প্রীতীশ নন্দী: এই সিজনের ‘বিগ বস’ দেখেছেন আপনারা? যদি দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় আপনাদের জানা রয়েছে কোন তিন যুগল এবার জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহে অবশ্য খেলার নিয়ম অনুযায়ী এলিমিনেট হয়ে ঘর থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রতিযোগী পবিত্রা পুনিয়া। এর ফলে, ফাইনালে পৌঁছে গেলেও টেলিভিশন জগতের এককালের বিগেস্ট স্টার ৪৫ বছর বয়সি এইজাজ খান পবিত্রার সঙ্গে তাঁর জমাটি কেমিস্ট্রি মিস করছেন। এবং, এখন তিনি রীতিমতো ‘হার্ট ব্রোকেন’। ঘরের আরেক যুগল আলি ঘনি এবং তার বিশেষ বন্ধু জেসমিন ভাসিন। এঁরাও জমাটি প্রতিযোগী। আপাতত সেরার লড়াইয়ে শামিল জেসমিন, এলিমিনেট হয়েছেন আলি। তৃতীয় এবং শেষ জুটি হলেন টেলিভিশন অভিনেত্রী রুবিনা দিলায়েক এবং অভিনব শুক্লা, যাঁরা নিজেদের বিয়ের প্ল্যানিংও সেরে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই।
প্রথম যে দু’টি জুটির কথা বললাম, তাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, বরং ভালবাসার উপর আস্থা রেখে দু’জনে দু’জনের কাছাকাছি এসেছেন, পোশাকি ভাষায় যাকে বলে ‘ইন্টার-ফেথ কাপল’ (Inter Faith Couple)। এই ধারা অবশ্য নতুন নয়। বহু বছর আগে থেকেই এই ধরনের সম্পর্কের সঙ্গে ওয়াকিবহাল আমরা। যেমন ধরুন, কিশোরকুমার-মধুবালা, শর্মিলা ঠাকুর-টাইগার পতৌদি, বা হালে হৃত্বিক রোশন-সুজান খানের সম্পর্ক। এঁদের কাউকেই কোনও দিন সমাজের কেউ প্রশ্ন করেনি কোন উদ্দেশ্যে তাঁরা একে-অপরকে ভালবেসেছেন বা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। কারও নজরে এটাও আসেনি যে তাঁরা ভিন্নধর্মে বিশ্বাসী। আমরা এঁদের সম্পর্ক, প্রেম নিয়ে বিস্তর পড়েছি, কিন্তু ধর্ম নিয়ে আলোচনা সেখানে থাকেনি।
[আরও পড়ুন : দেশের প্রাচীনতম আইনেই আজও জন্ম হয় নতুন নতুন জেলার, জানুন এর ইতিহাস]
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে হঠাৎই সেসবের ব্যতিক্রম ঘটছে। এখন সবার মুখে মুখে আলোচ্য বিষয় ‘লাভ জেহাদ’ (Love Jehad)! কী এই লাভ জেহাদ? বিজেপির অভিধান মতে, এর অর্থ আন্তঃধর্মীয় প্রণয়। বিজেপি-শাসিত বহু রাজ্য এখন মুখিয়ে রয়েছে নতুন আইন পাস করার জন্য, যার দরুন আন্তঃধর্মীয় বিবাহ ‘নিষিদ্ধ’ বলে ঘোষিত হবে এবং শাস্তিস্বরূপ থাকবে দশ বছরের কারাদণ্ডবিধি। কেন? কারণ, বিজেপির মতে, এ হল দেশের নিরীহ-সংকটাপন্ন হিন্দু মেয়েদের ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশে্য এক বিভ্রান্তিকর চক্রান্ত। তাদের মতে আন্তঃধর্মীয় কোনও সম্পর্কের ভিত ভালবাসা হওয়া এককথায় অসম্ভব।
আমাদের দেশে পাঁচজনের মধ্যে নাকি চারজনই হিন্দু– একথা যেমন ভ্রান্ত, ঠিক একইরকম ভ্রান্ত ধারণা এটাও যে– অন্যান্য ধর্মের মানুষ, বিশেষত ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নাকি জনসংখ্যায় ক্রমশ বেড়ে চলেছে, আর হিন্দুরা তাদের সংখ্যা বাড়াচ্ছে না। মুসলিম জনসংখ্যা যে উদ্বেগজনকভাবে ক্রমবর্ধমান তার কোনও প্রমাণ না থাকলেও মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল, যেহেতু ইসলাম ধর্ম একের বেশি সংখ্যক বিবাহ সমর্থন করে এবং তাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সচেতনতার অভাব রয়েছে, সুতরাং অদূর ভবিষ্যতেই তাদের অবস্থান সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চেয়ে মজবুত হয়ে