ম্যাচ শেষে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াননি। এমনকী, প্রথা মেনে সাংবাদিক সম্মেলনেও যাননি এটিকে মোহনবাগান (ATK Mohun Bagan) কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস (Antonio Habas)। আইএসএল (ISL 2020) ফাইনাল হেরে এতটাই ভেঙে পড়েছেন, হোটেলে ফিরে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি। অথচ এক রাশ হতাশা, রাগ তখন কুরে কুরে খাচ্ছে স্প্যানিশ কোচকে। এদিন রবিবারই গোয়া-মুম্বই হয়ে চলে গেলেন স্পেন। তার আগে টিম হোটেলে লাগেজ গোছানোর ফাঁকে শুধুমাত্র ‘সংবাদ প্রতিদিনে’র কাছে যাবতীয় দুঃখ, রাগ, হতাশা মেলে ধরলেন। শুনলেন দুলাল দে।
শুনলাম, সারা রাত নাকি দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি?
হাবাস: (অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর উত্তর এল) জানি না।
ম্যাচের পর নিয়ম অনুযায়ী সাংবাদিক সম্মেলনে কোচের থাকাটা বাধ্যতামূলক। অথচ আপনি সেই সাংবাদিক সম্মেলনেই গেলেন না? পুরোটাই কি হতাশা থেকে?
হাবাস: ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র সাংবাদিক সম্মেলনে গেলে বরং আরও খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারত। চাইনি পরিস্থিতি আরও খারাপ হোক।
বোঝা গেল না….।
হাবাস: ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন এলে স্বাভাবিক ভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম না। ওই উত্তজেক মুহূর্তে সব ক্ষোভ উগরে দিতাম। রেফারির সিদ্ধান্ত যে ভাবে আমাদের বিরুদ্ধে গিয়েছে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। সেই মুহূর্তে রাগে ফুঁসছিলাম। হয়তো এমন কিছু বলে ফেলতাম, যা পরে আমাকে এবং আমার পুরো দলকে আঘাত করত। উত্তেজক মুহূর্তে হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হত। তাছাড়া চাইনি, সাংবাদিক সম্মেলনে গিয়ে নিজেদের আরও হতাশ করে তুলতে। এইসব কারণেই ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র সাংবাদিক সম্মেলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিই।
[আরও পড়ুন: জানেন করোনা আবহে ISL আয়োজনে কত টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে এফএসডিএলের?]
হারটা মনে হচ্ছে এখনও মেনে নিতে পারেননি?
হাবাস: না পারিনি। কারণ, ম্যাচটা আমাদের হারার কথা ছিল না। আমরা হারলেও মাঠ ছেড়েছি মাথা উঁচু করে। আমার মনে হয় না, কেউ বলবে, ফাইনালে মুম্বইয়ের কাছে আমাদের হারা উচিত ছিল। হোটেলে ফিরেও অনেকবার ভেবেছি। এই হার থেকেই পরবর্তী সময়ের আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার শিক্ষা নিয়েছি।
আইএসএল ইতিহাসে তিনবার ফাইনালে উঠে আপনি এই প্রথমবার হারলেন?
হাবাস: শুধু আইএসএল ইতিহাস কেন? আমার কোচিং কেরিয়ারে এ পর্যন্ত ফাইনালে উঠে আমি দু’বার হারলাম। প্রথমবার হেরেছি, ’৯৭-এর কোপা আমেরিকা ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে। আমি তখন বলিভিয়ার জাতীয় কোচ ছিলাম। ম্যাচটা আমরা হেরেছিলাম, ১-৩ গোলে। মাথায় রাখবেন, সেদিন কোপার ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল ব্রাজিল। সেদিন শুরুতে ডেনিলসনের গোলে ব্রাজিল এগিয়ে গেলেও পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা গোল শোধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে রোনাল্ডো আমাদের শেষ করে দিয়েছিল। একটা গোল রোনাল্ডো করল। আরেকটা জে রবার্তো। ব্রাজিলের সেই দলটা ভাবুন একবার। তাফারেল, কাফু, রবার্তো কার্লোস, দুঙ্গা, ডেনিলসন, লিওনার্দো, রোনাল্ডো, জে রবার্তো, এডমু্ন্ডরা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, রোনাল্ডো, কাফুদের কাছে সেদিন হেরেও এতটা কষ্ট পাইনি, যা পেলাম শনিবার মুম্বইয়ের কাছে হেরে।
সদ্য হেরেছেন বলে স্মৃতিটা টাটকা, তাই?
হাবাস: সেটা একটা কারণ হতে পারে। কিন্তু শনিবার ট্রফিটা আমাদের ছিল। যেটা রোনাল্ডোদের বিরুদ্ধে সেদিন ছিল না। দুটো গোলই তো আমরা ওদের উপহার দিয়ে দিলাম। ওরা করল কোথায়?
