বোরিয়া মজুমদার: ১৭ মার্চ ১৭ বছরের উজ্জ্বল কিশোরী ঋতিকা ফোগাট (Ritika Phogat) আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কয়েকটা নিউজ এজেন্সি আর কিছু ওয়েবসাইট ছাড়া মূলধারার কোনও গণমাধ্যম এই সংবাদটি নিয়ে তেমন হইচই করল না। ঘটনাটা মর্মান্তিক, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে বহুবার। তাই হয়তো আর গুরুত্ব দেয়নি। আমারও ঘটনাক্রমেই খবরটায় চোখ পড়ে আর সেই থেকেই আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও হতাশাগ্রস্ত।
যে ১৭ বছর বয়সি মেয়েটির আত্মহত্যা নিয়ে এত প্রশ্ন উঠছে, তাঁর কোনও আর্থিক উদ্বেগ ছিল না, শারীরিক কোনও প্রতিকূলতাও ছিল না। তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবান একজন খেলোয়াড়। সম্প্রতি তিনি কুস্তিতে একটি অনূর্ধ্ব-১৯ গ্রুপের প্রতিযোগিতায় রৌপ্যপদকও জিতেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, তাঁর জীবনে কোনও কিছুরই খামতি নেই, সবই ভাল চলছিল। তাহলে কেন এমন কঠিন পদক্ষেপ নিলেন তিনি? এত কমবয়সি একটি মেয়ে, যার জীবনে দৃশ্যত কোনও সমস্যা নেই–তিনি কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন? ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। এজন্যই আমি এই বিষয়টিতে আলোকপাত করতে চাইছি।
ঋতিকা বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ গীতা (Gita Phogat) এবং ববিতা ফোগাটের তুতো বোন, যাঁদের গল্প ইতিমধ্যেই ‘দঙ্গল’ ছবির মধ্য দিয়ে সেলুলয়েডের পর্দায় অমর হয়ে গিয়েছে। ঋতিকা তাঁর বিখ্যাত বোনদের মতোই একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী কুস্তিগির ছিলেন। কিংবদন্তি মহাবীর ফোগাট ছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক। আত্মহত্যা করার দিন দুয়েক আগেই ঋতিকা রাজস্থানের ভরতপুরে একটি কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ফাইনাল অবধি পৌঁছেও হেরে যান তিনি। পরাজয়ের কলঙ্ক মেনে নিতে অপারগ ঋতিকা নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরাজয় কখনওই জয়ের বিকল্প নয়, এই ভাবনা থেকেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: সৌরভ-জল্পনার অবসান]
তাঁর বোনেরা উচ্চ পদক এবং সম্মান অর্জনকারী, অথচ সেই ফোগাট বংশের মেয়ে হয়েও তিনি কী করে সামান্য গ্রুপ টুর্নামেন্টের ফাইনালে হেরে যেতে পারেন, এই প্রশ্নই হয়তো তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু খেলাধুলোয় জয়ের চেয়ে পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয় অনেক বেশিবার– তাঁর প্রতিচ্ছায়াবাদী মন এই শাশ্বত সত্য, এই সাধারণ বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। আর এই টানাপোড়েনেই একটি অল্পবয়সি মেয়েকে আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। কেউ বলার সুযোগ পর্যন্ত পেল না যে, ফাইনালে ওঠাও এক বিরাট কৃতিত্ব!
ঋতিকার উপর কি জেতার জন্য বাড়তি কোনও চাপ ছিল? হেরে যাওয়া আমাদের জীবনের অংশ, তা আমাদের প্রত্যেকের কাছেই অত্যন্ত স্বাভাবিক। শুধুমাত্র ফোগাট পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণেই কি তাঁর কাছে জয় ব্যতীত অন্য কোনও বিকল্প ছিল না? তাঁর প্রশিক্ষক, বাবা-মা কি তাঁকে খেলাধুলোয় হার-জিতের প্রাথমিক নীতি সম্পর্কে কখনও বোঝাননি? কেন তিনি জেতার বিষয়ে এতটা সংস্কারবদ্ধ ছিলেন, যার ফলে একবারের ব্যর্থতা তাঁকে একেবারে জীবন-সমাপ্তির দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করাল?
[আরও পড়ুন: বাংলায় জন্মেই শিশুর মাথায় ৫০ হাজার টাকার ঋণ]
আমরা কখনওই এই সমস্ত প্রশ্নের কোনও যথাযথ উত্তর পাব না। ঋতিকা ফোগাটের আত্মহত্যা বুঝিয়ে দেয়, সাফল্যের চূড়ায় থাকা তারকা পরিবার থেকে আসা তরুণ প্রজন্মের কাছে বাস্তবের পথ কতটা দুর্গম! কোথাও এমন কোনও অলিখিত নিয়ম নেই, যে, তাঁরা তাঁদের আগের প্রজন্মের মতোই সাফল্য অর্জনে সক্ষম হবেন। কিন্তু সমাজের তির্যক দৃষ্টি তাঁদের বারবার দাঁড় করায় কাঠগড়ায়। অর্জুন তেণ্ডুলকর (Arjun Tendulkor) তাঁরা বাবা শচীন তেণ্ডুলকরের মতো সফল খেলোয়াড় হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। কিন্তু তা’ বলে, তাঁর নিজস্ব কোনও পরিচয় থাকবে না– এমন ভাবা কাম্য নয়। ‘শচীন তেণ্ডুলকরের ছেলে’ তাঁর একমাত্র পরিচয় হতে পারে না। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ঋতিকার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় অর্জুনকেও কয়েক সপ্তাহ আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘৃণ্য ট্রোলিংয়ের শিকার হতে হয়েছিল।
ঋতিকার ঘটনা থেকে ট্রোলিংয়ের বিপজ্জনক দিক এবং তরুণ মনে তার প্রভাবের বিষয়টিও আমাদের সামনে উঠে আসে। ট্রোল যারা করে তাদের মধ্যে কেউ কি কখনও ভেবে দেখে যে, তাদের এই ধরনের কুরুচিকর ও জঘন্য মন্তব্য একজন ১৮-১৯ বছর বয়সের কিশোর বা কিশোরীর মনে কী প্রভাব ফেলতে পারে? নাম প্রকাশ না করে, পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থেকে, এই ট্রোল আমাদের সমাজকে বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সোশ্যাল মিডিয়া যুগের অন্যতম খারাপ দিক এটি, যেখানে কারও কোনও দায়বদ্ধতা অথবা স্বচ্ছতা নেই। আমরা জানি না, এই ব্যক্তিরা কারা, কিন্তু তবুও আমরা তাদের কাছে অপমানিত—মানসিকভাবে আহত হয়ে চলেছি দিনের পর দিন। অর্জুন তেণ্ডুলকর, রোহন গাভাসকর, সইফ আলি খান বা অভিষেক বচ্চন, প্রত্যেকে শক্ত মনের মানুষ বলেই তাঁরা ট্রোলিংয়ের মোকাবিলা করতে পেরেছেন। মনে হয়, তাঁরা এ বিষয়ে ততটাও চিন্তিত বা উদ্বিগ্ন নন। ঋতিকা ব্যতিক্রম ছিলেন বলেই আমরা তাঁকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম হয়তো। মানসিক আঘাত, সামাজিক চাপ, ‘পিয়ার প্রেশার’-এর ত্রিশঙ্কুর সঙ্গে যুঝে উঠতে না পেরেই শেষে মৃত্যুর কাছে মাথা নত করলেন তিনি। এত কিছুর পর তাই কিছু সতর্কতামূলক কথা না বললেই নয়। কারণ আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে। বাকস্বাধীনতা আছে বলে আমরা যা-ইচ্ছে-তাই অপমানজনক বা আপত্তিকর কথা বলার অধিকারপ্রাপ্ত নই। উসকানি ও অপমানের মধ্যে যে ক্ষীণ তফাতের রেখা রয়েছে, তা অপরিহার্য। আমাদের কর্তব্য, সেই রেখা যাতে অতিক্রম না হয়– সে বিষয়ে সতর্ক থাকা।
আইপিএলে (IPL) অর্জুনের খেলার সুযোগ পাওয়ার ঘটনা আমাদের কাউকে তাঁকে অপমান করার ছাড়পত্র দেয় না। আমরা নীতিপুলিশ নই! আমরা তরুণ প্রজন্মের উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে পারি না, যা তাদের ঋতিকার মতো কোনও চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। ঋতিকা সবার চোখে দুর্বল। সবাই বলবে, তিনি নির্বোধ বলেই এমন কাজ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কখনওই তাঁর মনের অবস্থা জানতে পারব না, কখনওই বুঝতে পারব না–জীবন শেষ করার
রাস্তা বেছে নেওয়ার সময় কতটা যন্ত্রণায় তিনি ছিলেন। হ্যাঁ, হয়তো নির্বোধ ছিলেন। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে নির্বোধ আর অজ্ঞ হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? আমরা প্রত্যেকে কি এই বয়সে কোনও না কোনও ভুল করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিইনি? আমরা কি যুক্তিহীন আচরণ করে পার পেয়ে যাইনি? ঋতিকা ফোগাট শুধু ফোগাট বংশের মেয়ে বলে, জীবনের প্রতিটি স্তরে তাঁর বোনদের সঙ্গে অদৃশ্য প্রতিযোগিতায় রত থাকতে হল বলেই কি তিনি বেঁচে থাকার দ্বিতীয় সুযোগটুকু পেলেন না? বিশ্বের সামনে তাঁকে নিজের জীবন দিয়ে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিতে হল?
সত্যি বলতে, প্রত্যেকের জেতার প্রয়োজনও নেই। খেলাধুলো আসলে সুস্থ প্রতিযোগিতা। খেলাধুলোর উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যবান থাকা, জীবনকে পূর্ণমাত্রায় উপভোগ করা, যা আজকাল আমরা আর করি না। অভিভাবক হিসাবে আমাদের এই শিক্ষাই পরবর্তী প্রজন্মকে দেওয়া উচিত। খুব অল্প বয়স থেকে সন্তানদের শেখাতে হবে যে, হার-জিত জীবনের অঙ্গ। জেতার খুশি যতটা উপভোগ করতে হবে, পরাজয়কেও ততটাই সহজ করে মেনে নিতে হবে। খেলায় দু’জনের মধ্যে একজন হেরে যাবেই। এর অর্থ এই নয় যে, সেখানেই পৃথিবী শেষ। ঋতিকার ক্ষেত্রে ঠিক তা-ই ঘটেছিল। সমাজের অঙ্গ হিসাবে আমরাও তাঁর পরিণতির সমান অংশীদার।