সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: সত্য আর মিথ্যা তবে একাকার হয়ে আজ গড়িয়ে চলেছে দিকে দিকে।
বুদ্ধের প্রশান্ত মূর্তি ঘিরে বহমান মহা এক কালো উপাখ্যান।
(ভারতের কালো কবিতা, অনুষ্টুপ, ২০২০)
সময় বেশি গড়ায়নি আর তারপর। মাত্র কিছুদিন আগের লেখাতেই বহমান এক কালো উপাখ্যান চিনিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। সে-লেখায় দেখা যায় তাঁর এক বান্ধবকে। ভিন্নভাষী তিনি। আগ্রহী রবীন্দ্রনাথে (Rabindranath Tagore)। এসেছিলেন তাই কবির কাছে। শুরু হয় ভাবনার আদান-প্রদান। রবীন্দ্রনাথের শব্দে দেওয়া-নেওয়া যাপন। সরে যায় অপরিচয়ের পর্দা। বেশ কিছুদিন যোগাযোগ নেই তারপর। অকস্মাৎ একদিন সেই বান্ধব এসে প্রোজ্জ্বল মুখে বলেন, যে করসেবকের দল ভেঙেছে মসজিদ, সে-দলে ছিল তাঁর ভাইপোও। অবশ হয়ে আসে কবির শরীরমন। একদা বান্ধবকে বলেন ধৃষ্ট কথা, আর যেন তিনি কখনও কবির বাড়িতে না আসেন। সময়ের মর্মমূল ঘিরে থাকা এই এক মহা কালো উপাখ্যান তাঁকে পীড়িত করে। সেই-ই তো স্বাভাবিক। আজীবন মানবতার উপাসক তিনি, সায়াহ্নে এই মানবতার লাঞ্ছনা দেখে শুধু যন্ত্রণাদগ্ধই হননি, আমাদেরও চিনিয়ে দিতে চেয়েছেন সেই ‘ভারতের কালো কবিতা’।
মানবতাবিরোধী যে-কোনো উদ্যোগের প্রতি এই মিতবাক অথচ দৃঢ় প্রত্যাখ্যানই স্বয়ং কবি শঙ্খ ঘোষ (Shankha Ghosh)। মানবতার প্রসারিত ভূমিতে আজীবন উদাহরণস্বরূপ হয়ে থাকা প্রায় দুরূহ এক প্রয়াস। বলা যায়, এ হল তাঁর গোটা এক জীবনের অনুশীলন। মন ও মননের সীমা প্রসার করার প্রয়াসকে প্রণালী হিসেবে দেখেননি তিনি, দেখেছেন পদ্ধতি হিসেবে। বদ্ধমূল পেরিয়ে যাওয়ার কথা তিনি বলেন বারেবারেই। তরুণ কবিদের একদা তাই তিনি যখন ‘কবির বর্ম’ তুলে দিচ্ছেন, তখনও আসলে এই প্রণালী কিংবা ছককাটা বিধিবদ্ধ কিছুর বাইরে বেরনোর আহ্বানই জানাচ্ছেন। তাঁর বাড়ির যে-আড্ডা নিভে গেল, সেখানেও তো ছিল বহুজনের যাতায়াত। আদান-প্রদান ও সংযোগের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যে গ্রন্থি বাঁধা হয়, রবি ঠাকুরের কথায় যা কিনা শুভবুদ্ধির দ্বারা সংযোগ, তাই-ই যে আসলে শাসকের রক্তচক্ষু অতিক্রম করে মহাজীবনকে প্রবহমান রাখে, শঙ্খবাবু তা কেবল উপলব্ধিই করেননি, আজীবন আপনি আচরি ধর্ম তা আমাদের দেখিয়েও দিয়েছেন।
[আরও পড়ুন: অতীতের আয়নায় বর্তমানের বিপন্নতাকে দেখার নাটক ‘মেফিস্টো’, পড়ুন রিভিউ]
বৌদ্ধিক চর্চার ক্ষেত্রেও এই সীমাকে তিনি প্রসারিত অর্থেই অর্থাৎ সমগ্রতায় ধরতে চেয়েছেন। ইকবালকে নিয়ে যখন তিনি চর্চা করছিলেন, তখন, কেন ইকবাল, এ-প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন এই সংযোগের কথাই। ‘নিকট প্রতিবেশীকে জানতে না-চাওয়ার, বুঝতে না-চাওয়ার জড়তায় আর আত্মাভিমানে টুকরো-টুকরো-হতে-থাকা এই বর্তমান যে কতখানি অপঘাত নিয়ে আসছে, সেটা নিশ্চয়ই আজ টের পাওয়া যায়।’ – আত্মসর্বস্বতা পেরনোর গূঢ়কথা হিসেবে আমাদের শিখিয়ে দিতে চাইছিলেন দূরের দিকে তাকানোর মন্ত্র। ব্যক্তি নয়, ব্যক্তি অতিক্রম করে ছুঁতে যাওয়া সমষ্টির আকাশ; আবার সেই অতিক্রমণের সূত্রে ব্যক্তিকে গুরুত্বহীন করে ফেলা নয়, বরং তার মর্যাদা রক্ষা করা। প্রণালী বা বিধিবদ্ধতা পেরিয়ে, দল বা মতের গণ্ডি ছাড়িয়ে, মানবতার পক্ষে এই সমন্বয়ের দর্শনই তিনি অনুশীলন করে চলেছেন তাঁর যাপনে।