উঠবে দেশে। অথচ আদতে আমাদের দেশে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যেদিন অন্যান্য নিচের বর্ণের মানুষদের সমমর্যাদা দেবে, সেদিন নিজে থেকেই কমে আসবে ধর্মান্তরকরণের হার। যতদিন সামাজিক বৈষম্যের বীজ রয়ে যাবে, ততদিনই সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষ অন্য ধর্মবিশ্বাসের দিকে ঝুঁকবে, যেখানে তারা প্রাপ্য মর্যাদা পেতে সক্ষম। একই কারণে নিজের ভক্ত-অনুরাগীদের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশ্বাস রাখার কথা বলে গিয়েছিলেন ড. বি আর আম্বেদকর।
অবশ্য এটা কোনও নতুন সমস্যা নয়। ঐতিহ্য এবং প্রথা অনুযায়ী দম্পতি হতে গেলে এক ধর্ম বিশ্বাস, এক জাত-বর্ণ এবং এক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া একরকম অলিখিত নিয়ম। এখানেই শেষ নয়, সঙ্গে ঠিকুজি-কোষ্ঠী মেলাও আবশ্যক! আমাদের সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে দুই পরিবারের সমর্থন এবং বৃহত্তর সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি থাকতেই হয়। প্রেম-ভালবাসা তো তার পরের ব্যাপার। এই মানসিকতা শুধুমাত্র ধর্মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। পরিবার এবং সম্প্রদায়কে শাসনে রাখা, নিজেদের প্রতাপ প্রদর্শন এবং কর্তৃত্ব ফলানোর অভিপ্রায়ে এই ধরনের নিয়ম তৈরি করেছে সমাজের বয়োঃজ্যেষ্ঠরা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এই নিয়ম মানতে নারাজ, তারা নিজেরা নিজেদের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে ইচ্ছুক। তারা ভালবেসে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। ফলে আমরা আজকাল মাঝেমধ্যেই দু’টি ভিন্ন ধর্ম বা জাতির মধ্যে বিবাহের সাক্ষী হচ্ছি। যেখানে ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে প্রাধান্য পাচ্ছে মানুষ এবং মনুষ্যত্ব। তাই আকছার তামিল ব্রাহ্মণের বিয়ে হচ্ছে কাশ্মীরি মুসলিমের সঙ্গে, কেরলের সাইরিয়ান খ্রিস্টান বেছে নিচ্ছেন শিখ সম্প্রদায়ের একজন সিন্ধি জীবনসঙ্গী। ভিন্নধর্মী বিশ্বাসের মানুষ এখন নানা জায়গায় জড়ো হচ্ছেন। অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বহু মানুষ প্রতি বছর নিয়ম করে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির যাচ্ছেন, আবার ইসলাম ধর্মাবলম্বী না হয়েও আজমেঢ় শরিফ পাড়ি দিচ্ছেন অনেকে। প্রত্যেকেই শিরডিতে গিয়ে থাকেন একবার না একবার। ইংরেজি বর্ষপূর্তির আগের দিন রাতে কলকাতায় সেন্ট পল ক্যাথিড্রালের সার্ভিসে উপস্থিত থাকছেন সব ধর্মের মানুষ। এই সমস্ত কারণেই বিজেপির মাথাব্যথা। জনতার বিশ্বাসের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয় তাদের ক্রমাগত তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
[আরও পড়ুন : ‘নিঃশব্দ’ ভোটারদের উপস্থিতি গুরুত্ব পেল মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে]
