মুক্তির প্রথম দিনেই নেটজনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। এই মুহূর্তে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ট্রেন্ডিংয়ের শিরোনামে। কেমন হল অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত ক্রাইম থ্রিলার সিরিজ ‘পাতাল লোক’? লিখছেন সন্দীপ্তা ভঞ্জ।
পরিচালক- অবিনাশ অরুণ, প্রসিত রায়
অভিনয়ে- জয়দীপ আওলাত, নীরজ কবি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেশ শর্মা, গুল পানাং, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, আসিফ খান, জগজিৎ সাধু, অনিন্দিতা বোস।
‘পাতাল লোক’-এর অস্তিত্ব
স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল, এই তিন লোকের কথা হয়তো শৈশব থেকে আমরা অনেকেই শুনে এসেছি। তবে এই তিন লোকের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা এই মুহূর্তে অবাস্তব। কিন্তু আমাদের সামাজিক পরিকাঠামোয় শ্রেণিবিভেদ বিষয়টিকে তুলে ধরতে কোনও সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের প্লটে যে এভাবে ‘তিনটে দুনিয়াকে’ একসূত্রে গেঁথে দেওয়া যায়, তার প্রমাণ বোধহয় ‘পাতাল লোক’ই।
জোর যার মুলুক তার
পৌরাণিক ভাবধারার মোড়কে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিবৈষম্যকে তুলে ধরার চেষ্টা, রাজনৈতিক নেতামন্ত্রীদের কোরাপশন, তাদের ভোট ব্যাংকে বন্যা বওয়ার নেপথ্যে দেশীসাধুবাবাদের ফুকমন্তর থেকে ক্ষমতার খেলা, খুন-ধর্ষণ, রক্তারক্তি, বেডরুম সিন, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের মতো নানা উপকরণ মজুত এই ওয়েব সিরিজে। যা সমাজকে আয়নার সামনে দাঁড় করাবে। এককথায় ‘খুব যত্ন করে’ কষিয়ে একটা চড় মেরেছে সমাজের গালে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে পকেটে পয়সা না থাকলে তুমি চুনোপুটি। ঠান্ডা ঘরে বসে তোমার মতো চুনোপুটিকে অনায়াসেই পদতলে পিষে ফেলার ছক কষা যায়। ফুটপাতের চোর-ছেচ্চড় থেকে অনায়াসেই সন্ত্রাসবাদীর তকমা সেঁটে মামলার নিষ্পত্তি করা যায়! এই সিরিজ আবারও মনে করিয়ে দিল ‘জোর যার মুলুক তার’। দিল্লির হাই প্রোফাইল কর্পোরেট সেক্টর থেকে ভারতের ‘রুরাল’-রূপ, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিকাঠামোর একেবারে কঙ্কালসার রূপ তুলে ধরেছে এই ওয়েব সিরিজ। কোন পরিস্থিতিতে মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে, সেই মনস্তত্বের সঙ্গেও পরিচয় করাবে দর্শকদের ‘পাতাল লোক’।
মোড় ঘোরানো ৩ নম্বর এপিসোড
নামের সঙ্গেই সিরিজের কাহিনির সাযুজ্য রয়েছে। ‘পাতাল লোক’বাসী অর্থাৎ সমাজের সেই শ্রেণি, যাদের কথা শোনার কেউ নেই! তারা যেন নরকের কীটসম। যাদের কথা কেউ ভাবে না, তাদের কথাই তুলে ধরেছে ‘পাতাল লোক’। হাতিরাম চৌধুরী নামে এক পুলিশ অফিসারের জার্নির মধ্য দিয়েই সমাজের ফাটলগুলো দেখানোর চেষ্টা করেছেন পরিচালকদ্বয় অবিনাশ আর প্রসিত। মোট ৯টি পর্ব। খ্যাতনামা সাংবাদিককে খুনের ছক কষার গল্প এস্টাবলিশ করতে গিয়ে প্রথম দুটি পর্বে খানিক একঘেয়েভাব থাকলেও ৩ নম্বর এপিসোড থেকে কাহিনি মোড় নেয়। গল্পের ভিতরে ঢোকে। প্রতিটা পর্বের পরতে পরতেই রহস্য-রোমাঞ্চ ঘনিয়েছে।
সারাপ্রাইজ এলিমেন্ট ‘হাতোড়া ত্যাগী’
গ্লসি কাস্টিংয়ের চাকচিক্য নেই। নেই অতি অভিনয়ের ভাঁড়ামো। মজবুত প্লট। পুলিশ অফিসার হাতিরামের চরিত্রে জয়দীপ আওলাতের অভিনয়ের রেশ থেকে যায় শেষ হওয়ার পরও। কিন্তু এই ওয়েব সিরিজের সারাপ্রাইজ এলিমেন্ট ‘হাতোড়া ত্যাগী’ ওরফ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্রেও রহস্য আরও ঘনীভূত হয়েছে। জগজিৎ সাধু অভিনীত টোপ সিংয়ের চরিত্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে গল্পের প্লটে।
[আরও পড়ুন: জ্যাকলিনের ভোঁতা সংলাপ ও অভিনয়, জমল না ‘মিসেস সিরিয়াল কিলার’]
ধর্মবিভেদ, কর্মস্থলে মেরুকরণের রাজনীতি
এদিকে ছাপোষা মুসলিম পরিবারের অপরাধপ্রবণ ছেলে কবীর এম (আসিফ খান) এবং অন্যদিকে বিপরীত জগতে পুলিশকর্মী আনসারি, এই দুই চরিত্রের মধ্য দিয়ে ধর্মবিভেদ, কর্মস্থলে মেরুকরণের রাজনীতির কথা বলা হয়েছে। শৈশবে চোখের সামনে উগ্রপন্থীদের হাতে রাম নাম তুলে দাদাকে খুন হতে দেখার দৃশ্যই যে কবীর এমকে অপরাধপ্রবণতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, প্লটে সেটাও তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে মিসেস মেহেরার (স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়) সারমেয় প্রেমই যে স্বামী সাংবাদিক সঞ্জীব মেহেরাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়ে ছিল ‘হাতোড়া ত্যাগী’র হাত থেকে, সেই গল্পের সেই প্লটটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বদলে যাওয়া সমাজে সাংবাদিকদের অবস্থান
তবে উল্লেখ্য দেশে সাংবাদিকদের অবস্থান বোঝাতে এই গোটা ওয়েব সিরিজে সঞ্জীব মেহেরার (নীরজ কবি) একটা সংলাপই যথেষ্ট! “সাংবাদিকরা একসময় সকলের চোখে হিরো ছিল। এখন আমরা ট্রোলড হই, খুন হই, চাকরি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। সকলেরই ভবিষ্যৎ যেন গৌরী লঙ্কেশের মতো!” বদলে যাওয়া সমাজ, মন-মানসিকতার প্রতিচ্ছ্ববি তুলে ধরতে এই শব্দগুলোই বা কম কী!
[আরও পড়ুন: ‘ভালবাসায় বাঁচুক পৃথিবী’, বলছে ‘সিজনস গ্রিটিংস’]
The post জোর যার মুলুক তার! সমাজের নগ্ন রূপ তুলে ধরল ‘পাতাল লোক’ appeared first on Sangbad Pratidin.