শেষ মুহূর্তে অরিন্দম ওভাবে বেরিয়ে বলটা বুকে রিসিভ না করলেই বোধহয় ভাল করতেন?
হাবাস: প্লিজ, ম্যাচটা হারার জন্য কেউ অরিন্দমের দোষ দেবেন না। এখনও মনে করি, এবারের আইএসএলের সেরা গোলকিপার অরিন্দম। শেষ মুহূর্তে একটা ছোট ভুল দেখে পুরো প্রতিযোগিতায় ওর সেরা পারফরম্যান্সগুলোকে অস্বীকার করলে মারাত্মক ভুল হবে। অরিন্দম চ্যাম্পিয়ন গোলকিপার। কিন্তু ফুটবলে যোগ্যতা মাপার অদ্ভুত একটা প্যারামিটার রয়েছে। দিনের শেষে আপনি ট্রফিটা পেলেন কি না? নাহলে অরিন্দম এই মরশুমে যে ফুটবলটা খেলেছে, ওর দিকে কোনও আঙুল তোলাই উচিত নয়।
কিন্তু এটাও তো সত্যি দিনের শেষে ট্রফিটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ?
হাবাস: আপনি যে কোনও ফুটবলারকে ক্রস চেক করে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, ম্যাচের আগে ফুটবলারদের সঙ্গে আমার যে শেষ কথা হয়, সেখানে কী বলেছিলাম?
[আরও পড়ুন: সোমবার গোয়ায় চুপিসারেই সঞ্জনার সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়ছেন বুমরাহ?]
কী বলেছিলেন?
হাবাস: বলেছিলাম, ফাইনালে সব সময় সেরা দলটাই জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় না। কিন্তু ফাইনালে আমাদের সামান্যতম ভুলও করা যাবে না। পুরো ম্যাচ ভাল খেললেও, ছোট্ট কোনও ভুলই আমাদের শেষ করে দিতে পারে। আর প্লিজ, সবাই ভুলে যাবে মাঠে রেফারি আছে। এটা মাথায় নিয়ে খেলবে যে, মাঠে কোনও রেফারি নেই। মাথায় রাখত হবে, সব সিদ্ধান্তই আমাদের বিরুদ্ধে যেতে পারে। দিনের শেষ মিলিয়ে দেখে নিন, ফুটবলারদের বলা আমার বক্তব্যগুলি ঠিক ছিল কি না? আমরা জিতিনি। কিন্তু সেরা দল আমরা ছিলাম। দুটো ছোট ভুলে সব শেষ হয়ে গেল। আর রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভাল।
কেন?
হাবাস: আজ পর্যন্ত কোনওদিন শুনেছেন, সেমসাইড গোলে অফসাইড হয়! আমাদের বিরুদ্ধে রেফারি সেই সিদ্ধান্তটাও দিলেন। আসলে রেফারি দিতে চাননি। আমাদের সাইডে যে সহকারি রেফারি ছিলেন, তিনিই অফসাইডের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু ওটা যে সেমসাইড গোল কে বোঝাবে? আপনাদের সংবাদমাধ্যমেরও তো দায়িত্ব রয়েছে, রেফারি আর সহকারি রেফারিকে জিজ্ঞাসা করা, সেমসাইড গোল কীভাবে অফসাইডের কারণে বাতিল হয়?
বুমোস কিন্তু নড়তে পারেননি?
হাবাস: শুধু বুমোস কেন। শুরু থেকে পুরো মুম্বই দলটাই জায়গা পাচ্ছিল না। খেলাটা পুরো আমরাই নিয়ন্ত্রণ করছিলাম। শুরু থেকেই আমরা প্রেসিং ফুটবল খেলতে শুরু করেছিলাম। তবে মেনে নিচ্ছি, প্রথমার্ধের শেষ ২০ মিনিট মুম্বই খেলাটা আমাদের থেকে নিয়ে নিয়েছিল। বাকিটা তো আমরাই খেললাম। দু’দুটো ডিফেন্সের সামান্য ভুল আমাদের শেষ করে দিল। সঙ্গে রেফারির সিদ্ধান্ত।
আপনি নিশ্চয়ই আবার ঘুরে দাঁড়াবেন?
হাবাস: নিশ্চয়ই। বলতে পারেন, ভবিষ্যতের তৈরির জন্য আজ আমাদের প্রথম দিন। আচ্ছা, এবার থামছি। এবার এয়ারপোর্ট যেতে হবে। আশা করছি, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে। সমর্থকদের আমার তরফ থেকে সমবেদনা জানাবেন।