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এটাই আমাদের দেশের মাহাত্ম্য। বহুত্ব-ই আমাদের পরিচয়। আপনি যে-মুহূর্তে ভাববেন– এই তো, এটাই ‘ভারত’, সেই মুহূর্তে আরও এক ভিন্ন স্তর ভারতের পরিচিতি হিসাবে আপনাকে মুগ্ধ করবে। আর এটাই হিন্দুত্বের শক্তি, বিশালতা। এই ধর্মচিন্তা প্রত্যেককে যে-যার নিজের মতো করে অন্তরের বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করার পরিসর দেয়। এই ধর্মের জন্য উদ্দিষ্ট কোনও বই নেই যাকে তথাকথিতভাবে ‘ধর্মগ্রন্থ’ বলা যায়। কোনও পবিত্র পাঠের বিষয় নেই। আছে গল্প, আখ্যানের বিপুল ভাণ্ডার। যেখান থেকে জীবনের বিভিন্ন শিক্ষা আহরিত হয়। প্রত্যেক গুরুরই নিজের শিক্ষার কিছু ব্যাখ্যা থাকে, ঠিক সেরকমই আমাদের দেশে রামায়ণের তিনশোটি ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে বিশ্বাস করার জন্য, এমনকী আমি দেশের সেই জায়গার প্রতিনিধিত্ব করি, যেখানে রাবণের মতো চরিত্রকেও খলনায়ক মনে করা হয় না।
আমাদের দেশে আন্তঃবিশ্বাস, আন্তঃবর্ণ, আন্তঃসম্প্রদায়ের বিবাহ চিরকালই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। প্রায়শই কানে আসে ‘অনার কিলিং’-এর ঘটনা, যেখানে বিধর্মী সঙ্গীকে বেছে নেওয়ার জন্য, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অপরাধে বাড়ির লোকের হাতে খুন হয় সাহসী মেয়েরা। আমাদের দেশে এখনও এমন বহু জায়গা রয়েছে, যেখানে নিজেদের সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে করার অপরাধে পরিবারকে একঘরে করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। উত্তর ভারতে এমন অনেক ‘খাপ’ রয়েছে, যেখানে স্বজাতীয়কে বিয়ে না-করার অপরাধে অমানবিক শাস্তি পেতে হয়। যাঁরা ‘সাইরত’ ছবিটা দেখেছেন তাঁরা আরও ভাল জানবেন কীভাবে, শুধুমাত্র ভিন ধর্মের হওয়ার দরুন তরুণ দম্পতিকে খেসারত দিতে হয় বাড়ির লোকের হাতে প্রাণ দিয়ে।
এত পৃথক মত ও পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিবিধের উদ্যাপন করাই ভারতের বিশেষত্ব এবং ভারত এ কারণেই আজও টিকে আছে। সীমান্তে বিনিদ্র রাত কাটিয়ে যে-সেনারা আমাদের সুরক্ষিত রাখেন, তাঁদের এক-একজন এক-এক সম্প্রদায়ের, তাঁরা এক-একজন ভিন্ন ঈশ্বরের পুজো করেন, তবুও একত্রে ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার্থে তাঁরা অভিন্ন। বিবিধের মাঝে মিলন আছে বলেই ১২২টি ভাষা এবং ১৫৯৯টি উপভাষা নিয়েও একটি জাতি একত্রে বাঁধা আছে। আমাদের খাওয়াদাওয়া আলাদা, আমরা ভিন্ন ঈশ্বরে বিশ্বাসী, ভিন্ন উৎসবে আমাদের আনন্দ।
৩০০০টি জাতি এবং ২৫০০০ উপজাতি রয়েছে আমাদের দেশে, যা কঠোর শ্রেণি-বিন্যাসে আবদ্ধ। এর বাইরে রয়েছেন দলিত, আদিবাসীরা– যাঁদের হিসাবেই ধরা হয় না এই জাতপাতের বিন্যাসে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, ভারতের উপজাতি নিয়ে প্রগাঢ় তথ্যের জন্য ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত প্রত্নতত্ত্ববিদ ভেরিয়ের এলউইন-এর লেখা পড়ে দেখতে পারেন। গান্ধীর জীবৎকালে একজন ধর্মপ্রচারক হিসাবে ভারতে এসেছিলেন তিনি। এখানকার উপজাতীয় মানুষদের ধর্মান্তরকরণ করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু ঘটনাচক্রে গান্ধীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, তিনি আদিবাসী মানুষদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন এবং শেষমেশ নিজেই হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হন।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভারতের হৃদয়ের পরিসর কতটা গভীর যা মানুষের মন জয় করে নিতে পারে নিমেষে। কিন্তু তার জন্য প্রথমেই খারিজ করতে হবে ঘৃণা। যারা ভালবাসার সাহস দেখাচ্ছে, তাদের সাহসিকতাকে কুর্নিশ জানানোর সময় এসেছে। কারণ রাগ পোষণ করা অন্ধ ‘ভক্তরা’ নয়, এই নতুন প্রজন্মই দেশের ভবিষ্যৎ, যারা ভালবাসতে জানে।