‘দ্বিচারিতা আমাদের রক্তে’- সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে ‘শ্রীস্বপনকুমারের বাদামী হায়নার কবলে’। ‘দীপক চ্যাটার্জী’ রূপে আবির্ভাবের আগে অকপট কথোপকথনে আবির চট্টোপাধ্যায়। মুখোমুখি বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
‘ব্যোমকেশ’, ‘ফেলুদা’, ‘সোনাদা’র পর এবার ‘দীপক চ্যাটার্জী’- বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা-ফিল্মে চরিত্রায়ণ মানেই আবির চট্টোপাধ্যায়। এটা কেন হয়?
– এটার উত্তর আমি ছবির পরিচালক দেবালয়ের কথা টেনে বলছি, দেবালয় বলেছিল, ‘যেহেতু সর্বজনগৃহীত, এলিট গোয়েন্দা চরিত্রে আবির অভিনয় করেছে, তাই যখন আমি স্রোতের বিপরীতে হাঁটছি, আমি ওকেই কাস্ট করতে চাই। যেহেতু আবির রিপ্রেজেন্টস দ্যাট ক্লাসিক বাঙালি গোয়েন্দা, নিয়ম ভাঙার সময়, প্রশ্ন তোলার সময় আমি ওকেই হাতিয়ার করতে চাই।’ আর সত্যি বলো তো, যে গোয়েন্দা নামগুলো উচ্চারিত হয়, তার সঙ্গে স্বপনকুমার রচিত ‘দীপক চ্যাটার্জী’র নাম আসে কি? বাংলা সাহিত্যে স্বপনকুমারের জনপ্রিয়তা ছিল, তবু বুক সেলফ-এ তাঁর বই নেই কেন? এই উত্তর খোঁজার জন্যই এই ছবি।
ছবিটা যখন অফার করা হয় তখন আপনার রিঅ্যাকশন কী ছিল?
– ‘বিদায় ব্যোমকেশ’-এর সময় যা রিঅ্যাকশন ছিল, এখানেও তাই। শিওর এটা নিয়ে ছবি করতে চান? তারপর আমি স্ক্রিপ্ট শুনি। আমার কিছু মতামত ছিল। সেগুলো রাখা হয়। এই ধরনের ছবি করতে গেলে যে পরিকাঠামো, সময় লাগে, সেটা কি দেওয়া হবে, এই প্রশ্নটাও আমার ছিল। সবটা হয়তো সম্ভব নয়। এবং তাই হয়েছে কাজ করতে গিয়ে। ওয়েদার আমাদের কন্ট্রোলে ছিল না। যা ভয় পেয়েছিলাম, তা সবই ঘটেছে (হাসি)। এমন অনেক জায়গায় শুট করেছি যেখানে কোনওদিন শুটিং হয়নি। নানা গোলযোগের মধ্যে আমার আর দেবালয়ের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। কথা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর আবার কাজ শুরু হয়। এই ঝগড়ার সবটাই ক্রিয়েটিভ মতভেদ। এমনিতে কোনও ঝগড়া নেই। এবং আমি দেবালয়কে ধন্যবাদ দিতে চাই, কারণ ক্রিয়েটিভ পাগলামিটা বজায় রেখেছে। ও এখনও আউট অফ দ্য বক্স ভাবনা নিয়ে কাজ করতে চায়, সেটা এই আমাদের মতো বয়সে এসে অনেক সময়ই নিভে যায়।
আপনি দেবালয়ের পাগলামিতে সায় দিলেন কেন? ‘দীপক চ্যাটার্জী’ হতে রাজি হলেন কেন?
