে যুদ্ধ হলে অন্যরা মরে, লক্ষ কিংবা অর্বুদে। আমরাও বাঁচি কি?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক দীপাঞ্জন গুহ সংগীতশিল্পী
এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
শুভময় মৈত্র আইএসআই কলকাতার অধ্যাপক
dipanjanguha2022@gmail.com
maitra.subhamoy@gmail.com