২০০৮। আমেরিকায় ‘সাবপ্রাইম’ সংকটের জেরে ‘লেম্যান ব্রাদার্স’ দেউলিয়া হয়েছিল। ১৫ বছর পরে ডুবল ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’, ‘সিগনেচার ব্যাংক’। মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি চাপে, কর্মী ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা। ভারতীয় ব্যাংক ব্যবস্থায় এর প্রকোপ এসে পড়বে কি? যদিও ভারতের ব্যাংকগুলি আমেরিকার মতো শিল্পকেন্দ্রিক নয়। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
আমেরিকার ‘সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক’-এর ডুবে যাওয়া বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে। সেই আতঙ্কেই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকার ‘সিগনেচার ব্যাংক’ নামে আরও একটি ব্যাংক ডুবেছে। ‘ব্যাংক ব্যবস্থা’ এমনই একটি ব্যবসা, যেখানে আমানতকারীর আতঙ্কের বড় ভূমিকা রয়েছে। আমানতকারীরা যদি একবার এমন আতঙ্কে ভুগতে শুরু করে যে, ব্যাংকে রাখা তাদের আমানত সুরক্ষিত নয়, তাহলে ব্যাংক ব্যবস্থার পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়। কারণ, আতঙ্কে ভুগে আমানতকারীরা তাদের টাকা তুলতে শুরু করলেই ব্যাংকের ডুবে যাওয়া অনিবার্য হয়। ঠিক যেমনটা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঘটেছে।
আমানতকারীর এই আতঙ্ক কতটা সংক্রামক, তা বোঝা গেল সুদূর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় ব্যাংক-পতনের ঢেউ মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আরব সাগরের তীরে মুম্বইয়ে এসে আছড়ে পড়ার মধ্য দিয়ে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের সংক্ষেপে পরিচয় ‘এসভিবি’। মুম্বইয়ে গত ১১৬ বছর ধরে ব্যবসা করে ‘সামরাও ভিটল কো-অপারেটিভ ব্যাংক’, যেটি মানুষের কাছে পরিচিত ‘এসভিসি ব্যাংক’ বলে। এসভিবি ব্যাংক ডুবে যাওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনওভাবে রটে যায় বিপন্ন মুম্বইয়ের এসভিসি ব্যাংক-ও। দুই ব্যাংকের সংক্ষেপিত নামের মিলটুকু ছাড়া আর কোনও যোগ নেই। কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘এসভিবি’-র সূত্রে ‘এসভিসি’-র নাম চলে আসায় দ্রুত আতঙ্ক ছড়ায় মুম্বইয়ের আমানতকারীর মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে এসভিসি ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের জানাতে হয়, আমেরিকার এসভিবি-র সঙ্গে তাদের কোনওরকম যোগাযোগ-ই নেই। এসভিসি ব্যাংকের আমানত সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
[আরও পড়ুন: কূটনীতির ট্রাপিজ, ইউক্রেন যুদ্ধে কীভাবে নিরপেক্ষ থাকবে ভারত?]
