বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: মুক্তি পেয়েছে রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত মিঠুন চক্রবর্তী, ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং অনসূয়া মজুমদার অভিনীত ছবি ‘সন্তান’। বিশেষ স্ক্রিনিংয়ে ছবিটি দেখার পর নানা প্রতিক্রিয়া হয়। প্রাথমিকভাবে ‘সন্তান’ ছবিতে আবেগের ভার একটু বেশিই মনে হতে পারে। মনে হতে পারে বড্ড সরল এই গল্পের চলন। জীবন কি এতই সাদা-কালো! এমন একটা সাদামাঠা গল্প দেখতে যাব কেন? আসলে এই সব যুক্তি এমনিতে ঠিকই আছে, কিন্তু যে বিষয়টা সবচেয়ে গোলমেলে সেটাকে নিজেরই অজান্তে আমরা চেষ্টা করব অস্বীকার করার বা ভিতরে বসতে না দেওয়ার। আর সেটাই হল ‘সন্তান’ ছবির সবচেয়ে অস্বস্তিকর এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। যতই কান্নাকাটি, আবেগঘন সংলাপে চোখের জল ফেলতে ফেলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হল-এর বাইরে বেরিয়ে আসুন, নিজের দিকে আপনাকে তাকাতে বাধ্য করবে রাজ চক্রবর্তীর এই ছবি। গ্রাম থেকে শহর, মফস্সলের টিনের চালের বাড়ি বা কলকাতার হাইরাইজ, পাড়ার চায়ের দোকান হোক বা দক্ষিণ কলকাতার দামি ক্যাফে– আপনি যে ক্লাসেই বিলং করুন, নিস্তার নেই। এই ছবি দেখতে-দেখতে কিংবা দেখে বেরিয়ে আসার পর আপনাকে নিজের দিকে তাকাতেই হবে। এবং আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, সেটা খুব স্বস্তির নয়।
ছবির বিষয় এমনিতে খুব সোজা। বাবা-মায়ের (মিঠুন-অনসূয়া) সঙ্গে ছেলের (ঋত্বিক চক্রবর্তী) বনে না। ছেলে-দায়িত্ব পালন করে ঠিকই, মসোহারাও পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু বাড়তি কোনও কিছু দিতে সে রাজি নয়। স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে নিজের মতো থাকতে চায়। বাড়তি আবেগের লেনদেনে সে নারাজ। বাবা-মায়ের শত চেষ্টা সত্ত্বেও ছেলের ইমোশনাল আনঅ্যাভেবিলিটি বজায় থাকে। ঘটনা এমন মোড় নেয় যে পিতা, পুত্রের ওপর আইনি ব্যবস্থা নেয়। কেস কে জেতে, গল্প কোন দিকে মোড় নেয়, সেটার জন্য আপনাদের ছবিটা দেখতে হবে। কিন্তু ছবিটা যে ভাবনা উসকে দেয় সেটা কিছুতেই মাথার ভিতর থেকে বেরতে চায় না। যদি বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের পরিসরটুকুই বেছে নিই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি একটা সময়ের পর ভালোবাসা বজায় থাকলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের মানসিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় পুরোপুরিভাবে। সন্তান বড় হলে বন্ধু খুঁজে নেয় অন্য মানুষের মধ্যে। যে কোনও সম্পর্কের শিকড় হল বন্ধুত্ব। ভারতীয় ফ্যামিলি স্ট্রাকচারে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক দেখিনি বললেই চলে। ‘হ্যালো, কেমন আছো, ঠিক আছি’– বাবা-মায়ের সঙ্গে এর বেশি কথা খরচ করতে কেন ইচ্ছে করে না, এটা যেমন অভিভাবকরাও বুঝতে পারেন না, খুব তলিয়ে দেখলে সন্তানের কাছেও কিন্তু এর ব্যাখ্যা নেই। কেন আমার নিজের কথা বোঝাতে ইচ্ছে করে না, বা সেটা বোঝাতে গেলে যে শ্রম, সময় ব্যয় করতে হবে, সেই ধৈর্য কুলোয় না– সেটা কোনও পক্ষই ভেবে দেখেনি। পরস্পরের প্রতি দোষ চাপিয়েই খালাস। আমরা ভাবি, অভিভাবক বুঝবে না, তঁারা ভাবেন ছেলে-মেয়ে পর হয়ে গেল। আর এইভাবেই দূরত্বও বাড়তে থাকে, সময় অতিবাহিত হতে থাকে, তার পর একদিন অভিভাবকরা চলে যান একে একে। পড়ে থাকা অপরাধবোধ এবং আবেগের জট, সন্তান হজম করে সেটাকে পরবর্তী প্রজন্মে চালান করে দেয়। এই সাইকেল চলতেই থাকে। রাজ চক্রবর্তীর ছবি, অভিভাবক-সন্তানের এই মানসিক ক্রাইসিসের খুব গভীরে না ঢুকলেও, ইঙ্গিত দিয়েছে। ‘সন্তান’ ছবিটি অভিভাবকের পক্ষ নিয়েই তৈরি। এবং তাতে কোনও ক্ষতি নেই। পরিসংখ্যান, বলে বৃদ্ধ মাতা-পিতার ওপর হওয়া ক্রাইম বাড়ছে। যদিও এটা তেমন ক্রাইমের ছবি নয়, ক্রাইসিসের ছবি। তবু ছবিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরা হয় ‘পেরেন্টিং’ সম্পর্কে।
