বিশ্বদীপ দে: ফের ফুটবল বিশ্বকাপ (Football World Cup)। ফের রাত জেগে প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটানো। ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’ বলতে সারা বিশ্বের বহু ফুটবল অনুরাগীদের মতো বাঙালিও এই প্রতিযোগিতাকেই বোঝে। আসলে বিশ্বকাপ মানে কেবল খেলা দেখাই তো নয়। হর্ষ-বিষাদের নানা স্মৃতির এক পুঁথির মালা যেন। মারাদোনার ‘হ্যান্ড অফ গড’ কিংবা বিশ্বকাপ ফাইনালে চূড়ান্ত মুহূর্তে টাইব্রেকারে রবার্তো বাজ্জিওর ব্যর্থতা- লোকশ্রুতির চেহারা নেয় মাঠের কত যে ঘটনা! কিন্তু বিষণ্ণকার নিরিখে এস্কোবার নামটা বোধহয় অনতিক্রম্য। মাঠের একটা ভুলের কারণে যাঁর শরীরে বিঁধে গিয়েছিল ৬টা তপ্ত বুলেট।
মাদক, কলম্বিয়া আর এস্কোবার- পাশাপাশি বসালে যে বিষাদগাথা তৈরি হয়, তার মূল চরিত্র অবশ্য দু’জন। একজন এস্কোবার ফুটবলার। আন্দ্রেজ (Andres Escobar)। অন্যজন এস্কোবার ড্রাগ লর্ড। পাবলো (Pablo)। জীবন কীভাবে যেন মিলিয়ে দিয়েছিল দু’জনকে। পাবলো মারা গিয়েছিলেন আগেই। তিনি থাকলে নাকি এমন পরিণতি হত না আন্দ্রেজের। ভাবতে বসলে মনে হয় সিনেমা।
[আরও পড়ুন: ওড়িশার বিরুদ্ধে নামার আগে ইস্টবেঙ্গলের চিন্তা চোট-আঘাত, মাঝমাঠ নিয়ে চাপে স্টিফেন]
সত্য়িই যেন বারুদে ঠাসা চিত্রনাট্য। আটের দশক থেকেই কলম্বিয়ায় ড্রাগের ব্যবসার রমরমা তুঙ্গে ওঠে। ফলে ড্রাগ লর্ডরা ভেবে পাচ্ছিলেন না কীভাবে পকেট উপচে পড়া অর্থকে খরচ করবেন। সেই আদ্যিকালের জমিদারদের পায়রার লড়াইয়ের মতো এই ড্রাগ লর্ডরা টাকা লাগালেন ফুটবল ক্লাবগুলিতে। পাবলো তাঁর টাকা লাগিয়েছিলেন মেডেলিনের ক্লাব অ্যাটলেটিকো ন্যাশনালে (Atletico Nacional)। আর সেই ক্লাবেরই তারকা ফুটবলার ছিলেন আন্দ্রেজ এস্কোবার। যদিও তাঁর সঙ্গে কিংবা কোনও খেলোয়াড়দের সঙ্গেই কোনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না পাবলোর। ফলে এক ড্রাগ লর্ড ও এক উদীয়মান তারকা ফুটবলারের জীবন সেই অর্থে কোনও বিন্দুতেই এসে মেশেনি। কিন্তু তবুও মিল আছে। সেই মিসিং লিক ফুটবল। তাছাড়া তাঁদের জীবনের শেষ পরিণতির হতভাগ্য চেহারা। সেকথায় পরে আসা যাবে। আগে আন্দ্রেজের কথা।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ। গ্রুপ লিগের ম্যাচে আয়োজক দেশ আমেরিকার মুখোমুখি কলম্বিয়া। এক মার্কিন খেলোয়াড় বক্সের দিকে দৌড়তে দৌড়তেই বল ঠেলে দেন অন্য প্রান্তের ফুটবলারের দিকে। তাঁদের মাঝখানেই ছিলেন আন্দ্রেজ। তিনি চেয়েছিলেন বলটি ক্লিয়ার করে দিতে। কিন্তু গোলকিপারের সঙ্গে তাঁর বোঝাবুঝিতে গোলমাল হয়ে
যায়। ফলে স্লাইড করা বলটি জড়িয়ে যায় জালে। ১-২ ব্যবধানে হেরে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যায় কলম্বিয়া। অথচ সেবার কিন্তু কলম্বিয়াকে ঘিরে আশা জাগছিল। এমনকী তাদেরই হবু চ্যাম্পিয়নও বলতে শুরু করেছিলেন বহু বিশেষজ্ঞ। কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে যায় এক মুহূর্তের ভুলে। কিন্তু সেদিন কলম্বিয়ার নাগরিকদের ধারণা ছিল, এর থেকে অনেক বড় ট্র্যাজেডি সামনেই অপেক্ষা করে রয়েছে।
[আরও পড়ুন: ‘খুব বেশি আর খেলব না’, অবসর নিয়ে ফের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য মেসির]
বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পাঁচ দিনের মাথায় গভীর রাতে এক নাইট ক্লাবের পার্কিং লটে গাড়িতে বসেছিলেন একা আন্দ্রেজ। ঠিক তখনই তিন দুষ্কৃতীর হামলা। প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপরই বন্দুকের ঝলসে ওঠা। গুলির পর গুলিতে ঝাঁজরা জাতীয় দলের তারকা ডিফেন্ডার। শুধু কলম্বিয়াই নয়, গোটা ফুটবল বিশ্ব যেন বিশ্বাস করতে পারেনি এমনও হতে পারে!
