বিশ্বদীপ দে: আবারও ফিরে এলেন তিনি। টিএন সেশন (T. N. Seshan)। মৃত্যুর বছর দেড়েক পরেও যে তিনি একই রকম প্রয়োজনীয় ও সমসময়ের রাজনীতিতে একই রকমের অনতিক্রম্য রয়ে গিয়েছেন তা ফের স্পষ্ট হয়ে উঠল গত বৃহস্পতিবার। কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, কোভিড (COVID-19) পরিস্থিতিতে বাংলায় বিধানসভা ভোটের ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখাতে দেখা যাচ্ছে না নির্বাচন কমিশনকে (Election Commission)। আর সেপ্রসঙ্গেই হাই কোর্টের তোপ, টিএন সেশনকে সম্ভবত ভুলে গিয়েছে কমিশন। প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের কাজের ১০ শতাংশও বোধহয় বর্তমান কমিশন করে দেখাতে পারবে না। এই ভর্ৎসনার সংবাদই ফের বহু ভারতীয়র মনে উসকে দিয়ে গেল এক প্রবীণ মানুষের স্মৃতি। আজকের প্রজন্ম যারা হয়তো তাঁর নামটুকুই কেবল শুনেছে, সম্ভবত তারাও জানে মিথ হয়ে যাওয়া সেই সংলাপের কথা, ‘‘আই ইট পলিটিশিয়ান ফর ব্রেকফাস্ট।’’ আমি রাজনীতিবিদদের দিয়ে প্রাতরাশ সারি। হ্যাঁ, সেই টিএন সেশন। আজও স্বমহিমায় যিনি বিরাজমান ভারতীয় রাজনীতির রঙিন চালচিত্রে।
কে ছিলেন এই টিএন সেশন? সেই কবে ১৯৯৬ সালে যিনি মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে সরে গিয়েছিলেন, কেন আজও তিনি প্রাসঙ্গিক রয়ে গিয়েছেন? এমন ‘আইকন’ হয়ে ওঠার পিছনে রয়েছে সাফল্যের কোন খতিয়ান? সেকথা বলতে গেলে একটু পিছন থেকে শুরু করাই শ্রেয়।
১৯৫০ সালে সদ্য স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার হন সুকুমার সেন। সেই শুরু। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এতজন নির্বাচন কমিশনার এলেও কেউই সেশনের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে আসতে পারেননি। ১৯৯০ সালে দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হন দোর্দণ্ডপ্রতাপ তিরুনেল্লাই নারায়ণ আইয়ার শেষন। প্রশাসনিক হিসেবে তাঁর কেরিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল নিঃসন্দেহে ওটাই। মাত্র ৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। আর তাতেই কালঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন রাজনীতিকদের। কার্যতই হয়ে উঠেছিলেন ত্রাস। অনেকেরই দাবি, তিনি ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচন কমিশনার ছিল কেবল মাত্র একটি পদ। কমিশনের কাজ ছিল নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা। হ্যাঁ, নির্বাচনী বিধি প্রকাশও করা হত। কিন্তু সেশনই প্রথম সেই বিধিপালন নিয়ে চরম কড়াকড়ি শুরু করেছিলেন। বলা হত, রাজনীতিকরা স্রেফ দু’জনকে ভয় পান। ঈশ্বর ও টিএন সেশন।
[আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় এবার আসরে বায়ুসেনা, অক্সিজেন সরবরাহে নামল মালবাহী বিমান]
এমন প্রবাদ তৈরি হওয়া সহজ ছিল না। সকলেই জানে, দুঁদে রাজনীতিকদের সঙ্গে টক্কর নেওয়া মুখের কথা নয়। কিন্তু সেশন ছিলেন কার্যতই একজন ‘টাফ গাই’। কেবল নির্বাচন কমিশনার হিসেবেই নয়, আজীবন প্রশাসনিক দক্ষতা দেখিয়ে গিয়েছেন। যার জন্য পেয়েছিলেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারও। যখন যে দায়িত্ব পেয়েছেন মন দিয়ে পালন করে গিয়েছেন। ভাবা যায়, রাজীব গান্ধী (Rajiv Gandhi) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন একবার তাঁর মুখ থেকে বিস্কুট ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি! হতভম্ব রাজীবকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, একজন প্রধানমন্ত্রীর কখনওই এমন কোনও খাবার খাওয়া উচিত নয়, যা আগে থেকে পরখ করে রাখা হয়নি। সেই সময় তিনি ছিলেন সুরক্ষা সচিব। বলা হয়, নিজের পদের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ। একবার ১৫ আগস্ট অনেকের সঙ্গে ট্র্যাকস্যুট পরে বিজয় চক থেকে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত দৌড়নোর পরিকল্পনা করেছিলেন রাজীব গান্ধী। দৌড় শুরুর আগে তিনি দেখলেন খানিক দূরে রীতিমতো গলাবন্ধ কোট-টাই পরে সেশন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রসিকতা করে রাজীব বলেন, ‘‘আপনি আবার এর মধ্যে স্যুট-বুট পরে কী করছেন? আসুন আমাদের সঙ্গে দৌড়ন। আপনার ওজনও খানিক কমবে।’’ সেশন তৎক্ষণাৎ জবাব দেন, ‘‘কোনও কোনও লোককে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, যাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী দৌড়তে পারেন।’’
