রাজনৈতিক সংগ্রামে ভিনেশ ফোগতের আসার সিদ্ধান্ত হরিয়ানার পিতৃতন্ত্র আর সংস্কারে চোবানো ক্ষমতাতন্ত্রকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। হরিয়ানার শিকড়গাঁথা বর্ণবাদী ও পরিবারতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষরা সবসময় শেষ কথা বলেন। ভিনেশ কি সেই দেওয়ালে চিড় ধরাবেন? লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
পূর্ণ সমাবেশ, সেখানে শক্তপোক্ত জাট পুরুষরা ভিড় করে রয়েছে, তার মধ্যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে একজন মহিলা– হরিয়ানার রাজনীতির পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত যে-ব্রহ্মাণ্ড, সেখানে এমন বিচ্যুতি আগে দেখা হয়নি। অলিম্পিক কুস্তিগির, অধুনা রাজনীতিবিদ ভিনেশ ফোগত এমনই একজন ‘সেলিব্রিটি’, যিনি তঁার তারকা-সত্তা নিয়ে যথেষ্ট অবহিত। এই শরতের রোদে এক বিপুল জমায়েতকে বেশ কয়েক ঘণ্টা তিনি অপেক্ষা করিয়ে রাখলেন বটে, কিন্তু তাই নিয়ে কারও বিশেষ কোনও ভ্রুক্ষেপ কিন্তু দেখা গেল না। বয়স্ক মানুষ থেকে উত্তেজিত কিশোর-কিশোরী– প্রত্যেকেই হরিয়ানার এই নতুন ‘আইকন’-এর অল্প হলেও দেখা পাওয়ার জন্য উতলা। কেউ তার মাথায় বেঁধে দিচ্ছে পাগড়ি, এক গ্রামের সরপঞ্চ তঁাকে একটি রুপোর গদা উপহার দিচ্ছেন, বাকিরা অধীর আগ্রহে আছে একটিমাত্র নিজস্বীর জন্য। একটা ছোট্ট বক্তৃতা, বিজয়ীর হাসি, এবং দর্শকের উদ্দেশে্য একটা চটজলদি হাত নাড়া– ব্যস, এটুকুই! ভিনেশ তঁার পরবর্তী সমাবেশের জন্য রওনা দিলেন। কুস্তির মঞ্চ থেকে রাজনৈতিক ‘দঙ্গল’-এর ময়দানে এই যাতায়াতটা ঠিক যতটা মসৃণ, ততটাই অভিঘাতপূর্ণ।
প্যারিস অলিম্পিকসে ভিনেশ দুনিয়াকে চমৎকৃত করে দিয়েছিলেন অলিম্পিক-জয়ী ইউই সুয়াকির আধিপত্যকে নস্যাৎ করে তঁাকে পরাজিত করে। ফাইনালে যাওয়ার পথে সেটা ছিল ব্যাপক এক লাফ। এর পরেই, ওজন সামান্য বেশি– এই অজুহাতে তঁাকে বিতর্কিতভাবে বাতিল করা হল অলিম্পিকের দৌড় থেকে। হঁ্যা, হয়তো হরিয়ানার জিন্দ জেলার ঝুলানা-য় গমখেত, সরষে খেতের বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর প্যারিসের ঝলমলে আলোর মধে্য যোজন-যোজন দূরত্ব; কিন্তু এখন ভিনেশের লড়াইয়ের তীব্রতা এমন কিছু কমজোর নয়। কংগ্রেস বিগত ১৫ বছরে জুলানার আসনটা জিতে উঠতে পারেনি, এমনকী, মূলধারার কোনও দলের হয়ে কোনও মহিলাও লড়েনি এখানে এত দিন।
বিভিন্ন দলের অন্তত ১২ জন প্রার্থী এই জাট-অবদমিত কেন্দ্রে লড়াই করছেন। জিতলে ভিনেশ সততই ইতিহাস রচনা করবেন, ঝুলানা-র প্রথম মহিলা জনপ্রতিনিধি হিসাবে। রাজনৈতিক সংগ্রামে ভিনেশের আসার সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের জন্যও টাটকা বাতাস বয়ে এনেছে। সাম্প্রতিক কালে, বেশিরভাগ তারকা তঁাদের যাবতীয় জনপ্রিয়তার হিড়িক নিয়ে বিজেপিতেই গিয়ে ভিড়েছেন মূলত। তারকাদের জ্বাজল্যমানতা তখনই উজ্জ্বল হবে, যখন বিজয়ী পক্ষের পাশে গিয়ে দঁাড়াবেন। বিগত দশক ধরে, হরিয়ানা এবং অন্যত্র বিজেপি তাদের একচ্ছত্র দাপট দেখিয়ে এসেছে। যৌন হেনস্থার অভিযোগে অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে বিগত বছরে, রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান অলিম্পিক কুস্তিগিরর। এই যে আলোকবর্তিকায় থাকা তারকারা শাসক পক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধায় শামিল