– চ্যালেঞ্জ এবং রিস্ক তো বটেই। ‘স্বপনকুমার’ এবং ‘দীপক চ্যাটার্জী’ জনপ্রিয় হলেও পপুলার কালচারে নেই। তাই একটা রিস্ক তো থাকবেই। এই রিস্ক এবং চ্যালেঞ্জটা নিতে রাজি হয়েছিলাম কারণ দীপকের যে অনুভূতি, দীপকের যে প্রশ্ন, যে আলোয় দীপককে দেবালয় দেখেছে– সেটার সঙ্গে আমি নিজেকে আইডেনটিফাই করতে পারি। এই প্রশ্নগুলো আমারও প্রশ্ন। ‘বাদামী হায়নার কবলে’– এই গল্পটা তো স্বপনকুমারের নয়। বরং লেখকের রচিত পৃথিবী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিচালকের নিজস্ব ভিশন থেকে লেখা। আমি সেটাকেই ফলো করেছি। আমি নিজে ‘দীপক চ্যাটার্জী’ পড়িনি। কিন্তু এই গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে নিজের মতো পড়াশোনা করেছি।
সেটা কি এই ছবির জন্য?
– ব্যোমকেশের সময় পড়েছিলাম, তারপর নিজের উৎসাহ থেকে পড়েছি।
তার মানে আবির চট্টোপাধ্যায় বটতলার বই পড়েনি?
– আমি অন্য বটতলার বই পড়েছি। এটা পড়িনি (হাসি)।
ছবির ট্রেলার দেখে মনে হল, বাঙালির গোয়েন্দা জগৎ নিয়ে উপহাস করা হয়েছে!
– উপহাস তো আছেই। সেলফ মকারিও আছে। বরং সেটা করে মজাও পেয়েছি। একদিকে ভালো, নিজেকে যত খুশি গাল দাও। অন্যকে নিয়ে কিছু বললেই তো মুশকিল। আর সিনেমা, সাহিত্য তো সমাজের বাইরে নয়। সমাজে দ্বিচারিতা আমাদের রক্তে। আমাদের অনেক কিছু ভালো লাগে, অনেক কিছু এনজয় করি, কিন্তু মুখে স্বীকার করতে পারি না। সব কিছু পরিশীলিত রাখতে হবে। এই দ্বিচারিতা বাঙালির স্বভাব।
সেটা ভাঙবে ‘বাদামী হায়নার কবলে’?
– ভাঙবে কি না জানি না, কিন্তু দেবালয় সেই প্রশ্নটা তুলেছে। আমারও সেই প্রশ্নটা আছে।
‘স্বপনকুমার’-এর পাল্প ফিকশনের পৃথিবী এই ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে কতটা প্রাসঙ্গিক?
– সমকালীন সময়ের ছাপও রয়েছে, পুরনো সময়ের ছায়াও আছে। যাঁরা স্বপনকুমার পড়েছেন তাঁদের জন্য একটা নস্টালজিয়াও কাজ করবে। নস্টালজিয়ার বাইরে আর কী আছে? অস্ত্র বললে অস্ত্র, দুর্বলতা বললে দুর্বলতা। এর বাইরে আর কিচ্ছু নেই। দেবালয় বলেছে, ‘এখন আমি সেফ, এটা এখন নস্টালজিয়া হয়ে গিয়েছে’। আগে খুব আনসেফ ছিল। আর যাঁরা নতুন, তাঁরা নতুন ধরনের কাজ দেখতে চান। এত কিছু বললাম বটে, এরপরও অনেকে জানতে চাইবে, ‘বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া যাবে?’ ‘ব্যোমকেশ’-এও জিজ্ঞেস করেছিল। বাড়িতে টিভি চলে, সবাই সব দেখে। কিন্তু এই দ্বিচারিতা আর নস্টালজিয়া ছাড়া আমাদের কিছু নেই। দ্বিচারিতা আমার মধ্যেও আছে। আমিও এর বাইরে নই। যেটা বলছিলাম, এই ছবিতে সবই মিলেমিশে আছে। যেমন ক্রাইমের ধরন বদলে গিয়েছে। অন্যদিকে দীপক ছাড়া তো কেউ বিশ্বাস করবে না, বাদামী হায়না আসছে। এই পৃথিবীটাই আলাদা তাই দেবালয় কোনও নির্দিষ্ট সময়কাল বেঁধে দিতে চায়নি।
ছবির সাফল্যের নিরিখে, ২০২৩ দারুণভাবে ফিনিশ হয়েছে। ‘ফাটাফাটি’, ‘রক্তবীজ’, ‘কাবুলিওয়ালা’। ২০২৪-এর শুরুতে কতটা টেনশন হচ্ছে?
