চারুবাক: অভিজিৎ গুহ-সুদেষ্ণা রায় ছবির এতদিন বেঞ্চমার্ক ছিল হালকা কমেডির ছোঁয়ায় চলতি জীবনের কথা দেখানো-শোনানো। এই প্রথম তাঁরা কমেডি সরিয়ে শুধু জীবনের কথা, জীবনের জটিলতার কথা, নিম্ন মধ্যবিত্তের দারিদ্র্যের অহংকারের কথা, সফল একজন পেশাদার ডাক্তারের শ্রেণী বদলের অন্তর্দ্বন্দের কথা, স্বামী-স্ত্রী’র মান-অভিমান ভুল বোঝাবুঝির কথা দেখালেন ও শোনালেন। আর সেই সঙ্গে যোগ হল একজন স্মৃতিভ্রংশ বয়স্ক মানুষের ভালবাসার আনন্দ-যন্ত্রণার পাশাপাশি বয়সে অনেক ছোট তার তরুণী স্ত্রীর সহমর্মিতা, প্রেম ও এক অনন্য সাধারণ আত্মত্যাগের গল্পও।
কাহিনীকার নভেন্দু সেন যে ‘বীজ’ চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্তর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যেখানে কমেডি কোনও স্থানই ছিল না। অতীত ও বর্তমান বাস্তব জীবনের ছোট ছোট কোলাজ দিয়ে পুরো ছবিটা সাজিয়েছেন তিনি। যেখানে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, সাংসারিক ঝুটঝামেলার সঙ্গে ব্যক্তিগত মান-অভিমান ও অন্তর্লীন ভালবাসাও জায়গা করে নেয়। ডাক্তারি পেশা এখন ‘বনফুলের ডাক্তারি’ নেই। ডাক্তারি এখন সেবার চাইতে ‘ব্যবসা’ বেশি, তা মেনে নিয়েও তরুণ নায়ক নীলাভ (পরমব্রত) রায় তাঁর পেশাদারি দায়িত্ব যেমন পালন করে, তেমনি ছোটবেলার ফুটবল খেলার বন্ধু সুব্রতর (পদ্মনাভ) পিসিমার চিকিৎসায় আর্থিক সাহায্যও করে। শিক্ষক বাবার দারিদ্র্য বিলাপের সমালোচনা করেও তাঁর প্রতি অসম্মান দেখায় না। এটা তাঁর শিষ্টাচার যার প্রমাণ দেখি বিচ্ছেদোন্মুখ স্ত্রী পৃথাকে (বাসবদত্তা) একাধিকবার লিফট অফার করায়। আবার হাসপাতালে চিকিৎসায় আসা অ্যালঝাইমার রোগী অধ্যাপক অমিতাভ সরকারের প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল তেমনি তাঁর স্ত্রী শুভার প্রতিও সমবেদনা-সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয় কর্পোরেট হাসপাতালের দায়িত্বের তোয়াক্কা না করে। রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার ব্যাপারটা দেখে অবশ্য মনে হয় এই অধ্যাপকই কি নীলাভর একমাত্র রোগী, আর কোনও পেশেন্ট নেই? পুরনো বন্ধুর বাড়িতে এসে অতীতকে ফিরিয়ে আনা বা শিকড় ভুলতে না পারার ইঙ্গিতটা সুন্দরভাবে রাখা হয়েছে। আর অ্যালঝাইমার আক্রান্ত স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শুভার ‘আত্মত্যাগ’ পর্বটি একটু রহস্যই থাক! ওটা বরং হলে গিয়ে দেখাই ভাল।
[আরও পড়ুন: নিজভূমে পরবাসী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের যন্ত্রণার ছবি, কেমন হল বিধু বিনোদের ‘শিকারা’? ]
অভিজিৎ-সুদেষ্ণা জুটি তাঁদের ঘরানার বাইরে গিয়ে প্রমাণ করলেন সিরিয়াস বিষয় নিয়েও তাঁরা মনছোঁয়া ছবি বানাতে পারেন, এই ধারণাটি বজায় থাক না! নকশাল আন্দোলনের রেফারেন্স, গৌরীলঙ্কেশের হত্যার কথার সঙ্গে ছবিতে জড়িয়ে আছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দের কবিতাও। জয়িতার গাওয়া ‘শ্রাবণের ধারা’র মতো পড়ুক ঝরে গানটিও চমৎকার অনুষঙ্গে ব্যবহৃত। প্রভাতেন্দু মন্ডলের ক্যামেরা ঝকঝকে তকতকে। আর শিল্পীদের অভিনয়! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কোনও বিশেষণ প্রয়োগ এখন আর অতিরিক্ত নয়। যে কোনও ফ্রেমে তাঁর উপস্থিতিই দর্শকের চোখ টেনে নেয় ব্লটিং পেপারের মতো। শুভা হয়ে গার্গী রায়চৌধুরি খুবই সংযত ও আবেদনপূর্ণ। নীলাভর চরিত্রে পরমব্রত আবারও বুঝিয়ে দিলেন যে টানাপোড়েন দেখাতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনছোঁয়া বাস্তবকে ব্যবহার করেন। ছোট্ট ছোট্ট চরিত্রে দামিনী বসু, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, বিমল চক্রবর্তী এবং পৃথার ভূমিকায় বাসবদত্তা সুন্দর কাজ করছেন।
[আরও পড়ুন: সম্পর্কের জটিলতা ও মানবিক অনুভূতির ছবি ‘অব্যক্ত’]
The post হৃদয় ছোঁয়া ছবি অভিজিৎ-সুদেষ্ণার ‘শ্রাবণের ধারা’ appeared first on Sangbad Pratidin.