হচ্ছেন– তা আদতেই বিরল ঘটনা ছিল। সেই ঘটনার অভিঘাতেই, ভিনেশ এখন ক্রমে হয়ে উঠছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রতিমূর্তি, স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রর বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়ানো বিরোধী শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠা এক প্রতিরোধী ব্যক্তিত্ব। এতদিনে, দশ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর, বিজেপি শাসকবিরোধী হাওয়া টের পাচ্ছে। কিন্তু এই হাওয়া বদলের একজন মুখ দরকার, যে জনাবেগের প্রতিনিধিত্ব করবে। এই ২০২৪-এ এসে, অবশেষে কংগ্রেস সেই মুখ খুঁজে পাচ্ছে ৩০ বছর বয়সি এই অলিম্পিক কুস্তিগিরের মধে্য।
হরিয়ানার বাইরে, ভিনেশকে নিয়ে জনমত দ্বিধাবিভক্ত। বিজেপির সমাজমাধ্যমের সেনাবাহিনী নিয়ম করে তঁার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছে। খেলার প্রতি তঁার নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠে আসছে, নির্দ্বিধায় দাগিয়ে দেওয়া যাচ্ছে তঁাকে এই বলে যে, প্রতিবাদের সিঁড়ি বেয়ে নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার গুছিয়ে নিচ্ছেন ভিনেশ। শেষে যে তিনি পদক পাননি, তা তঁাকে ঘিরে বিতর্ককে আরও আড়াআড়ি বিভাজিত করে তুলছে। অনে্যর ঘাড়ে দোষ না-চাপিয়ে কি তঁার সীমিত ওজন ধরে রাখতে না-পারার ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়া উচিত? না কি, তিনি কেবলই পরিস্থিতির শিকার, ক্রীড়ানক হিসাবে তঁার অনেক বেশি সমানুভূতি প্রাপ্য ছিল, দোষারোপের চেয়ে? আশ্চর্যভাবেই, প্রতিযোগিতার শেষ স্তরে এসে তঁার তীরে এসে তরী ডোবার মতো ছিটকে যাওয়া, যেন তঁার জীবননাট্যকে আরও টানটান করে তুলল।
চরখি দাদরির এক প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মেয়ে স্বচক্ষে দেখেছিল, তঁার সাধারণ বাসচালক বাবাকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হতে। তখন সে কৈশোরেও পৌঁছয়নি। ভিনেশের সংশয়াকুল মা তঁাকে, এবং তঁার বোনদের বড় করে তুলেছিলেন, একটাই মাত্র লক্ষ্য নিয়ে। তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, যে জীবন, যে সুযোগসুবিধা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করে উঠতে পারেননি কখনও, তা যেন তঁার সন্তানরা পায়। গ্রামের কুস্তির আখড়া হয়ে উঠেছিল ভিনেশের নতুন জীবন খুঁজে পাওয়ার মার্গ। সহজাত প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রম তঁার আশা-আকাঙ্ক্ষার আগুন-সলতেকে আরও উসকে দিয়েছিল। পুরুষশাসিত একটি খেলায় এক মহিলা ‘পহেলভান’-কে সফল হতে গেলে আগে তো শতাব্দীপ্রাচীন সামাজিক নিগড়গুলো ভাঙতে হবে। ভিনেশের সঙ্গে-সঙ্গে হরিয়ানার একটা গোটা প্রজন্ম ঠিক সেই কাজটাই করেছিলেন, রাজ্যকে তঁারা তুলে দিয়েছিলেন বিশ্বক্রীড়ামানচিত্রে।
‘দঙ্গল’ জাতীয় বড় ক্যানভাসের ছবি ফোগত পরিবারের এই নাটকীয় উত্থানকে ধরেছিল, কুস্তি খেলাটিকে ঘিরে নতুন করে তৈরি করেছিল স্পন্দন। কিন্তু খেলাই হোক বা সেলুলয়েড, রাজনীতি এই দুয়ের চেয়েই কর্কশ। তাই, ওই রুক্ষ, স্থবির পরিপার্শ্ব থেকে উত্তরণের আখ্যানের যে-চেনাশোনা রোমান্টিকতা– ভিনেশের কেরিয়ার তার অনেকটা ঊর্ধ্বে। রাজনীতির মাঠে নেমে ভিনেশ যে কেবল অলিম্পিক পোডিয়ামে উঠে দঁাড়ানোর স্বপ্ন প্রত্যাখ্যান করলেন, তা-ই নয়, একইসঙ্গে পিতৃতন্ত্র আর সংস্কারে চোবানো একটি ক্ষমতাতন্ত্রকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন।
