কালীপুজোর মুখে আসছে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘বল্লভপুরের রূপকথা’। ছবি তৈরির নেপথ্যের গল্প শোনালেন অনির্বাণ। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
ওয়েব সিরিজ ‘মন্দার’-এর পর ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ পরিচালক হিসাবে আপনার ডেবিউ ফিল্ম। দুটো কাজই সাহিত্য-নির্ভর এবং দুটোই নাটকের অ্যাডাপ্টেশন। কোনও বিশেষ কারণ?
অনির্বাণ: না, বিশেষ কোনও কারণ নেই। এটা ঘটনাচক্রেই হয়েছে। আমাকে যখন ছবি করতে বলা হল, তখন আমি বিভিন্ন গল্পের কথা ভাবছিলাম। নানা কনসেপ্টের কথা ভাবছিলাম যেটাকে ডেভলপ করা যেতে পারে। আবার নাটকের কথাও ভাবছিলাম। ফাইনালি বাদল সরকারের ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ সিনেমায় অ্যাডাপ্ট করব, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। আর যে ক’টা গল্প শুনিয়েছিলাম তার মধ্যে প্রযোজকদের এটাই সবচেয়ে ভাল লাগল।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’-কে কেন বেছে নিলেন?
অনির্বাণ: সময়ের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের কোনও সাযুজ্য নেই। জাস্ট দর্শককে এন্টারটেন করতে চাই। এবং নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী দর্শককে এন্টারটেন করা, প্রেক্ষাগৃহে ফিরিয়ে আনাটাই মূল উদ্দেশ্য। সব দিক মাথায় রেখে, পরিবারের সবাই মিলে দেখতে গিয়ে যাতে আনন্দ পায় তাই এই প্রচেষ্টা।
প্রযোজকদের তরফে কোনও দাবি ছিল যে সপরিবার দেখার ছবি তৈরি করতে হবে?
অনির্বাণ: না, সেসব কিছু বলেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন আমি একটা ছবি পরিচালনা করি।
সিনেমা তো শুধু সাহিত্যের ট্রান্সলেশন নয়। আপনি এবং প্রতীক যখন চিত্রনাট্য লিখছেন, তখন আপনাদের নিজস্ব কোনও ইনপুট? বা কীভাবে দেখেছেন ‘বল্লভপুরের রূপকথা’-কে?
অনির্বাণ: আসলে নাটকটা খুব ভাল। খুব বড় মানুষের লেখা তো! ফলে যেটা হয়, চরিত্রগুলো খুব ‘সত্যি’ বা রিয়্যাল। হাসি-মজা সব কিছুর মধ্যে চরিত্রগুলো খুব ‘ট্রু’ হয়ে ওঠে। এবং কখনওই সুপারফিশিয়াল বা ফেক হয় না। ফলে এই ধরনের টেক্সট নিয়ে কাজ করলে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে ‘রিয়্যাল’ বা ‘সত্যি’ মানুষের গল্প বলতে পারছি যদিও সমাজে কোনও গভীর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি না। সত্যি বলতে কী, সিনেমায় আমাকে সবসময় ফ্যাসিনেট করেছে বিভিন্ন মানুষের গল্প। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা বা ফিলজফির চাইতেও আমাকে সিনেমার উপাদান হিসাবে ‘মানুষ’ এবং তার গল্প অনেক বেশি নাড়া দেয়। রাজনীতি বা অন্যান্য বক্তব্য আসলে তার হাত ধরেই আসে। আর শক্তিশালী লেখকের গল্প নিয়ে কাজ করলে ‘সত্যি’ মানুষগুলোর গল্প এক্সপ্লোর করা যায়। এবং এটা খুব সহজ কাজ নয়। দেখা যাক আমরা কতটা করতে পেরেছি। এখানে আমার আলাদা কোনও ইন্টারপ্রিটেশন নেই। একটা নাটককে আমরা সিনেমায় ট্রান্সফার করেছি। তার জন্য চিত্রনাট্যে যা যা করতে হয়েছে, আমরা তাই করেছি। আমরা আসলে এই নাটকটাই করতে চেয়েছি। ছবিতে এমন কোনও দৃশ্য নেই যেটা নাটক থেকে উঠে আসছে না।
‘মন্দার’-এর জগৎ বেশ অন্ধকার। সেই কারণেই কি এমন একটা বিষয় বাছলেন যেটা অপেক্ষাকৃত হালকা বা কমিক্যাল?
