‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার প্রতিবেদন বলছে, রিপাবলিকানদের মধ্যে থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রবল মেরুকরণ ঘটিয়ে দেওয়ার পরেও সমীক্ষা-মতে জনসমর্থনের একটা বড় অংশ তাঁর নাগালে। ট্রাম্প ফিরলে তা হতে পারে একনায়কতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন! অতি দক্ষিণপন্থার জাগরণ পৃথিবীর অন্যত্রও ঘটছে। রোখার রায়? কলমে সুমন ভট্টাচার্য
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার সাম্প্রতিকতম প্রচ্ছদ কাহিনির বিষয় বিশ্বজুড়ে একনায়কতন্ত্রের উত্থান। বিশ্বের অন্যতম তাত্ত্বিক এবং বিশ্লেষণাত্মক পত্রিকা রূপে পরিচিত পত্রিকাটি দেখিয়েছে- এশিয়া থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে খাস মার্কিন মুলুকে কীভাবে গণতন্ত্রকে ‘কেয়ার’ না-করা একনায়ক রাজনীতিকরা নিজেদের রাজনৈতিক একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছেন। ভারতের নরেন্দ্র মোদি থেকে তুরস্কের এরদোয়াঁ প্রমুখের উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গও উত্থাপন করে। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর প্রতিবেদন বলছে যে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একের-পর-এক মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার ঘটনা সামনে আসছে, কিন্তু তারপরও যিনি অতি দক্ষিণপন্থীদের কাছে ‘আইকন’ হয়ে রয়েছেন এবং নিজের দল অর্থাৎ, রিপাবলিকানদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ সমর্থন ঝুলিতে পুরেছেন, তাঁর কথা তো আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে!
আদালত এবং মার্কিন সংবিধান যদি বাধা না-হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আগামী বছরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী যে ডোনাল্ড ট্রাম্প-ই হতে চলেছেন, সে-কথা এতদিনে সবাই বুঝে গিয়েছেন। মার্কিন প্রথা অনুযায়ী, প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজেদের প্রার্থী বাছতে যে প্রাইমারি নির্বাচন করে, সেখানে যদি কোনও প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় ২০ পয়েন্টে এগিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি-ই দলের মনোনয়ন পেতে চলেছেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত। রিপাবলিকান দলে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, ডি. সান্টিসের চেয়ে ট্রাম্পের ‘লিড’ যেহেতু ২০ পয়েন্টেরও বেশি, সেহেতু আগামী নির্বাচনে তিনি মার্কিন রাজনীতির বিচারে কট্টরপন্থী এই দলের প্রার্থী হবেন, এমনটা ধরে নেওয়াই যায়।
এখানেই শেষ নয়, ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এবং ‘সিয়েনা’ ওপিনিয়ন পোল সংস্থার যুগ্ম সমীক্ষা বলছে, যদি আগামী বছরের নির্বাচনে বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের লড়াই হয়, তাহলে দু’জনেই ৪৩ শতাংশ মানুষের সমর্থন পেতে পারেন। যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আমেরিকার আইনসভা অর্থাৎ ক্যাপিটল হিল আক্রমণের জন্য সমর্থকদের প্ররোচিত করার অভিযোগ রয়েছে এবং আদালতে সেই বিষয়ে মামলাও চলছে, তিনি যদি আবার হোয়াইট হাউস দখলের যুদ্ধে ইতিমধ্যেই ৪৩ শতাংশ মানুষের সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যান, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রর কোন প্রবণতার দিকে আপনি আঙুল তুলবেন? তাহলে কি মেনে নিতে হবে না যে, খাস আমেরিকাতেও একনায়ক বা অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিস্ময়কর উত্থান হচ্ছে?
যেহেতু মার্কিন মুলুকে যে কোনও সমীক্ষা মোটামুটি একটা ইঙ্গিত দেয়- জনগণের মধ্যে কোন গোষ্ঠী কার দিকে ঝুঁকে রয়েছে, সেই অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, সে-দেশের শ্বেতাঙ্গরা ট্রাম্পের জনসমর্থনের বড় অংশ। এবং রাজনৈতিক প্রবণতা অনুযায়ী, শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যারা গ্র্যাজুয়েট বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষিত, তারা যেমন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী রূপে জো বাইডেনকে পছন্দ করে, তেমনই কৃষ্ণাঙ্গরা কিংবা এশীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে অর্থাৎ ‘কালার্ড পিপল’-দের সমর্থনের দিক থেকে ডেমোক্র্যাটদের পাল্লা ভারী। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয়, হিস্পানি বা লাতিনোদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়ছে ট্রাম্পের!
