নির্মল ধর: ‘দ্য লাঞ্চ বক্স’, ‘আহারে মন’ বা অনতি অতীতে দেখা ‘পিসির রেসিপি’ ছবির প্রসঙ্গ মনে পড়লেও রঞ্জন ঘোষের এই নতুন ছবি ‘আহা রে’ স্বাদ-বর্ণ-গন্ধে দর্শকের রসনাকে তৃপ্ত করতে প্রস্তুত। শুধু রসনার তৃপ্তি দেওয়া নয়, সেই তৃপ্তিকে স্থায়ী অনুভূতির এক রসালো উপলব্ধির স্বাদও যেন এনে দেয়। আগের ছবি ‘রং বেরং-এর কড়ি’ থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন ঘরানার ‘আহা রে’ কিন্তু ভাল লাগার অনুভূতিতে একেবারেই অন্যরকম। তাঁর নির্মাণশৈলীতেও কুশলী রাঁধুনির সুচারু বিন্যাসে গরম মশলার গন্ধ যেন ছড়ানো। রান্না যে শুধু তরিতরকারি আর মশলার সমানুপাতিক মিশেল নয়, ‘আরও কিছু’। সেই ‘অতিরিক্ত’ টি আসে রাঁধুনির ভালবাসা এবং হাতের অদৃশ্য জাদুর গুণে যাকে কোনওভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় না। ‘আহা রে’ ছবির হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করা শেফ নায়ক রাজা চৌধুরির যেমন সেই জাদু গুণটা আছে, তেমনই আছে মধ্যবিত্ত বাড়ির বিধবা তরুণী গৃহবধূ বসুন্ধরারও। একজন শহরের পাঁচতারা হোটেলের চিফ শেফ। অন্যজন বৃদ্ধ শ্বশুর, বাবা ও ছোট ভাইসম দেওরের সংসার প্রতিপালনের জন্য ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামের এক পাড়াতুতো ক্যাটারিং সার্ভিসের অতি সাধারণ রাঁধুনি।
ওপার বাংলার রাজার হোম সার্ভিসে খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে পরিচয় ঘটে বসুন্ধরার সঙ্গে। এপারের শুক্তোর সঙ্গে মিলে যায় ওপারের ইলিশ বিরিয়ানি। একজন লবণ বেশি পছন্দ করেন, তো অন্যজন ঝাল। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। বসুন্ধরা ও রাজের নীরব প্রেম একসময় জমাট হয়। পরিচালক রঞ্জন অতি সাবধানে এবং শ্লথ গতিতে এগিয়ে নিয়েছেন ওঁদের সম্পর্কের ভিতটি। হিন্দু-মুসলিমের প্রণয় নতুন কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে শ্বশুরবাবা অতনুবাবু (পরান) ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে যে মানবিক সহমর্মিতার পরিচয় দিয়েছেন সেটা আর ক’জন দিতে পারেন। বেশ লাগে পরাণবাবুর আন্তরিক অভিনয়ও। শেষ পর্যন্ত পরিণতি কী হবে সেটা জানা, কিন্তু রঞ্জন সেটাকে এত দীর্ঘ করলেন কেন! অনেক আগেই শেষ করতে পারতেন। রসনা তৃপ্তির মধ্যে দিয়েই হৃদয়ের দরজা খোলার ব্যাপারটা যে ঘটবে এটা জানাই ছিল। তবে বেশ কিছু সুন্দর ও মনে রাখার মতো মুহূর্তও রঞ্জন উপহার দিয়েছেন। যেমন বসুন্ধরাকে প্রথম খাওয়ানোর দিনে একই প্লেটে চর্ব-চোষ্য লেহ্যর উপস্থিতি কিংবা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে নিজের অতীত স্মৃতিচারণার মুহূর্তগুলো সুন্দর। আবার কন্টিনিউয়িটির ক্ষেত্রে বসুন্ধরার হেঁশেলের দু’রকম চেহারা চোখে লাগে।
[নগরে ‘অন্য’ প্রেমের কীর্তন উঠে এল ছবিতে]
একটু ধীরগতির এই ছবিতে ঋতুপর্ণার অভিনয় কিন্তু খুবই স্বাভাবিক এবং মানানসই। মৃত স্বামীর প্রতি নিবিড় ভালবাসা এবং সংসারের প্রতি গভীর আকর্ষণ তাঁর আন্তরিক অভিনয়ে স্পষ্ট। রাজার চরিত্রে আরিফিন শুভ একটু বেশি সংযত, ফলে কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট মনে হয়। তবে চরিত্রের সঙ্গে তাঁর অভিনয় মোটামুটি মিলে যায়। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব স্টাইলেই রয়েছেন। ছোট্ট চরিত্রে (রাজার প্রেমিকা শাহিদা) অমৃতা চট্টোপাধ্যায় বা হোটেলের কিচেন ম্যানেজারের ভূমিকায় অভিনব পাল বেশ ভাল। গান এই ছবিতে অপ্রয়োজনীয় কিন্তু ‘কী জ্বালা দিয়ে গ্যালা মোরে’ বা ‘ইচ্ছে আমায় বৃষ্টি ভেজায় তোমার শ্রাবণে’ গান দু’টি শুনতে মন্দ লাগে না। নজরুলের কবিতা ‘হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস’-এর ব্যবহারও সুন্দর। এক কথায় ‘আহা রে’ স্বাদু একটি বাঙালি রান্না। হয়তো লবণ ও ঝাল সব রসনার তৃপ্তিসূচক নয়, কিন্তু চাখতে মন্দ লাগবে না।
The post রান্নার মাঝে সম্পর্কের রসায়ন ‘আহা রে’ appeared first on Sangbad Pratidin.