তরুণকান্তি দাস: ”কৌটো নাড়িয়ে একের পর এক প্রাসাদোপম পার্টি অফিস গড়েছে আপনাদের সিপিএম৷ আর বিদেশের ভূরি ভূরি ডলার-পাউন্ড পেয়েও আমরা হেঁট মুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে থাকব না কি?” নেপালের ভক্তপুর রাজপ্রাসাদের গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে কথাটা শুনে চমকে উঠতেই হল৷ তবে এটাই শেষ চমক তো নয়৷ তবে?
গা হিম করা তথ্য হল, প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত লাগবে ভূমিকম্পে পথে বসা দেশটির পুনর্গঠনে৷ এবং এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি সাহায্য এসে গিয়েছে ডলারে৷ তবুও বাতাসে দীর্ঘনিঃশ্বাস৷ কোথাও মাথার উপর অস্থায়ী ছাদ, কোথাও এখনও তা অনিশ্চিত৷ তাই পথে প্রান্তরে সর্বহারাদের হাহাকার এবং তার সঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে ক্ষোভের বারুদ৷ যে বারুদে আগুনের ফুলকি দিতে তৎপর দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি৷ ফলে বিক্ষোভ যেন নিত্যসঙ্গী নেপালের৷ নিত্য কলকাতা-কাঠমাণ্ডু করা পর্যটন কর্তাটি যে কথা মজার ছলে বলছিলেন, ভক্তপুর দরবার স্কোয়ারের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেটাই যেন বারবার বিঁধছিল৷ পশ্চিমবঙ্গে কৌটো নাড়িয়ে একটি দলের টাকা তোলা যেমন এখন চর্চার বিষয়, তেমনই ভাঙা নেপালের দৈন্য দেখিয়ে সহানুভূতির স্রোতে ভেসে আসা দশ দেশের ডলার নিয়ে এখানেও রোজ নানা প্রচার ডালপালা মেলছে তো মেলছেই৷
সরকারিভাবে বলা হয়েছে পুরোপুরি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে পর্যটন নির্ভর দেশটির কমপক্ষে বছর আটেক সময় লাগবে৷ তা হলে কীসের জোরে বিভিন্ন পর্যটন সংস্থা ও পর্যটন মন্ত্রক দুই হাত বাড়িয়ে বলছে “আমরা প্রস্তুত৷ নেপাল আসুন৷” বলছে৷ কেন না এ ছাড়া উপায় নেই৷ এটা অর্থনৈতিক বাধ্য-বাধকতা৷ তিব্বতের সীমান্তে খুলে রাখা সাত সাতটি পথ দিয়ে অনর্গল ঢুকে আসা চিনা-স্রোত যে অর্থনীতিকে কাঁকড়াবিছের মতো আঁকড়ে ধরেছে৷ শুনতে অবাস্তব লাগলেও সত্যি৷ যে অর্থনীতিকে অক্সিজেন যোগাচ্ছে পানিট্যাঙ্কি, রক্সৌলের মতো ভারতীয় সীমান্ত৷ নেপাল অস্বীকার করলেও যা বাস্তব৷ কেমন?
কাঠমান্ডু থেকে ভক্তপুর ঘণ্টাখানেকের যাত্রাপথ৷ ভক্তপুরের রাজারা এখন বিদেশে৷ তবুও রাজভক্তির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি ঘরে ঘরে৷ আর দেশের রাজধানী থেকে প্রায় ৮ ঘণ্টা উজিয়ে পোখরা ঢুকলে এক্কেবারে উলটপুরাণ৷ রাজা নিয়ে কোনও আদলেখাপনা নেই৷ হতেই হবে৷ পোখরা লেক থেকে চওড়া রাস্তাটি যে গিয়ে মিশেছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাওবাদী নেতা প্রচণ্ডর গাঁয়ে৷ যিনি কয়েক বছর আগে ‘দড়ি ধরে মারো টান-রাজা হবে খানখান’-এ নেতৃত্ব দিয়ে উপড়ে ফেলেছিলেন নারায়ণহীতি প্রাসাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের শিকড়৷ আজ সেই দেশে কাঠমাণ্ডু, ভক্তপুর, পোখরা– সর্বত্র চিনের লোকজনের ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত৷ আরও মজার হল, নেপালে এখন বিদেশি ভাষা শিক্ষার রেওয়াজ বড্ড বেশি৷ বিদেশি ভাষা মানে অবশ্য বিশ্ব-পরিব্রাজক হিউ-এন-সাঙের মুখের কথা৷ চিনা ভাষা শিখতে হুমড়ি খাওয়া নেপালি ছেলেপুলের দল বলছে, “অধিকাংশ হোটেল তো ওরা লিজ নিয়ে চালাচ্ছে৷ ওদের পর্যটকও আসছে অতি মাত্রায়৷ সীমান্ত খুলে দিয়ে বাণিজ্যের নয়া পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা প্রতিবেশি দেশটির ভাষা না শিখলে তো পিছিয়ে পড়তে হবে৷”
আর ভারত? অনেকটা ছাই ফেলতে ভাঙা কুলোর মতো অবস্থা৷ নেপালের উঠতি যুবক-যুবতীরা ভারতকে পিঠ দেখিয়ে উঠে পড়ছেন মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনও দেশের বিমানে৷ ডলারে কামাই!
ডলার নিয়ে এখন বড্ড মাথাব্যথা নেপালের৷ একের পর এক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সংগ্রামে গ্রামের পর গ্রাম৷ বিধ্বস্ত কাঠমাণ্ডুর দরবার স্কোয়ার থেকে ভক্তপুর রাজপ্রাসাদ- সর্বত্র ডলারের প্রলেপে অভিশাপকে ভুলে এগিয়ে যাওয়ার মরিয়া প্রয়াস৷
হিন্দু-প্রধান এই রাষ্ট্রটিকে প্রকৃতির ছোবল দুমড়ে-মুচড়ে দিলেও বেঁচে গিয়েছেন পশুপতিনাথ৷ সামান্য দু’-একটি চিড় ছাড়া৷ এবং দেশের বিশ্বাস, গঙ্গার মতো নেপালের পবিত্র বাগমতী বয়ে যাবে পশুপতিনাথ ছুঁয়ে৷ শুকোবে না বাগমতী, তার স্পর্শে প্রাণ পাবে হিমালয়ের পাদদেশ৷
The post ডলার নিয়ে মাথাব্যথা, ছন্দে ফিরতে চায় নেপাল appeared first on Sangbad Pratidin.