মনে রাখতে হবে, ২০০৮ সালে মার্কিন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ‘লেম্যান ব্রাদার্স’-এর পতনের পর ঠিক একইভাবে আতঙ্ক গ্রাস করেছিল বিশ্ব অর্থনীতিকে। একটা ব্যাংকের পতন ডেকে এনেছিল বিরাট আর্থিক মন্দা। ২০০৮-এর ওই আর্থিক মন্দা আমেরিকায় ‘সাবপ্রাইম’ সংকট হিসাবে পরিচিত। মন্দার আগে মার্কিন অর্থনীতি ভীষণভাবে চাঙ্গা ছিল। ব্যাংকগুলির হাতে প্রচুর পরিমাণে মজুত টাকা ছিল। সে-সময় সেই টাকা দিয়ে তারা ঢালাও গৃহঋণ দিয়েছিল ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা যাচাই না করেই। এরপরে অর্থনীতিতে কিছুটা মন্দা দেখা দিতেই যখন একের পর এক ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা ব্যাংককে ফেরত দিতে ব্যর্থ হল, তখনই সংকটে পড়ল একের-পর-এক ব্যাংক। লেম্যান ব্রাদার্স ছিল ব্যাংকের ব্যাংক। প্রথম ডুবে গেল তারা। রাতারাতি লেম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া হয়ে যেতেই অর্থনীতি চলে গেল মন্দা-র গ্রাসে।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের সংকটও একইভাবেই এসেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ও পরিষেবার জন্য পৃথিবীতে বিখ্যাত। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের লগ্নিও মূলত এই তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেই। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের নতুন উদ্যোগগুলিতে তথা স্টার্টআপে এরা লগ্নির জোগান দেয়। এই ব্যাংকের আমানতকারীরাও প্রধানত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে লগ্নিকারী। লকডাউনের সময় মার্কিন তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ও পরিষেবায় ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির আয় বাড়ায় ২০২১-এ সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের আমানত ৮৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারে। গ্রাহকদের আমানতের টাকা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মূলত লগ্নি করে রেখেছিল মার্কিন সরকারের বন্ড ও ঋণপত্রে। ২০২২ থেকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে আমেরিকার ফেডারাল রিজার্ভ তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে শুরু করে। এক বছরে সুদের হার ৪৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হারের এই বৃদ্ধি তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের নতুন উদ্যোগগুলির সামনে টাকার সংকট তৈরি করে। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে লগ্নি ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় একদিকে ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট’ তথা নতুন উদ্যোগে লগ্নিকারীর সংখ্যা কমে যায়, অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির নিজস্ব চাহিদা মেটানোর জন্য ভাঁড়ারে টান পড়তে থাকে। হঠাৎ করে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এবং এই শিল্পে লগ্নিতে আগ্রহীরা ব্যাংক থেকে তাদের জমানো টাকা তুলতে শুরু করে। এতেই সংকট তৈরি হয় সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের সামনে।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের অধিকাংশ গ্রাহক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা বা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লগ্নিকারী। এই গ্রাহকরা আমানত তুলতে শুরু করায় টাকার জোগান দিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার হাতে থাকা সরকারি বন্ড ভাঙাতে বাধ্য হয়। বাজারে যখন সুদের হার বাড়ে তখন বন্ডের দাম কমে। কারণ, সুদের হার বাড়লে বন্ডের আকর্ষণ কমে যায়। যেহেতু বন্ডে সবসময় একটা নির্দিষ্ট সুদের হার লেখা থাকে। ব্যাংক সুদের হার বাড়ালে লোকে নতুন সুদের হারে বন্ড কিনতে আগ্রহ দেখায়। পুরনো বন্ডের বাজার থাকে না। তাই সেগুলির দাম পড়তে থাকে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক তাদের বড় অংশের আমানতের টাকা বন্ডে লগ্নি করে রাখায় টাকা জোগাড়ের জন্য বন্ড ভাঙাতে গিয়ে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে। এই ক্ষতির ফলে শেয়ার বাজারে তাদের শেয়ারের দাম পড়ে যায়। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাংকের ডুবে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমানতকারীকে বাঁচাতে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক অধিগ্রহণ করে ‘দ্য ফেডারাল ডিপোজিট ইনসিওরেন্স কর্পোরেশন’। গত শতাব্দীর তিনের দশকে মহামন্দা-র সময় মার্কিন সরকার ব্যাংক বাঁচাতে এই কর্পোরেশনটি তৈরি করেছিল। ব্যাংকগ্রাহকের আড়াই লক্ষ ডলার পর্যন্ত আমানত এরা বিমা করে রাখে। ভারতের ব্যাংকে যেমন গ্রাহকের পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লগ্নি রিজার্ভ ব্যাংক বিমা করে রাখে। ডুবে যাওয়া ব্যাংকের গ্রাহকের আড়াই লক্ষ ডলার সঙ্গে সঙ্গে এফডিআইসি ফেরত দিয়ে দেয়। কিন্তু বাকি টাকা অনিশ্চিত।