shono
Advertisement

Breaking News

যুগযুগান্ত ধরে নারকীয় যন্ত্রণা সহ্য করেছেন যৌনদাসীরা, তাঁদের অভিজ্ঞতা আজও শিহরণ জাগায়

শুধু তালিবান জমানাই নয়, গোটা বিশ্বেই নারীকে যৌনদাসী করার বীভৎস নজির ছড়িয়ে রয়েছে।
Posted: 08:39 PM Sep 03, 2021Updated: 04:39 PM Sep 04, 2021

বিশ্বদীপ দে: ”যেদিন ৩০ জনের সঙ্গে শুতে হত, সেই দিনটা আমার জন্য ভাল দিন হিসেবেই ধরতাম।”

Advertisement

বছর তিরিশের স্যান্ড্রা এখনও শিউরে ওঠেন নিজের পুরনো দিনের কথা ভাবলে। মেক্সিকোর ১৯ বছরের তরুণীকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয় আমেরিকায়। রাতারাতি তিনি হয়ে ওঠেন যৌনদাসী (Sex Slave)। তাঁর ‘পিম্প’ অ্যালফ্রেডোর ইচ্ছানুসারে তাঁকে যেতে হত নানা জায়গায়। মেটাতে হত অসংখ্য পুরুষের খিদে। পিম্প অর্থে মালিক। যাঁর কাছে স্যান্ড্রা একজন ‘পোষ্য’ ছাড়া কিছু নন। খিদে পাক, তেষ্টা পাক ‘কাজের’ সময় সেসবের কোনও সুযোগ নেই। এমনও দিন গিয়েছে, খিদে-তেষ্টা চেপে রেখে টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে ৮০ জন পর্যন্ত পুরুষের লালসার শিকার হতে হয়েছে স্যান্ড্রাকে! সামান্য প্রতিবাদেই চলত অকথ্য মারধর। জুটত না খাওয়াদাওয়াও।  শেষ পর্যন্ত কীভাবে তিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন, সে গল্পও কম রোমাঞ্চকর নয়। কিন্তু পালিয়ে এসেও স্যান্ড্রাকে প্রতি মুহূর্তে যুঝতে হয় নিজের অতীতের সঙ্গে। যে অতীত থেকে মুক্তি পাওয়া যে কত দুর্মর, প্রতি মুহূর্তে তা অনুভব করেন তিনি।

স্যান্ড্রা এখনও আচ্ছন্ন ভয়ংকর অতীত নিয়ে।

ইংল্যান্ড থেকে মায়ের সঙ্গে গ্রিসে বেড়াতে এসেছিল ১৪ বছরের মেগান স্টিফেন্স। আর তারপর রাতারাতি প্রেমে পড়ে গিয়েছিল এক তরুণের। ছোট্ট মেয়েটির পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না প্রেমিকের বেশে ওই তরুণ আসলে কে। প্রেমের ফাঁদে পা দিতে গিয়ে এক চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়েছিল সে। কেমন ছিল যৌনদাসীর দিনগুলি? মেগানের কথায়, ”সমস্ত পরিচয় কে যেন চুরি করে নেয়। যতদিনে আপনি বুঝতে পারবেন ক্ষতিটা ঠিক কত বড়, ততদিনে আর কিছু হারানোর বাকি থাকে না।” স্বাভাবিক জীবনে ফিরলেও এখনও কথা বলতে গেলে আর্তনাদের মতো হয়ে ওঠে তার কণ্ঠস্বর। অন্ধকার রাতে স্মৃতির ভিতরে ফণা তোলে হিসহিসে পৌরুষের গনগনে দাপট।

[আরও পড়ুন: Afghanistan Crisis: আজ থেকেই আফগানিস্তানে শুরু অন্তর্দেশীয় যাত্রীবাহী বিমান পরিষেবা]

