‘চিনি টু’-র মুক্তি আসন্ন। তার আগে ব্যক্তিজীবন, কেরিয়ার, বডি পজিটিভিটি নিয়ে আগলহীন অপরাজিতা আঢ্য। কথোপকথনে বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
‘চিনি টু’-র ট্রেলার দেখে বুঝলাম এখানে দু’জন অসমবয়সি নারীর বন্ধুত্বের গল্প। আপনি কি নিজের জীবনে অল্প বয়সিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেন?
– আরে, আমার তো সব অল্প বয়সি বন্ধু। আমার প্রিয় বান্ধবী সে আমার চেয়ে ১৫ বছরের বড়, আর তার মেয়ে ১৫ বছরের ছোট। সেও আমার খুব বন্ধু। আমার স্কুলের যারা বন্ধু তারা তো আছেই। তাছাড়া আমার থেকে বারো-তেরো বছরের ছোট এমন অনেক বন্ধু আছে।
এই যে অল্প বয়সিরাও আপনার বন্ধু হয়ে ওঠে, কী মনে হয় কেন কানেক্ট করে?
– আসলে আমি জাজমেন্টাল নই, আমার কোনও রিজারভেশন নেই। আমাদের বড় হওয়ার সময় মায়েরা মনে করতেন তাঁরাই ঠিক, আর আমরাই শুধু ভুল, যদিও সেটা আমি একেবারেই মনে করি না, কারণ তাঁরা ভুল ছিলেন অনেক ক্ষেত্রেই। তাই কে ভুল-ঠিক আমি এভাবে ভাবি না। কারণ এটা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। সেট স্ট্যান্ডার্ড দিয়ে মানুষকে দেখি না। সবটাই পারস্পেক্টিভ।
আপনি প্রথম থেকেই এইরকম?
– আমি একেবারে ছোটবেলা থেকেই এইরকম। মনে আছে, আমি যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়তাম আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ‘গে’ ছিল। এই ধরো ১৯৯৪-’৯৫ সাল হবে। হি ওয়াজ ভেরি মাচ ‘গে’। আর সেটা ও গোপনও করেনি। আজ থেকে ২৮-২৯ বছর আগে সমকামিতা নিয়ে সহিষ্ণুতা তো দূর অ্যাওয়ারনেসও ছিল না। বাকিরা ওকে নানাভাবে হ্যারাস করত। ওকে সাপোর্ট করতাম শুধু আমি। আমি আসলে মানুষের ভাল থাকায় বিশ্বাসী!
মৈনাক ভৌমিকের সঙ্গে প্রায় পাঁচটা ছবি হল। ওঁর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
– আসলে কী জানো তো, আমার অঞ্জন দত্ত’র সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে যে ফিলিংটা হত, যে লিবার্টিটা আমি পেতাম সেটা মৈনাকের সঙ্গে পাই। মনে আছে, ‘ম্যাডলি-বাঙালি’-র সময় একটা দৃশ্য একটু অন্যরকমভাবে করার কথা বলতে গিয়েছি তখন অঞ্জনদা স্ক্রিপ্ট ফেলে দিয়ে বললেন, ‘আমি তো খারাপ লিখি, তুমি তোমার মতো করো’। পরবর্তীকালে মৈনাকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই অনুভূতিটা পেয়েছি।
মায়ের চরিত্র করতে কখনও একঘেয়ে লাগে না?
– না, লাগে না। আমার মধ্যে মাতৃত্ববোধটা খুব বেশি। আসলে এই বোধটা শুধু জন্ম দিলেই হয় না। মা হয়ে উঠতে হয়। বাবা হয়ে উঠতে হয়। বন্ধু হয়ে উঠতে হয়। ছোটবেলা থেকেই আমার সংগ্রামের সঙ্গে, মা হয়ে ওঠার ব্যাপারটা ছিল। প্রেমের ক্ষেত্রেও দেখেছি। সেখানেও একটা মা আছে। এবং প্রতিটা মায়ের চরিত্রে একেকটা ডাইমেনশন বেরিয়ে আসে। কারণ ‘মায়েদের’ জীবনে নানা সময়ে নানা জটিল স্তর পেরতে হয়।
[আরও পড়ুন: বিচ্ছেদ-বিতর্ক যতই হোক পরিমণী ‘মানবিক’, মাতৃহারা দুই শিশুর দায়িত্ব নিলেন নায়িকা]
নন্দিতা-শিবপ্রসাদ এবং মৈনাক, এদের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন। নন্দিতা-শিবপ্রসাদের ছবিতে আপনার চরিত্র একটু সনাতন, ক্লাসিকাল বাড়ির বউ। অন্যদিকে মৈনাকের ছবিতে আপনার চরিত্রগুলো সিস্টেমের মধ্যে থেকেও একটু ছক-ভাঙা। কোনটা বেশি এনজয় করেন?