– টেনশন হচ্ছে, মিথ্যে বলব না। এক্সপেরিমেন্টাল একটা কাজ। গতবছরটা সত্যিই ভালো গিয়েছে। প্রতিটা
কাজ অন্যটার থেকে আলাদা। ‘কাবুলিওয়ালা’ অন্য কারণেও স্পেশাল। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলাম।
সেই অভিজ্ঞতা একটু শুনতে চাই।
– মিঠুনদার মতো সুপারস্টার যাকে সবাই এখনও গুরু বলে, সে যখন সেটে এসেছে, আমি দেখছি প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অ্যাডাপ্ট করছে, বদলাচ্ছে। সুমনদাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, ঠিক আছে কি, বা কী করতে হবে! এটা কিন্তু কেবল বিনয় নয়, এটা অভিনেতার খিদে। আর মানুষটা বলছে, ‘তপন সিনহা, ছবি বিশ্বাস–বাঙালি কিন্তু ছাড়বে না।’ তিনি জানেন তিনি কী করতে এসেছেন। আর এই ছবির সেটে আমি সবচেয়ে সামনে থেকে দেখেছি, কীভাবে অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলছেন মিঠুন চক্রবর্তী। সবটা গুছিয়ে বলতেও পারব না। লাস্ট সিন শুট করার পরে আমরা সবাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে গিয়েছিলাম। আবার লেপল অফ থাকার সময় ঠাট্টা-ইয়ার্কিও হয়েছে। এটা একটা অভিজ্ঞতা। সো ইয়েস, ইন এ ওয়ে আই অ্যাম হ্যাপি, যেভাবে ২০২৩ শেষ হয়েছে, নানা ধরনের ছবির হাত ধরে। দায়িত্ব বাড়ছে, বুঝতে পারছি।
রাজ চক্রবর্তীর সঙ্গে দশ বছর পর কাজ করবেন। শুটিং কবে থেকে শুরু?
– জানুয়ারির শেষে। অনেক বছর ধরেই ‘বাবলি’ করার কথা হচ্ছিল। নানা কারণে পিছিয়ে যায়। ফাইনালি হচ্ছে। এটা আবার আদ্যোপান্ত প্রেমের ছবি।
টলিউডের অনেক অভিনেতা এবং কিছু পরিচালক এখন প্রযোজনায়। আপনি কিছু ভেবেছেন?
– হ্যাঁ, ভেবেছি। সকলের কাছে আবেদনপত্র জমা দেব, আমাকে ছবিতে কাস্ট করার জন্য।
পরমব্রত-পিয়ার বিয়ে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিং-এ, নন্দিনী লিখেছিলেন, ভাগ্যিস আপনাদের বিয়েটা অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল। আপনি সহমত?
– অফ কোর্স সহমত। নন্দিনী আমার থেকে অনেক বেশি সাহসী এবং ট্রান্সপারেন্ট। সেই কারণেই ওর মনোভাব ও অনেক স্বচ্ছভাবে বলতে পারে। কুডোস টু হার ফর দ্যাট। আমি পাবলিক ফিগার, আমার কাজে এসব লেগেই থাকে। কিন্তু ওর কাছে এগুলো কোল্যাটারাল ড্যামেজ। নন্দিনী বরাবরই আউটস্পোকেন। তো আমি ওকে বলেছি, এবার তো একটু বয়েস-টয়েস হয়েছে, এবার একটু শান্ত হও। তবে গভীরভাবে ভাবলে আমার যেটা মনে হয়, মানুষ জীবনে, কর্মক্ষেত্রে, সিস্টেমের জাঁতাকলে পড়ে সঠিক জায়গায় নিজেদের রাগ দেখাতে পারে না, তাই এত ট্রোল করে। কারণ ওটাই সহজ আউটলেট। এটা মিসপ্লেসড অ্যাঙ্গার এবং ফ্রাসট্রেশনের কেস।