এমনই ছিলেন তিনি। সপাট, সোজা, অব্যর্থ। নিজের কাজে আপ্রাণ মশগুল। শোনা যায়, প্রবল ধর্মপ্রাণ ছিলেন। অথচ নির্বাচন কমিশনার হয়েই নিজের নতুন চেম্বার থেকে সরিয়ে ফেলেছিলেন সমস্ত দেবদেবীর মূর্তি। সম্ভবত এই ভাবেই তৈরি করে নিচ্ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হয়ে ওঠার ‘মাইন্ডসেট’। দায়িত্ব নেওয়ার পরের বছর হঠাৎ গোটা দেশ শোকস্তব্ধ হয়ে রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের অভিঘাতে। সেই সময় কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই সেশন নির্বাচন স্থগিত করে দেন। এই পদক্ষেপই বুঝিয়ে দিয়েছিল দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে এমন একজনের আবির্ভাব ঘটেছে, যিনি নিজের কাজটা অত্যন্ত ভাল জানেন। আর সেজন্য অন্যের মুখাপেক্ষী থাকার প্রয়োজন হয় না তাঁর। কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কোনও প্রভাবশালী রাজনীতিকের সঙ্গে আলোচনা না করেই তিনি সিদ্ধান্ত নিতে জানেন।
[আরও পড়ুন: করোনা চিকিৎসায় জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগ করা যাবে ‘ভিরাফিন’, ছাড়পত্র দিল DCGI]
কেমন ছিল সেশনের কার্যকাল? আগেই বলেছি রাজনীতিবিদদের রীতিমতো আতঙ্কিত করে রেখেছিলেন তিনি। শ্যেন দৃষ্টিতে নজর রাখতেন নির্বাচনের প্রার্থীদের দিকে। টাকা কিংবা মদের বোতল দিয়ে ভোটারদের ‘কিনে’ নেওয়া হোক কিংবা বিনা অনুমতিতে তীব্র স্বরে লাউড স্পিকার বাজিয়ে ভোটের প্রচার- এসব বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। ধর্মস্থানে ভোটের প্রচার, সরকারি জিনিসপত্র ভোটপ্রচারে ব্যবহার করা এসব বন্ধ করার দিকে ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। কেবল কাগজে লেখা নির্বাচনী বিধিনিষেধ নয়, তাকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি করে তোলাই ছিল প্রশাসনিক হিসেবে তাঁর ‘পাখির চোখ’। বলাই বাহুল্য অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন তিনি। আরও ভাল ভাবে বললে, রাজনৈতিক দলগুলো সেই প্রথম টের পেল নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ঠিক কতটা। এবং সচিত্র পরিচয়পত্র। তথা ভোটার কার্ড। কার্যত আরেক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে এটা ছিল সেশনের এক মাস্টারস্ট্রোক।
স্বাভাবিক ভাবেই এমন পদক্ষেপকে ভাল ভাবে নেননি অনেকেই। আক্রমণ শানিয়েছেন তাঁর প্রতি। অভিযোগ এনেছেন, এত বেশি কড়াকড়িতে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। এতেই শেষ নয়। আক্রমণ ছাড়িয়েছে শালীনতার গণ্ডিও। শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন এক মুখ্যমন্ত্রী নাকি সেশনকে ‘পাগল’ পর্যন্ত বলে কটাক্ষ করেছিলেন। আবার অনেকে ব্যাঙ্গ করে বলতে শুরু করলেন, ‘‘সেশন বনাম নেশন’’। তবে যে যাই বলুক, এক ব্যক্তি কীভাবে নিজস্ব দক্ষতায় একটি প্রতিষ্ঠানকে অভূতপূর্ব উচ্চতায় তুলে নিয়ে যেতে পারেন তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল ওই ৬ বছরেই।
এমনটাই ছিলেন টিএন সেশন। বিখ্যাত বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইনকে দিব্যি ব্যবহার করা যায় তাঁর নামের সঙ্গে। ‘সির্ফ নাম হি কাফি হ্যায়’। রাজনীতির ময়দানে পা রেখেছিলেন একবার। কিন্তু গুজরাটের গান্ধীনগরে লালকৃষ্ণ আডবানির কাছে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে হেরে গিয়ে হয়তো বুঝেছিলেন, সব কিছু সকলের জন্য নয়। তবে সেই পরাজয়ে সেশনের দ্যুতি ফুরোয়নি। ১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে কেরলের তিরুনেল্লাইয়ে জন্মানো মানুষটির শেষ জীবন কেটেছিল একাকী। নিঃসন্তান সেশন ও তাঁর স্ত্রী চলে গিয়েছিলেন বৃদ্ধাশ্রমেই। সেখানে তাঁর প্রয়াণ হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। কিন্তু সে তো জাগতিক মৃত্যু। কর্মযোগী মানুষটির কাজের শক্তি আজও অনুভূত হয়। যখন বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে ভর্ৎসনার সময়ও আদালতকে তুলে আনতে হয় তাঁরই উদাহরণ, তখন পরিষ্কার হয়ে যায় টিএন সেশন আজও আছেন। রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে না হোক, ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি এমন এক নক্ষত্র যাঁর আলো এখনও একই রকম উজ্জ্বল থেকে গিয়েছে।