হরিয়ানার শিকড়গঁাথা বর্ণবাদী ও পরিবারতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুরুষরা সবসময় শেষ কথা বলেন। যে-ব্যবস্থা তঁারা দেশজুড়েই চালিয়ে থাকেন, যে-কারণে এখনও দেশে একজনমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু মহিলাদের রাজনীতির সিঁড়ি চড়তে দেওয়ার বিরুদ্ধে জেহাদটা হরিয়ানায় আরও গভীরে প্রোথিত। সেই ১৯৬৬ সাল থেকে মোটে ৮৭ জন মহিলা বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন এ-রাজে্য। প্রাক্তন সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সেলজা কুমারীর কথাই ভাবুন, কংগ্রেসের ক্ষমতার সমীকরণে তিনি প্রান্তিকই থেকে গিয়েছেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বর সঙ্গে তঁার যোগাযোগ সত্ত্বেও। অথবা প্রবল প্রতাপশালী কিরণ চৌধুরীর কথা চিন্তা করুন, তঁাকে কিনা এখনও বংশীলালের ‘বহু’ বা স্ত্রী হিসাবেই দেখা হয়, কিন্তু প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসাবে কখনওই নয়। এমনকী, প্রয়াত সুষমা স্বরাজ, যিনি কেন্দ্রে বিজেপির নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিনিধি হতে পারেন, কিন্তু নিজের রাজে্য শীর্ষে পৌঁছতে তঁাকে হাজারও বাধা সহ্য করতে হয়। সে সামাজিক অবস্থান হোক বা রাজনৈতিক– হরিয়ানার নারীরা পুরুষদের থেকে বহু ধাপ পিছিয়ে রয়েছে, তারা মেনে নিয়েছে গৃহকর্ত্রী হিসাবে তাদের ভূমিকা।
ঠিক সেই কারণেই ভিনেশ ফোগতের রাজনীতিতে অবতীর্ণ হওয়া আশার আলো দেখাচ্ছে, পালটে যাওয়ার বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে। কংগ্রেস হয়তো এখন ভিনেশের জনমোহিনী শক্তির উপর ভরসা রাখছে, কিন্তু ভিনেশের লোকনায়ককল্প দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণতার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে ইতিমধে্যই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, হরিয়ানার গরিমা আর তার রাজনৈতিক নেতারা নয়, বরং খেলোয়াড়রা। দেখুনই না, কী আত্মবিশ্বাস নিয়ে অলিম্পিকে জোড়া পদক পাওয়া বন্দুকবাজ মনু ভাকের একের-পর-এক সংস্থায় বিজ্ঞাপিত হয়ে চলেছেন! এই ঘটনাই প্রতিফলিত করে, কীভাবে প্রচলিত চেনা ছকগুলো ভাঙছে নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসা। ভিনেশ যদি ঝুলানা থেকে প্রথম মহিলা বিধায়ক হন, তাহলে তা আরও অনেককে উজ্জীবিত করবে দেওয়াল ভাঙতে, ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের আদর্শ হিসাবে গড়ে তুলতে। ভিনেশ হয়তো তঁার বহুকাঙ্ক্ষিত পদকটি পাননি, কিন্তু হরিয়ানার মানুষের হৃদয়ে নিজের স্থানটুকু পেয়ে গিয়েছেন তিনি। সোনার মূলে্যর থেকে তা কম কিছু নয়।
পুনশ্চ: ভিনেশের নিজের গ্রাম বালাইয়ের একটি কুস্তির আখড়ায় ভোর পঁাচটা থেকে চূড়ান্ত মহড়া দিয়ে চলেছেন তরুণী নেহা সাঙ্গোয়ান। একদিন না একদিন তঁার ভিনেশদিদিকে তিনি ছুঁয়ে ফেলবেন– দৃঢ় বিশ্বাস তঁার। ‘আমাদের পরের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন’– কোচ মন্ত্রণা দেন। আখড়ার ছেলেরাও নেহার দক্ষতা দেখে বাকরুদ্ধ। একখানা দর্শনীয় দৃশ্য বটে, যেমন দর্শনীয় ছিল এক পুরুষ সরপঞ্চের দ্বারা ভিনেশের সংবর্ধিত হওয়া।