স্যান্ড্রা কিংবা মেগান। এমন রাশি রাশি নাম পাশাপাশি বসিয়েও এই তালিকা শেষ করা যাবে না। তাছাড়া কত নাম তো সামনেই আসে না। রাষ্টসংঘের হিসেব বলছে, সারা পৃথিবী জুড়ে যত মানুষ পাচার হয়ে যায় তাদের ৮০ শতাংশই আসলে যৌনদাসী হিসেবে পাচার হয়। অবশ্য কেবল যুবতী বা কিশোরী নয়। শিশু এমনকী পুরুষদেরও ব্যবহার করা হয় যৌনতার অনন্ত হাঁ মুখের ঝুলন্ত শিকার হিসেবে।

ফিরে এলেও স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন সহজ নয়।

গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখল করে ফেলে তালিবান (Taliban)। তারপর থেকেই আফগানিস্তানে (Afghanistan) ফের শুরু হয়েছে অন্ধকারের রাজত্ব। দখল করার আগে থেকেই অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছিল যৌনদাসীদের খোঁজ। এমনকী, কফিনের ভিতরে ঢুকিয়ে আফগান তরুণীদের পাচার করা হচ্ছে অন্য দেশেও। মুখে তালিবান যতই নারীকে সম্মান দেওয়ার কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত দু’দশক আগের সেই ভয়ংকর দিনগুলি যে ফিরবে এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত সকলে। আর সেই স্মৃতির হাত ধরেই ফিরে আসছে নারীর চরম অবমাননার দিনগুলি। তালিবান হোক কিংবা আইসিস, জঙ্গিদের কাছে নারী যে ‘বস্তু’ মাত্র তা এতদিনে প্রমাণিত। তাই অল্পবয়সি মেয়েদের উপরে যৌন নির্যাতন করে পরে তাদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া তাদের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যৌনদাসী কেবলই জঙ্গিদের অন্ধকার বৃত্তের অংশ তো নয়। লেখার শুরুতে হিমশৈলের চূড়া হিসেবে যে দু’জনের কথা বলা হল তাঁরা কিন্তু এই বৃত্তের বাইরে। আসলে এই চক্রান্তের ভয়াবহ জাল ছড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্বে। দেশকাল জুড়ে তাঁদের অসহায়তার আখ্যান।

যৌন ব্যবসাকে যে পৃথিবীর ‘আদিমতম ব্যবসা’ বলা হয় একথা সকলেরই জানা। দেহোপজীবিনীর মতোই যৌনদাসীও সেই আদিম ব্যবসারই অংশ। কিন্তু ফারাক আছে। দেহব্যবসাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত কি না এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১০৯টি দেশে এই ব্যবসা বেআইনি। কিন্তু ৭৭টি দেশে সেই পেশাকেই আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আবার থাইল্যান্ডের মতো দেশে কার্যত মধ্যম পন্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেহব্যবসার বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও যৌনদাসী বিষয়ে সকলেই একমত। এই ঘৃণ্য শব্দটিকে যে পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দেওয়া উচিত সেবিষয়ে সহমত সকলেই। এই নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। থাকতে পারেও কি?

[আরও পড়ুন: অকল্যান্ডের শপিং মলে আইসিস হামলা! ছুরি হাতে দাপিয়ে বেড়াল জঙ্গি]

নারীর এই অবমাননার সাক্ষী হাজার হাজার বছরের ইতিহাস।

ঠিক কত পুরনো এই যৌন দাসত্ব? রোজমেরি রেগেলোর ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়াল স্লেভারি’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, প্রাচীন গ্রিস ও রোমেও যৌনদাসীর প্রচলন ছিল। প্রথম থেকেই ‘মানবিকতা’ নামের শব্দটিকে দলে মুচড়ে তৈরি হয়েছিল ‘যৌনদাসী’ নামের শব্দটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রাচীন রোমের ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনটির কথা। যেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, কোনও ক্রীতদাসীকে যদি তার প্রভু ধর্ষণ করে, তবে তা আইনত কোনও অপরাধ হতেই পারে না! অর্থাৎ রাষ্ট্রই কার্যত স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছিল পুরো বিষয়টিকে।

পরবর্তী সময়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আফ্রিকার মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু কেবলই ভৃত্য, কৃষিকাজ কিংবা শ্রমিক হিসেবেই তাদের ‘ব্যবহার’ করা হত তা নয়। পুরুষদের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হত নারীদের। কারণ সহজেই বোধগম্য। সেই ক্রীতদাসীকে আসলে যৌনদাসী হয়ে প্রভুর ‘সেবা’ করতে হত। মুখ বুজে সইতে হত নিরন্তর অত্যাচার।