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ৯০ শতাংশ গ্রাহকের আমানতই বিমা করা আড়াই লক্ষ ডলারের বেশি। গ্রাহকরা বিমাকৃত অঙ্কের অতিরিক্তটা কবে পাবে, তা অনিশ্চিত। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, অন্তত ৪০টি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি যাদের অ্যাকাউন্ট সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে রয়েছে, তারা তাদের কর্মীদের আগামী মাসে বেতন দিতে পারবে না। বহু তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাকে কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে যেতে হবে। ব্যাংকে রাখা টাকা ডুবে যাওয়ায় একাধিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা উঠেও যেতে পারে। সবমিলিয়ে আশঙ্কার কালো মেঘ মার্কিন অর্থনীতির আকাশে।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক ডুবে যাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিউ ইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংকের ডুবে যাওয়ার খবর এসেছে। এই ব্যাংকে মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সি সংস্থার লগ্নি। ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক-সহ আরও কয়েকটি ব্যাংক অর্থ সংকটে পড়েছে। মার্কিন শেয়ারবাজারে দাম পড়ে গিয়েছে জেপি মরগ্যান চেজ, ব্যাংক অফ আমেরিকা, সিটি গ্রুপ, গোল্ডম্যান স্যাকস-এর মতো বড় বড় আর্থিক সংস্থারও। ফলে, ২০০৮ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফের একটি ব্যাংক ডুবে যাওয়ার ঘটনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ব্যবসা প্রধানত ক্যালিফোর্নিয়ায় হলেও এটি আমেরিকার ব্যাংকের তালিকায় ১৬তম স্থানে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, আমেরিকার বাইরেও সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের ব্যবসা রয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের ব্রিটিশ শাখাটি মাত্র ৯৯ টাকায় কিনে নিয়েছে HSBC ব্যাংক। ভারতেও সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের শাখা আছে। যেখানে কাজ করেন ৮০ জন। পেটিএম-সহ বেশ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের নতুন উদ্যোগে তাদের লগ্নি রয়েছে।
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ডোবার আতঙ্ক সংক্রমণের মতো এখন কত দূর ছড়ায়, তা দেখার। ২০০৮ সালে ব্যাংক ডোবা আটকাতে টাকার থলি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জুনিয়র জর্জ বুশের সরকার। একের-পর-এক ব্যাংককে অর্থের জোগান দিয়েছিল বুশ প্রশাসন। করদাতাদের টাকা দিয়ে এবারও ব্যাংক বাঁচাতে বাইডেন প্রশাসন এগিয়ে আসবে কি না, তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক শুরু হয়েছে। আরও ব্যাংক যদি ডুবতে থাকে তাহলে হয়তো মার্কিন প্রশাসনকে এগিয়ে আসতেই হবে। এর জের এখন বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ভারতেও কি পড়বে? ভারতের আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছেন, ভারতের ব্যাংকগুলি আমেরিকার মতো একটি শিল্পকেন্দ্রিক নয়। ভারতের ব্যাংকগুলি মূলত নির্ভরশীল ছোট ছোট আমানতকারীর উপর। তারা কখনওই একসঙ্গে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে আসে না। ভারতের কোনও বড় ব্যাংক-ই তাদের সব লগ্নির টাকা সরকারি বন্ডে ঢালে না। সরকারি বন্ডে লগ্নির পরিমাণও রিজার্ভ ব্যাংক বেঁধে দেয়। ফলে রিজার্ভ ব্যাংক যতই সুদ বাড়াক, তাতে ব্যাংকগুলির ডুবে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হবে না। স্মরণীয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ‘সাবপ্রাইম’ সংকট তুঙ্গে, তখনও কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতিতে তার ঝাঁকুনি সেভাবে পড়েনি। এর কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ভারতের ব্যাংক ব্যবস্থা যেহেতু রাষ্ট্রায়ত্ত, তাই বিশ্বব্যাপী মন্দা-র প্রভাব পেড়ে ফেলতে পারেনি। তবে আমেরিকার এই ঘটনা থেকে দ্রুত শিক্ষা নিতে হবে রিজার্ভ ব্যাংককেও। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য লাগাতার সুদের হার বাড়িয়ে যাওয়ার পরিণতি কী হতে পারে, তার পুনর্বিচার ও পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।