অনির্বাণ: হ্যাঁ, সেটা তো করতে ইচ্ছেই করছে। আর মূলত এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া বড় পর্দার কারণে। যেমন ‘মন্দার’ যদি কেউ আমাকে বলে, বড় পর্দার কনটেন্ট কি না, আমি বলব, ‘না’। আমাদের দেশে দর্শক এখনও দলে-দলে গিয়ে ওই ডার্ক কনটেন্ট দেখা পছন্দ করবেন না। বড় পর্দার একটা আলাদা ব্যাপার আছে। আর এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম, মূলত বড় পর্দার ছবি করছি বলে। ইট শুড বি এন্টারটেনিং। আমি বিনোদনকে খুবই গুরুত্ব দিই। অবশ্যই সেটা মাথামুন্ডুহীন বিনোদন নয়। ‘মন্দার’-এর থেকে অন্য ধরনের বিনোদনমূলক কনটেন্ট বড় পর্দার জন্য লাগে বলে আমি মনে করি।
আপনার বড় পর্দায় কেমন ছবি দেখতে ভাল লাগে?
অনির্বাণ: আমি যে খুব রেগুলার বড় পর্দায় ছবি দেখি তা নয়। নোলানের ছবি বড় পর্দায় দেখতে ভাল লাগে। এটার যে একটা ইলেকট্রিফাইং এফেক্ট আছে, বলাই বাহুল্য। সেই অভিজ্ঞতাটা দারুণ লাগে। তবে আমার আলাদা করে কোনও বাছবিচার নেই। যে সিনেমাটা আমাকে সেই মুহূর্তে, কোনওরকমের প্রোপাগান্ডা এবং এজেন্ডা ছাড়া, সেই অন্ধকার হল-এ তৎক্ষণাৎ সেখানে বসে থাকার সময় আকর্ষণ করছে, আমাকে ঢুকিয়ে নিতে পারছে তার শরীরে– সেই সিনেমাই আমার ভাল লাগে। যেমন ‘৮৩’ দেখে খুব মুভ্ড হয়েছিলাম। তিনবার দেখেছি ছবিটা। ছবি দেখার ক্ষেত্রে আমার কোনও প্যাটার্ন না থাকলেও, খুব নাচ-গানে ভরপুর কমার্শিয়াল ছবি আমাকে টানে না। সেটা অস্বীকার করছি না।
[আরও পড়ুন: বিয়ে করছেন রকুলপ্রীত সিং, জানেন পাত্র কে? ]
‘হরর কমেডি’ বললেই সবার আগে মনে পড়ে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর কথা। পরবর্তীকালে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ বা ‘গয়নার বাক্স’ও হয়েছে…
অনির্বাণ: ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ আমার মতে খানিকটা পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। সোসাইটিকে ন্যারেট করছে এবং সেটাকে ‘মক’ করতে-করতে যাচ্ছে। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ একেবারেই তা নয়। ‘বল্লভপুর…’ আবার ‘গয়নার বাক্স’-র মতোও নয়। সেখানে খুবই স্ট্রং সোশ্যাল মেসেজ রয়েছে, সমাজে নারীর অবস্থান চিত্রিত করা হয়েছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসেই সেটা ছিল। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ বরং সিচুয়েশনাল কমেডি।
বাঙালি দর্শক যেখানে গুপ্তধনের নেশায় মেতেছে, এই ছবিটা কালীপুজোয় মুক্তি পেলে কেমন ফলাফল করবে? কী মনে হয়?
অনির্বাণ: আমি দর্শক সম্পর্কে এক্কেবারে কিছু জানি না। ২০২২ সালে এসে দর্শক সম্পর্কে কিছু বলা মানে বাতুলতা। একদম কোনও আইডিয়াই নেই আমার। আমি আশা করতে পারি, আমাকে যেটা কানেক্ট করেছে, আকর্ষণ করেছে, সেটা দর্শকের ভালই লাগবে। সব থেকে বড় কথা, পরিশ্রম করে, ফাঁকি না দিয়ে যত্ন করে দর্শকের ভাল লাগবে ভেবে একটা কনটেন্ট তৈরি করতে পারি। সেইটুকুই পারি। বাকি দর্শক কীসে মজবে সে সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম, আছি এবং অজ্ঞ থেকেই মরতে চাই।
পরিচালনা না অভিনয়, কোনটা বেশি এনজয় করেন?
অনির্বাণ: অভিনয়! পরিচালনা বড্ড চাপের জিনিস। ভীষণ কঠিন কাজ। স্ট্রেসের কাজ। টেনশনের কাজ। একজন অভিনেতার কাছে, ‘অভিনয়’ করাটা, অনেকটা তার কন্ট্রোলে থাকে। আমার শরীর, আমার গলা, আমার চোখ– কাজটা করার ক্ষেত্রে এখানে আমি কার্যকরী। আর ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে, পরিচালক শুধু ভাবছে, কমিউনিকেট করছে, কিন্তু একটা জিনিসও এগজিকিউট করছে না। অভিনয় করাটাই বেশি সহজ।