ইতিহাস এভাবেই পদে পদে বুনে রেখেছে লজ্জার জলছাপ। তবে যৌনদাসীদের কথা বলতে বসলে আলাদা করে বলতেই হয় জাপানের ‘কমফোর্ট উওমেন’-দের কথা। নাম থেকেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যায়। জাপানি সেনাকে তুষ্ট ও তৃপ্ত করতে কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস বা জাপানেরই হতভাগ্য মেয়েদের ধরে এনে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হত। অন্তত ২ লক্ষ নারীকে সেনার ‘বিনোদনে’র কাজে ব্যবহার হিসেব মিলেছে। সেই হিসেবে এটি বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম বৃহৎ মানব পাচারের ঘটনা।

তবে অনেক সময় চূড়ান্ত অসহায়তার মধ্যেই জেগে ওঠে প্রতিরোধেরও আগুন। আইসিস জঙ্গিনেতা আবু আনাসকে গুলি করে হত্যা করেন তারই এক যৌনদাসী। ইরাকের মসুলে আবু আনাস নামের ওই জঙ্গিকে মেরে তাঁর উপরে হওয়া ঘৃণ্য অত্যাচারের প্রতিশোধ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এমন উদাহরণ খুব বেশি নেই। আসলে দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকা ভয়ংকর অত্যাচার যেন মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিতে চায়। তবুও প্রতিরোধের শেষ শক্তিটুকু উজাড় করে বেরিয়ে আসতে চান তাঁরা।

নাদিয়ার কাহিনি উদ্বুদ্ধ করবে সমস্ত নির্যাতিত নারীকে।

শেষ করার সময় তাই নাদিয়া মুরাদের কথা। যৌনদাসী থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী হয়ে ওঠার রূপকথার কাহিনি যেন নরক থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে গিয়েছে। ‘দ্য লাস্ট গার্ল’ বইয়ে তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে ২০১৪ সালে আইসিস জঙ্গিরা তাঁর ছয় ভাই-সহ গ্রামের পুরুষদের খুন করে সমস্ত নারীকে অপহরণ করে। পরে নাদিয়াকে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কেনার জন্য পছন্দ করার প্রতীক হিসেবে পেটে দেওয়া হয় জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা! পরবর্তী সময়ে কোন ভয়ংকর দিন অপেক্ষা করে রয়েছে, ওইটুকুতেই ছিল তার তীব্র ইঙ্গিত। 

ইয়াজিদি এই নারী হার মানেননি। পালাবার চেষ্টা করে গণধর্ষিত হয়েছেন। তবু শেষ পর্যন্ত পালিয়ে আসতে পেরেছেন। যদিও ফিরে এসে দেখেছিলেন, তাঁর এতদিনের চিরচেনা গ্রামটাই আর নেই! সব এখন ধ্বংসস্তূপ। এরপর তিনি নিজেই তিলে তিলে নিজের জন্য গড়ে নিয়েছেন এক নতুন ভুবন। খুঁজে নিয়েছেন বেঁচে থাকার মানে। নাদিয়ার প্রত্যাবর্তন বুঝিয়ে দেয়, যৌনদাসীর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের পুরনো হতে পারে। একলা নারীর রুখে দাঁড়ানোর, খাদের ধার থেকে ফিরে আসা গল্পও ইতিহাসের পাতায় এক দীর্ঘ অনতিক্রম্য অধ্যায়ের অংশ। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ উপন্যাসের সেই চিরকালীন সংলাপ মনে পড়ে। ‘এ ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড’। মানুষ ধ্বংস হতে পারে, হার মানতে পারে না। অসহায় এই সব মানুষদের ফিরে আসার গল্প যেন সেই কথাকে নতুন করে সত্যি বলে প্রমাণ করে। প্রমাণ করে, ধ্বংসস্তূপের আগাছাতেও ফুল ফোটে। তারা সূর্যের আলোয় হেসে ওঠে অন্য যে কোনও ফুলের মতোই। 

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement