সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: লকডাউনের মাঝে পৃথিবীতে এসেছিল সে। আর লকডাউন শিথিলের পর স্বভূমি না ছুঁয়েই চলে যেতে হল। স্রেফ রাষ্ট্রের যান্ত্রিক নিয়মের কড়াকড়িতে। কেরলের কাহনগড় থেকে শ্রমিক স্পেশ্যাল ট্রেনে পুরুলিয়ার বাড়ি ফেরার পথে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে নিল মাত্র ১৮ দিনের মেয়ে। অসহায়ভাবে কোলের সন্তানের এভাবে বিদায় নেওয়ার দৃশ্য দেখতে হল মা, বাবা, কাকাকে। জনে জনে সাহায্য চেয়েও পাননি। আর সাহায্য না করেই বোধহয় বুঝিয়ে দেওয়া হল, বিভেদের বেড়াজালে আটকে যায় ‘পরিযায়ী’ শিশুও।
পুরুলিয়ার জয়পুর ব্লকের বালি গ্রামের বাসিন্দা দিলদার আনসারি গত ৬ বছর ধরে কেরলের কাসারগড়ে একটি ব্যাগের কারখানায় কাজ করতেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন ওখানে। বছর খানেক আগে দিলদারের ভাই সরফরাজও সেখানে গিয়ে ব্যাগের কারখানার কাজে যোগ দেন। ১৮ দিন আগে দিলদারের স্ত্রী রেশমা কাসারগড় সরকারি হাসপাতালে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। গোটা দেশের বন্দি দশায় আনসারি পরিবারে নতুন সদস্যের আবির্ভাব ভুলিয়ে দিয়েছিল অনেক কিছুই। লকডাউন শিথিল হওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে শ্রমিক স্পেশ্যাল ট্রেনে ফিরছিলেন দিলদার, রেশমা, সরফরাজরা। সোমবার রাত ১০টা নাগাদ ট্রেনে উঠেছিলেন তাঁরা। সব ঠিকই ছিল। মঙ্গলবার রাতে মেয়েকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার পর তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন রেশমাও।
একটু গভীর রাত, ঘড়িতে দেড়টা বাজে তখন, রেশমা মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে টের পান যে ১৮ দিনের শিশু ঠিক স্বাভাবিক নেই। তিনি দিলদার এবং সরফরাজকে ডেকে তোলেন। সরফরাজ তখনই রেলের হেল্পলাইন নং ১৩৯-এ ফোন করে সমস্যার কথা জানান, চিকিৎসার আবেদন করেন। তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় যে রেলের কিছু করার নেই। সব দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। অসহযোগিতা শুরু এখানেই। এরপর মাঝে বেশ কয়েকটা স্টেশন পেরিয়ে ওড়িশার বহরমপুর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে কোলে নিয়ে স্টেশনে নেমে রেল পুলিশের কাছে বারংবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন রেশমা, সরফরাজরা। কেউ কর্ণপাত করেনি। নিয়ম অনুযায়ী, শ্রমিক স্পেশ্যাল ট্রেন কোনও স্টেশনে দাঁড়ালেও শ্রমিকদের গন্তব্য ছাড়া নামার অনুমতি দেওয়া হয় না। এই নিয়ম দেখিয়ে ১৮ দিনের নিস্তেজ হয়ে আসা শিশুর চিকিৎসার আবেদনে সাড়া না দিয়ে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়। রাত আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে ১৮ দিনের শিশু ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ট্রেন তখন ওড়িশার বালাসোরের কাছে।
[আরও পড়ুন: বাড়তে চলেছে যাত্রীবাহী ট্রেনের সংখ্যা, এবার স্টেশনেই মিলবে মাস্ক-স্যানিটাইজার]
মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আজ দুপুর আড়াইটে নাগাদ খড়গপুরে নামেন দিলদার আনসারিরা। মাঝপথে কেউ কোনও সাহায্য করেনি – একফোঁটা জল অথবা একটু খাবার দিয়েও নয়। খড়গপুরে নামার পর বেদনা চেপে ক্ষোভ উগরে দিলেন সরফরাজ। বললেন, ”আমরা পরিযায়ী শ্রমিক তো, তাই কেউ সাহায্য করল না। আমাদের নামতে পর্যন্ত দেওয়া হল না। ওড়িশায় আরপিএফ একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে বাচ্চাটা বেঁচে যেত।” রেশমা বললেন, ”এক ঘণ্টা ধরে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য কতশত অনুরোধ জানালাম। রেল পুলিশকেও বললাম। কেউ আমার আবেদনে সাড়া দিল না। মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না।”
খড়গপুর স্টেশনে নামার পর তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তাঁরাই জল, খাবার দিয়ে পরিবারটিকে কিছুটা ধাতস্থ করে তোলেন। সংস্থার সদস্য তুষার অবস্তির কথায়, ”অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা। ওঁরা দুপুর আড়াইটে নাগাদ খড়গপুরে নেমেছে। অথচ রেল ওদের সামান্য জলটুকুও দেয়নি।” সংস্থার তরফে রেলমন্ত্রীকে টুইট করে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে।
[আরও পড়ুন: শিকেয় সামাজিক দূরত্ব! লঞ্চ পরিষেবা শুরুর দিনেই গায়ে গা ঘেঁষে অফিসমুখো যাত্রীরা]
এদিকে, পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের কাছে খবর পৌঁছনোর পর জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, ”এই পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারটির যাতে কোনও সমস্যা না হয়, আমরা দেখছি। ইতিমধ্যে খড়গপুরে অ্যাম্বুল্যান্স পাঠানো হয়েছে।” হয়ত স্বভূমে ফেরার পর এঁদের আর সত্যিই তেমন সংগ্রাম করতে হবে না। কিন্তু পরিযায়ী জীবনে সন্তানকে হারানোর ক্ষত মুছবে না কোনওদিন। মুছবে না পরিযায়ী হয়ে চূড়ান্ত অবজ্ঞা প্রাপ্তির কষ্টকর স্মৃতিও।
The post অমানবিক রেল, চিকিৎসার অভাবে কেরল থেকে বাংলায় ফেরার পথে মৃত ১৮ দিনের শিশু appeared first on Sangbad Pratidin.