সংখ্যাতত্ত্ব এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দিক থেকে আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ: ওই মুখ-না-খোলা বাকি অংশ, তা কোনদিকে ঝুঁকছে, কারণ সেটাই নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, রিপাবলিকান দলের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশ এমন সমর্থক রয়েছে, যারা কোনও যুক্তিতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবে না।
আমেরিকার বিভিন্ন মতামত সমীক্ষা দেখাচ্ছে, রিপাবলিকান দলের মধ্যেই একদিকে যেমন ৩৭ শতাংশ এমন মানুষ রয়েছে যারা ডোনাল্ড ট্রাম্প ছাড়া কাউকে ভোট দেবে না, তেমনই ২৫ শতাংশ এমনও সমর্থক রয়েছে, যারা এই ধনকুবের রাজনীতিককে ঠেকাতে অন্য যে কোনও কাউকে এমনকী রাজনৈতিক দিক থেকে ‘শত্রু’ কাউকেও ভোট দিয়ে জিতিয়ে দিতে পারে! এটাই আসলে একনায়কদের সমস্যা। তাঁরা রাজনৈতিকভাবে যে তীব্র মেরুকরণ তৈরি করেন, তাতে যেমন একেবারে ‘ফিক্সড ডিপোজিট’-এর মতো নিজস্ব ভোট ব্যাংক থাকে, তেমনই ‘চিরশত্রু’-ও তৈরি হয়ে যায়। আর এই চিরশত্রুরা যদি রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলায়, তাহলে দাবার হিসাব উলটে যেতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নরেন্দ্র মোদি- এই দুই একনায়ক একসঙ্গে আমেরিকা ও ভারতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করেছেন এবং তাঁদের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে। রাজনীতিতেও যেমন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে, তেমনই এমন মতামতের বহু লোক রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে ‘নরেন্দ্র মোদি ছাড়া যে কেউ’ অর্থাৎ মোদি ছাড়া যে কাউকে তারা সমর্থন করতে পারে। মেরুকরণের নিয়ম অনুযায়ী, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা ভীষণভাবে সত্যি।
তুরস্কে এরদোয়াঁ কিংবা ভারতে নরেন্দ্র মোদি যেটা পারেন, অর্থাৎ নিজের একাধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় সরকারি, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার আর দেশের মেনস্ট্রিম মিডিয়াকে নিজের সুবিধার জন্য পরিচালনা করা, সেটা মার্কিন মুলুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই অতি দক্ষিণপন্থী নেতা রূপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে জয়টা সবসময় নিশ্চিত হয়ে যায় না। কিন্তু বাকি অনেক দিক থেকে মোদি, এরদোয়াঁ কিংবা ট্রাম্প একবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। এঁদের সমর্থকরা বিশ্বাসই করে না যে, তাদের নেতা কোনও ভুল বা অন্যায় করে থাকতে পারেন! রিপাবলিকান দলে যারা ট্রাম্পের সমর্থক, তারা যেমন মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন ২০২০ সালে জোর করে, অন্যায়ভাবে তাদের ‘আইকন’-কে হারিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
[আরও পড়ুন: লোকসভা নির্বাচনে মোদি গড়ে কি ধাক্কা দিতে পারবে বিরোধী জোট?]
‘দ্য ইকোনমিস্ট’ একটা চমৎকার তুলনা করে দেখিয়েছে যে, এরদোয়াঁ বা ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের দেশের ক্ষেত্রে যতই ভুল করুন, এঁদের অনুগামীরা বিশ্বাস করে, তিনি যা করছেন তা দেশের ভাল করবে। ‘আমার নেতা কোনও ভুল করতে পারে না’- এই নিঃশর্ত আনুগত্য এবং ‘আইকন’ থেকে প্রায় দেবতার পর্যায়ে প্রিয় নেতাকে উন্নীত করা, এটাই বোধহয় এই শতাব্দীর একনায়কতন্ত্রের অন্যতম পরিচয়, এবং জনসমর্থন তৈরির রাজনৈতিক অস্ত্র।
প্রাক্তন পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলের মামলা কিংবা ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ মদতের অভিযোগ, কোনও কিছুই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঠেকাতে পারছে না! তবে যাঁরা মার্কিন গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা রাখেন, সেই প্রগতিশীলরা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত এক বছরে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘রেটিং’ ক্রমাগত বেড়েছে। বিশেষ করে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাত ‘নিষিদ্ধ’ করে দেওয়ার পরিণতিতে, সে-দেশে মহিলা এবং প্রগতিশীলরা কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করার পর ডেমোক্র্যাটদের দিকে জনসমর্থন বাড়ছে।
ডেমোক্র্যাটদের এই নিজস্ব ভোট ব্যাংকের পাশাপাশি প্রয়োজনে ট্রাম্পকে ঠেকাতে অতি বামপন্থী এবং ‘মডারেট’ দক্ষিণপন্থীরাও যদি বাইডেনকে সমর্থন করে, তাহলেও রাজনৈতিক পাটিগণিত উলটে যেতে পারে। একনায়ককে ঠেকানোর সহজ ফর্মুলা, যারা তাঁকে ঘৃণা করে, তাদেরকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। একমঞ্চে নিয়ে আসা। আর, সেটা বোধহয় আমেরিকার মতো বিশ্বের অনেক গণতন্ত্রেই ঘটতে পারে।
(মতামত নিজস্ব)