দীপঙ্কর মণ্ডল, সাগর: ‘বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়, আমরা করব জয় নিশ্চয়।’ সাগরদ্বীপের অখ্যাত গ্রামের চাষি দম্পতি হয়তো এ গান শোনেননি। ধ্বংসের মাঝে দাঁড়িয়ে তবু আশার আলো তাঁদের চোখে-মুখে। সব হারানোর পর কোনও অভিযোগও নেই। সরকারি ত্রাণও আশা করেন না। মৃদু গলায় শুধু বলেন, একটা পলিথিন পেলে খুব ভাল হতো।
সুন্দরবনের এই দ্বীপ থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। হ্যান্ডেল কেটকি গ্রাম। মাঝ বয়সি দম্পতি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। মাথার উপর হাড় বেরনো ছাউনির কাঠামো। চাল পুরোটাই উড়ে গিয়েছে। একটা খড়কুটোও বাঁচেনি। এখন বৃষ্টি এলে গাছতলা ছাড়া কোনও আশ্রয় নেই। বেঁচে থাকার টুকিটাকি জিনিস খোঁজার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। মানবেন্দ্র মণ্ডল ও শ্যামলী মণ্ডল। জানালেন, শুধু যে চাল উড়েছে তাই নয়, পুকুরের মাছগুলো সব ভেসে গিয়েছে। আর ঘর তৈরি সম্ভব নয়। তাহলে কি করে থাকবেন? “কেন একটা পলিথিন জোগাড় করব। তা দিয়ে দিব্যি থাকা যাবে।” হাসিমুখেই বললেন শ্যামলীদেবী। সরকারি সাহায্যের প্রসঙ্গেও ক্ষোভ নেই। বললেন, “ওটাও তো একটা সংসার। সরকার কত দেবে। কতজনকে দেবে। কি করেই বা দেবে।” এই বুথে আড়াইশো পরিবার। প্রত্যেকেরই ছাদ নেই। পানের বরজ ধ্বংস। চাষের জমিতে জল। একটা গাছও দাঁড়িয়ে নেই। মানবেন্দ্রবাবুর কথায়, “আমাদের বুথেই যদি এত ক্ষতি হয় গোটা রাজ্যে তাহলে কত না ক্ষতি হয়েছে। সরকারের কি এত টাকা দেওয়া সম্ভব?” ছাউনির যে কয়েকটা টালি অক্ষত ছিল কোম্পানি ছাড়ের মাধব নাইয়াকে বিক্রি করছিল দম্পতি। যতটুকু পাওয়া যায় তা দিয়েই আপাতত চলবে।
[আরও পড়ুন: মুম্বই থেকে ফিরে কোয়ারেন্টাইন, গোয়ালঘরেই ইদের নমাজ পাঠ পরিযায়ী শ্রমিকের]
পূর্ব মেদিনীপুর থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। দুই জেলার উপকূল এলাকায় বিস্তর ঘুরেছি। গ্রামবাসীদের তীব্র ক্ষোভ। সবার দাবি, সরকার টাকা পাঠায়। তাঁদের হাতে যায় না। ফেরার পথে কলকাতায় মোড়ে মোড়ে অবরোধ। কোভিড সর্তকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জটলা। টায়ার এবং ভেঙে পড়া গাছের ডাল জড়ো করে তাণ্ডব চলছে। অবরোধ। বিক্ষোভ। দাদাগিরি। এবং অবশ্যই মস্তানি। কেন কাউন্সিলর এলেন না। কেন বিদুৎ আসছে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্ত অভিযোগই সত্যি। কিন্তু সেই বিক্ষোভকারীদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই যে, এই লকডাউনের সময় রাস্তায় যাঁরা বেরিয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের জরুরি কাজ আছে। অবলীলায় গাড়িগুলিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে আমাদেরও।
উলটোদিকে সাগরের ওই দম্পতি। এক কণা চাল যাঁদের বাঁচেনি। কী খাবেন জানেন না। কোথায় থাকবেন তা অনিশ্চিত। তারপরও কত ধৈর্য। কত জীবনবোধ। অভিভূত হয়ে গেলাম সাগরের দম্পতির কথা শুনে। অসহায় নিঃস্ব দুটি মানুষ। সবকিছু হারানোর পরেও যাঁদের মুখে হাসি। চাহিদা বলতে শুধু একটা পলিথিন। লকডাউন এবং ঝড়। দুই মহা সাংঘাতিক ঘটনার পর আরও কয়েকজন নির্বিকার মানুষের সঙ্গে দেখা হল সাগরে। উত্তরপ্রদেশ থেকে এখানে আত্মীয়ের বাড়িতে এসে আটকে আছেন রাম নিবাস। শাহজাহানপুরের এই বাসিন্দা জানেন না কবে ফিরবেন। বাড়িতে সবাই অসুস্থ। খুব সহজ গলায় তিনি বলেন, “আমি তো একা নই। গোটা দেশ ভুগছে। কী আর করা যাবে। সব স্বাভাবিক হলে বাড়ি ফিরব।”
[আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণের হারে কলকাতাকে টেক্কা মালদহের, গত ২৪ ঘণ্টার পরিসংখ্যান বাড়াল উদ্বেগ]
The post ‘একটা পলিথিন পেলে ভাল হত’, সরকারি ত্রাণের আশাই করেন না সাগরের দম্পতি appeared first on Sangbad Pratidin.