অথচ আজ যখন বুদ্ধের শান্ত মূর্তি ঘিরে মহা কালো উপাখ্যান তার পাখা মেলেছে, তখন কি তিনি ক্লান্ত? গোপনে ছিলেন কি-না, আমাদের জানা নেই। কিন্তু আমরা এটুকু জানি, শেষ পর্যন্ত তিনি সংযোগের ভাষাই খুঁজে চলেছিলেন। ধর্ম উন্মাদনায় তাঁর দেশ যে মত্ত, এমনকী যাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শব্দযাপন হয়েছে, সেই তিনিও যে মসজিদ ভাঙায় উল্লসিত, এ-হেন ঘটনা ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি তাঁকে নিশ্চিতই ব্যথাতুর করেছে। সেই নিরিখেই তিনি আরও জোর দিয়েছিলেন, সম্প্রদায়কে চেনার জায়গায়। যে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিররুদ্ধতা, বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যদি সেই সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ একে অন্যকে চিনতেন তেমন করে, তবে হয়তো আস্থার হাত দৃঢ় হত। ‘শঙ্খবাবুর সঙ্গে’ বইতে লেখক সৌমেন পালকে তাই তিনি জানিয়েছেন, ‘যে-আগুন আছে মনের গভীরে, দু-তরফেই যা বেড়ে ওঠে দিনে দিনে। মনের ভিতরকার সেই সাম্প্রদায়িকতার সংকটকে তো বুঝতে হবে আমাদের। সেটা তখনই সম্ভব, যখন নিয়মিত স্বাভাবিক মেলামেশা হবে দু-সম্প্রদায়ের মধ্যে। সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বাড়াতে হবে। প্রথমে হয়তো কিছু মনের বাধা থাকবে। ক্রমে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। সবাই একবারে এগিয়ে আসবে না। তবু কাউকে তো প্রথম পা ফেলতেই হবে। অভ্যাসে আনতে হবে একটু একটু করে। দরজা একেবারে বন্ধ রাখলে চলবে না।’
এই দরজা খোলার পাঠ শুরু করা যায় শৈশব থেকেই, শঙ্খবাবু প্রস্তাব দেন, ‘যদি অল্পবয়সের ছাত্রছাত্রীদের স্কুল বিনিময় চালু করা যায়, যেমন হিন্দু এলাকার স্কুলের কিছু ছাত্রদের মুসলিম এলাকার স্কুলে এক সপ্তাহ পড়তে পাঠানো হলো, আবার উলটোটাও। এটা করে দেখা যেতে পারে। তাহলে হয়তো কমবয়স থেকেই তাদের মধ্যে একটা পারস্পরিক আস্থাবর্ধক পরিবেশ গড়ে তোলা যাবে। বুঝতে পারবে একে অন্যকে।’ কেন-না তাঁর আজীবনের উপলব্ধি থেকে উঠে আসা কথাটুকু এই যে, ‘ধর্ম নয়, মানুষের অগ্রাধিকারের জায়গা অন্য। ভালোভাবে মানুষের মতো সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা।’
মানুষকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়াই মানুষের ধর্ম। এই তাঁর যাপনের শিক্ষা। সে ব্যক্তিগত জীবনের ছোটো ছোটো ঘটনা হোক কিংবা তাঁর ব্যাপ্ত সাহিত্যকীর্তি- সর্বত্রই চোখে পড়বে এই গভীর বাণী। আজ সেটুকু আমাদের অনুধাবন করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
[আরও পড়ুন: দুই প্রতিবাদী নারীকে নিয়ে এক অন্য ঘরানার নাটক ‘স্যাফো চিত্রাঙ্গদা’]
সম্প্রদায়গত ভেদ কিংবা মানবিকতাবিরোধী উল্লাসের মুহূর্তগুলিকে যে আমাদের যে কোনও মূল্যে বর্জন করতেই হবে, প্রত্যাখ্যানের এই ঋজু ভাষা আয়ত্ত করতে পারলেই হয়তো আমরা একদিন পেরিয়ে যেতে পারব আজকের ‘ভারতের কালো কবিতা’। আমরা হয়তো তখনই প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে পারব সত্যদ্রষ্টা কবিকে।