কথায় আছে ‘কুসন্তান যদি বা হয়, কুমাতা কখনও নয়’। আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে বিষয়টা এত সহজ নয়। পরিবারতন্ত্রে ‘মা’কে সর্বদাই গ্লোরিফাই করা হয়েছে। তাই তার ভুল ধরা হয় না কখনওই। এখানে বোঝা দরকার পেরেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা ততটাও ঠিক-ভুলের নয়, যতটা দৃষ্টিভঙ্গির। অভিভাবকরা সাধারণত তঁাদের সমস্তটা দিয়ে সন্তানকে মানুষ করেন। ছেলের প্রতি মায়ের ‘অন্ধ স্নেহ’-র কথা বলা হয় ছবিতে। ছেলে বলে, ‘তোমরা শুধু আমাকে দিয়ে গেছ, আমি কেবল পেয়েছি, দিতে শিখিনি’। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর আঙুল তুললে বাঙালি দর্শক খুশি হবে না, তাই পরিচালক খুব আলতোভাবে ছুঁয়ে গিয়েছেন অভিভাবকদের অতিরিক্ত স্নেহর কথা, যেটা বাঙালি সমাজে আসলে কোনও ত্রুটিই নয়। ভালোবাসা ‘অন্ধ’ হলে দিক ভুল হতে পারে এটা আমরা ভেবে দেখি না। আমাদের সমাজে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমারেখা টানার অভ্যেস তৈরি করা হয় না। আমাদের বাবা-মায়েরাও সেটা শেখেননি কোনওদিন। আমাদের পরিবারে কমিউনিকেশন প্র্যাকটিস করা হয় না। কোনও সমস্যা দেখা দিলে সেটা যদি অস্বস্তিকর হয় তাহলে পরিবারে খোলামেলা আলোচনার বদলে ধামাচাপা দেওয়াই রীতি। বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে অভিভাবক এবং সন্তানের মধ্যে খোলামেলা সুস্থ আলোচনা খুব একটা হয় না। আমরা ছোট থেকে বাড়িতে গোপনীয়তা প্র্যাকটিস করা দেখে এসেছি আজীবন। আলোচনা মানে আমরা বুঝি কলহ। ফলে আমরা যখন বড় হই, তখন কিছুতেই আর নিজের ক্রাইসিস শেয়ার করে উঠতে পারি না। ‘ঠিক আছে, ভাল আছি, ফোন রাখছি’-র বেশি আমাদের ভোকাবুলারি সায় দেয় না। এটা খানিকটা আত্মপক্ষ সমর্থনের মতো শোনাতে পারে। ছবিতে ‘বাবুই’ (ঋত্বিক চক্রবর্তী) নিজের আত্মপক্ষ সমর্থনে খুব বেশি কিছু বলতে পারেনি, কারণ ততক্ষণে ঘটে গিয়েছে চরম বিপর্যয়। মায়ের পাশে বসে সে স্বীকার করেছে, যে সে দিতে শেখেনি। ছোটবেলায় শিখেছিল ‘যত বড় ভুল, তত বড় সরি’। ছবির শেষে সে ‘সরি’ বলেছে। কিন্তু এই ভুলের শুরু কোথায় সেটা নিয়ে এই ছবিতে খুব বেশি কথা বলা হয়নি। পিতা-পুত্রকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে ঠিকই, আসলে সেটাকে রূপক হিসেবে নেওয়াই ভালো। দু’পক্ষেরই শেখার আছে। কিন্তু বাবা-মায়েরা বৃদ্ধ হলে, সেই সময়টা আর হাতে থাকে না। তখন পড়ে থাকে আফসোস। আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে আমরা আফসোসের সঙ্গে আপস করব, না কি নিজের সন্তানের সঙ্গে, আশপাশের মানুষের সঙ্গে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলব, যেখানে সেন্স অফ বাউন্ডারি থাকবে, রেসপেক্ট থাকবে, কনসেন্ট থাকবে আর আলোচনার সুযোগ থাকবে। ‘সন্তান’ মুক্তি পেয়েছে আজ। মিঠুন চক্রবর্তী, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অনসূয়া মজুমদার এবং শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয়ের আঁচ পেতে হলে অবশ্যই হল-এ গিয়ে সিনেমাটা দেখে আসুন।