সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: 'কাল দুর্গাপুজো আরম্ভ হবে, আজ তার সুন্দর সূচনা হয়েছে। ঘরে ঘরে সমস্ত দেশের লোকের মনে যখন একটা আনন্দের হিল্লোল প্রকাশিত হচ্ছে তখন তাদের সঙ্গে সামাজিক বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে।' উনবিংশ শতকের একদম শেষদিকে একটি চিঠিতে এমনই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। 'ছিন্ন পত্রাবলী'তে রয়েছে শিলাইদহ থেকে ভাইঝি ইন্দিরার উদ্দেশে লেখা এই পত্রটি। ব্রাহ্ম ঠাকুর পরিবারের সন্তান হলেও বঙ্গদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসবের আবেদন স্পর্শ করত রবীন্দ্রনাথের মনও। তবে সেকথায় যাওয়ার আগে একবার ঠাকুর পরিবারের দুর্গাপুজোর ইতিহাসটা ফিরে দেখা দরকার।
১৭৮৪ সালে দুর্গাপুজো শুরু হয় ঠাকুরবাড়িতে। ততদিন পর্যন্ত পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুজোই পরিচিত ছিল ঠাকুর পরিবারের পুজো হিসেবে। কিন্তু ওই বছর থেকে নীলমণি ঠাকুর জোড়াসাঁকোয় প্রথমবার দুর্গাপুজো করলেন। যদিও ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো শহরের সকলকে তাক লাগিয়ে দেয় প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে। সে এক এলাহি আয়োজন। জানা যায়, দর্পনারায়ণের পুজোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল। তাই ক্রমেই জাঁকজমক বাড়তে থাকে জোড়াসাঁকোর দুর্গাপুজোর। বলতে গেলে গোটা কলকাতার পুজোর ‘নিউক্লিয়াস’ হয়ে ওঠে ওই পুজো। আড়ম্বর-আয়োজনে তা তাক লাগিয়ে দিত। অথচ দেবেন্দ্রনাথের আমলে বন্ধই হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের পরিবারের দশভুজার আরাধনা। তখনও জন্ম হয়নি তাঁর।
কিন্তু পুজো বন্ধ হলেও নতুন পোশাক কিংবা পার্বণী মিলত। বিজয়ায় পরস্পরকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনের পাশাপাশি বিরাট করে আয়োজন হত বিজয়া সম্মিলনীর। জন্ম থেকেই পুজোর সময় ঠাকুরদালান শূন্যই দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবু আকাশের নীলে ভাসমান সাদা মেঘের সৌন্দর্য কবির হৃদয়কে ভরিয়ে তুলত। চারপাশের মানুষের উৎসবমুখীনতাকে তিনি লক্ষ করতেন মন দিয়ে। ইন্দিরাকে লেখা যে চিঠির কথা শুরুতেই বলা হয়েছে, সেখানেই তিনি লিখছেন, '... দেশের ছেলেবুড়ো সকলেই হঠাৎ দিন কতকের মতো ছেলেমানুষ হয়ে উঠে সবাই মিলে একটা বড়ো গোছের পুতুল-খেলায় প্রবৃত্ত হয়েছে।' কিন্তু এর পরই তিনি লিখছেন, 'সমস্ত বাংলাদেশের লোক যাকে উপলক্ষ্য করে আনন্দে ভক্তিতে প্লাবিত হয়ে উঠেছে, তাকে মাটির পুতুল বলে যদি দেখি তবে তাতে কেবল আমারই ভাবের অভাব প্রকাশ পায়।'
দুর্গাপুজোর এই সামাজিক আবেদন ভাবিয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। 'পূজার সাজ' কবিতার শুরুতে রয়েছে 'আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,/ পূজার সময় এল কাছে।' অথচ পুজোয় নতুন জামা পরতে চেয়ে দুই ভাই মধু ও বিধুর আকুলতা মনকে বিহ্বল করে। বিধু বাবার এনে দেওয়া ছিটের জামা, ধুতি , চাদরে আহ্লাদিত। কিন্তু মধুর তাতে মন ভরে না। সে গ্রামের ধনী রায়মশাইয়ের ছেলে গুপির শাটিনের জামা চেয়ে পরে। পুজোর প্রেক্ষাপটে দুই ভাইয়ের দুরকম মনের ছবি এঁকেছিলেন কবি। আবার 'কাঙালিনী' কবিতায় 'শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে' ভাবে 'মা গো এ কেমন ধারা।/ ... তুই যদি আমার জননী,/ মোর কেন মলিন বসন!'
পুজোর আনন্দের মধ্যে এই যে হর্ষ-বিষাদের হাত ধরাধরি করে চলা তা রবীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছেন। তবে তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে প্রকৃতি। সমস্ত জীবন ধরে মানবজীবনের সমান্তরালে প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে অনুভব করেছেন তিনি। শরতও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্ষণে সিক্ত শ্যামলা বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস কীভাবে শরতে উৎসবের আলোয় ঝলমল করে উঠেছে তা দেখে তিনি লিখছেন, 'শরতে আজ কোন অতিথি/ এল প্রাণের দ্বারে।/ আনন্দ-গান গা রে হৃদয়/ আনন্দ গান গা রে।' তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসেও রয়েছে পুজোর উল্লেখ। 'ঘরে বাইরে'র কথা এপ্রসঙ্গে বলাই যায়। বিমলা বলেছিল, 'আমি দেশের এমন একটি প্রত্যক্ষ রূপ চাই যাকে আমি মা বলব, দেবী বলব, দুর্গা বলব...' রবীন্দ্রনাথের একটি নাটকের নামই 'শারদোৎসব'। 'শরৎ' নামে রয়েছে প্রবন্ধও। এমন বহু উদাহরণই দেওয়া যায়। তবে এর পাশাপাশি চিঠিপত্রে যখন তিনি এপ্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন তখন সেদিকে আলাদা দৃষ্টি যায়ই। লেডি রানু মুখোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখছেন, '... কাশের গুচ্ছ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে বাতাসে মাথা নত করে পথিকদের শারদসংগীত শুনিয়ে দিচ্ছে।... উৎসবের আনন্দ-হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। অন্তরে বাইরে ছুটি ছুটি ছুটি- এই রব উঠেছে।'
এভাবেই লেখায়, হৃদয়ে, চেতনায় শরতের এই উৎসবমুখর সময়কে অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ঠাকুরদা দ্বারকানাথের আমলের দুর্গাপুজোর জৌলুস দেখা হয়নি তাঁর। দেখলেও তাঁর কাছে সেই জৌলুসকে যে ছাপিয়ে যেত উৎসবের দিনে মানুষের হৃদয়ের অমল আলো, তাতে সন্দেহ নেই। সমস্ত জীবন ধরে প্রকৃতি ও মানুষের যে সম্পর্ককে তিনি খুঁজে বেরিয়েছেন সেটাই পুজোর দিনেও খুঁজেছেন তিনি। এভাবেই নিজের মতো করে রচনা করেছেন তাঁর নিজস্ব শারদোৎসবকে।