– হ্যাঁ, ‘একান্নবর্তী’ বাদ দিলে, মৈনাকের লেখা সব চরিত্রগুলোর মধ্যেই একটা পাগলামি আছে। তবে এই দুই ধরনের চরিত্রই কিন্তু ঠিক। এবং শিবু-নন্দিতা বা মৈনাক তাদের জনারের চরিত্রায়ণে সিদ্ধহস্ত। মৈনাকের ক্ষেত্রে বলব, ওর নারী চরিত্রদের মধ্যে যেটা দেখি সেটা হল জীবন এলোমেলো হয়ে যাওয়ার পর গোছানোর একটা চেষ্টা। একটা কথা সত্যি, একটা মেয়ে যখন বউ হয়ে সংসারে আসে সে সবাইকে ভালবাসলেও, একটা সময়ের পর তাকে ভালবাসার কেউ থাকে না। ছেলেমেয়েরা ফোনে কথা বলতে চায় না, বর হয়তো টিভিতে খেলা দেখতেই ব্যস্ত। তাদের একাকিত্ব ঘোচানোর কেউ থাকে না। সেই বয়সে নারী শরীরে নানা হরমোনাল পরিবর্তন আসে- সেটা তো বুঝতে হবে। চেহারায় পরিবর্তন আসে। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ছোঁয়ার সময়টা নারীর যে লড়াইটা- সেটা মৈনাক খুব ভাল দেখাতে পারে। আর সেটা পর্দায় ফুটিয়ে তোলাটা আমি খুব এনজয় করি। এখানে কোন পরিচালককে এগিয়ে রাখব সেটা প্রশ্ন নয়। দুটো আলাদা ধরন। আর ওরা যখন কাজ দেয় জানে আমি ঠিক পারব- এটা দু’পক্ষর ক্ষেত্রেই কমন। আমার অনেক ফ্লপ ছবি আছে, কিন্তু আমি ফ্লপ নই।
ছাব্বিশ বছরের কেরিয়ারে, সর্বক্ষেত্রেই আপনি সফল। কীভাবে দেখেন এটাকে?
– আসলে সাফল্যের আরামটা হচ্ছে এক লহমার।
তবে অনেকদিন ধরে এই সাফল্য ধরে রেখেছেন!
– রাইট, রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে। আসলে আমার মনে হয়, আমি যুগের সঙ্গে নিজেকে অ্যাডাপ্ট করতে পারি।
আপনার পুরনো ছবি ‘শুভ মহরৎ’ বা আরও অন্যান্য ছবি থেকেই অভিনয় দক্ষতা বোঝা যায়। তবে তারও আগের ছবি ‘শিমূল পারুল’ তখন বিখ্যাত না হলেও এখন তার সংলাপ নিয়ে রিল খুব জনপ্রিয় হয়েছে। কেমন লাগে? আর ওই ফেলে আসা সময়টা নিয়ে কিছু বলতে চান?
– হা হা হা!… আমি ওই রিলগুলো দেখে খুব এনজয় করি! এতদিন আগেকার স্বপন সাহার একটা ছবি যেটা নিয়ে মানুষের মধ্যে এখনও জনপ্রিয়তা রয়েছে সেটা আমার দারুণ লাগে। ঋতুদা, সৌমিত্রবাবু (চট্টোপাধ্যায়) এদের আমি খুব মিস করি। অনেক শিখেছি এঁদের থেকে। ঋতুদা একবার বলেছিলেন, ‘ম্যাডলি দেখে আয়নার সামনে অনেক চেষ্টা করেও তোর মতো অভিনয় করতে পারলাম না।’ সৌমিত্রবাবু বলেছিলেন, ‘তুমি এই ছবিতে কাজ করবে শুনে ভেবেছিলাম আরেকটা লড়াই করার সুযোগ পাব। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে আমার নিজের পার্টটাও ভাল হল না।’ কে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে আমি মনে রাখি না। ওঁদের এই কথাগুলোই আমার এগিয়ে যাওয়ার রসদ।
ইদানীং বডি পজিটিভিটি নিয়ে কথা হলেও, এখনও গ্ল্যামার জগতে নির্দিষ্ট বডিটাইপ প্রেফার করা হয়। আপনার ক্ষেত্রে চেহারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি?
– হ্যাঁ, অনেক শুনেছি একটা সময়ে। ‘তুমি মোটা বলে তোমাকে এই চরিত্রে ভাবতে পারছি না’, বা ‘তুমি মোটা বলে একটা নির্দিষ্ট ধরনের চরিত্রের বাইরে ভাবা যায় না।’ এখন তুলনামূলকভাবে অনেক কম শুনতে হয়। তবু রয়ে গিয়েছে!
[আরও পড়ুন: ‘বুমেরাং’ হিট করাতে পুজো, শুটিং শুরুর আগে কালীঘাটে মায়ের মন্দিরে জিৎ]
কিন্তু সবকিছুর তোয়াক্কা না করে দাপিয়ে অভিনয় করছেন! ইন্সটাতেও আপনার নাচ-গান বা সমুদ্র সৈকতে শর্টস পরা রিলও দেন। প্রচণ্ড কনফিডেন্ট! এটা কোথা থেকে পান?
– এই সাহস আমার ছোটবেলা থেকে। আমার কনজারভেটিভ বাড়িতে ছাদে দাঁড়ানো, ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা বারণ ছিল। আমি কোনও কালেই মানিনি। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে দিয়ে কিছুই করানো যাবে না। মোটা থেকে রোগা হওয়ার চেষ্টাই আমি করিনি। আমি খেতে ভালবাসি! আমি যা কাজ করতে পারি, সেটা এই চেহারা দিয়েই হবে! যাদের কাছে হবে না, হবে না! আমি কারও জন্য নিজেকে বদলাব না।