এর ঠিক ছ’মাস আগে পাবলো মারা গিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই মেডেলিনের মতো চির বসন্তের শহরের আকাশে-বাতাসে যেন উত্তেজনার গুঁড়ো। নতুন নতুন ড্রাগ লর্ডদের মধ্যে শুরু হওয়া গ্যাং ওয়ারে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে খোলামকুচির মতো। এমনই টালমাটাল পরিস্থিতিতে আন্দ্রেজের মৃত্যুকে এড়ানো বোধহয় সম্ভবও ছিল না। কিন্তু অনেকেরই মতে, পাবলো এস্কোবার বেঁচে থাকলে এমন কিছু ঘটত না। পাবলো তো ড্রাগ কিংপিনই কেবল ছিলেন না। তাঁর প্রতাপ ছিল অবিসংবাদিত। তাঁরই ক্লাবের তারকা ফুটবলারের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া জনরোষকে ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতেন পাবলো।
অবশ্য বদমেজাজি পাবলোও খেলার মাঠে রক্তারক্তি ঘটিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে আমেরিকা ডি কালি ক্লাবের সঙ্গে খেলায় অ্যাটলেটিকো ন্যাশনাল হেরে যায়। হারের জন্য ‘দায়ী’ করা হতে থাকে রেফারিকে। শেষে রেফারিকে খুনই করিয়ে দেন পাবলো। পরিস্থিতি এমনই হাড়হিম হয়ে ওঠে যে কলম্বিয়ান সকার ফেডারেশন সেবারের মরশুমের খেলা বাতিল করে দেয়। সেই সময় কার্যতই মাদক সম্রাট হয়ে উঠেছেন তিনি। ১৯৮৫ সালে দেশের সুপ্রিম কোর্টের ১১ জন বিচারক মারা যান পাবলোর হামলায়।
যদিও এরই সমান্তরালে ছিল তাঁর এক ‘দাতা’ রূপও। স্টেডিয়াম, চার্চ থেকে স্কুল কিংবা পার্ক- বিপুল অর্থের অনুদান দিতেন তিনি। ফলে মিশ্র একটা ভাবমূর্তি তৈরি হতে শুরু করেছিল। অনেকটা রবিন হুড ধাঁচের। তাঁর প্রভাব এমন বেড়ে গিয়েছিল, নিজের দেশের সরকার তো বটেই আমেরিকারও মাথাব্যথাও হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পাবলো। সেই সঙ্গে ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ কালি কার্টেলের রগরিগোজ ব্রাদার্স। প্রসঙ্গত, এই রডরিগোজদের সঙ্গে ফুটবল মাঠেও রেষারেষি ছিল পাবলোর। যাই হোক, বেগতিক বুঝে এসকোবার প্রায় ১৬ মাস নিরুদ্দেশে ছিলেন। মেডেলিনের এক মধ্যবিত্ত পাড়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁর খোঁজ পায় পুলিশ। শোনা যায়, পুলিশ কিন্তু গ্রেপ্তারই করতে চেয়েছিল। শেষপর্যন্ত গুলিবিদ্ধ পাবলোর দেহ মেলে। কিন্তু তিনি পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন নাকি আত্মহত্যা করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়। আজও।
এর ঠিক মাসছয়েকের মধ্যেই আন্দ্রেজের মৃত্যু। ২০১৮ সালে কলম্বোর পুলিশ দাবি করে তারা এক ড্রাগ লর্ডকে খুঁজে পেয়েছে। সান্তিয়াগো গ্যালন হেনাও নামের সেই ড্রাগ লর্ডই নাকি আন্দ্রেজের করুণ পরিণতির পিছনে আসল মুখ! আসলে দেখতে দেখতে প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজও প্রশ্নটার সমাধান মেলেনি। ব্যাপারটা কি স্রেফ বিশ্বকাপে আত্মঘাতী গোল করার পর ক্ষুব্ধ ফ্যানের মদ খেয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গুলি চালানো? নাকি এর সঙ্গে বেটিং মাফিয়াদের যোগ ছিল? নাকি এর পিছনে আসলে মাদক চক্রের শোধ-বোধের খেলা? পাবলো এসকোবারের অপরাধের হিসেব মেটাতে তাঁরই দলের সেরা খেলোয়াড়কে মেরে ফেলে বদলা? উত্তর আজও মেলেনি। হয়তো কোনওদিনই মিলবে না। চিরকালীন এক কুয়াশায় ঢাকা থেকে যাবে আন্দ্রেজ এস্কোবারের মৃত্যুরহস্য।