অপরাজিতা সেন: গত কয়েকদিনের জল্পনার অবসান ঘটিয়ে রবিবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) দপ্তরে বঙ্গ রাজনীতির যে ঘটনাটি ঘটল, তা এককথায় তৃণমূলের মাস্টারস্ট্রোক। অর্জুন সিংয়ের
(Arjun Singh) পুরনো দলে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণার ধাক্কায় বাংলার বিজেপি শুধু আরও ব্যাকফুটে গেল তা-ই নয়, সামগ্রিক বিরোধী শিবিরকেই চাপে ফেলে উৎসাহিত হয়ে গেল তৃণমূল শিবির। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সম্মতিতে এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সক্রিয়তায় এদিনের অর্জুনপর্ব তৃণমূলের সাংগঠনিক দক্ষতারও পরিচয় দিল।
মাস্টারস্ট্রোক ১: টাইমিং-ঠিক যে সময় শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত বিতর্কে রাজ্য সরকার ও তৃণমূল কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে, মিডিয়ার একাংশে শোরগোল, বিরোধীরা রোজ গলা ফাটাচ্ছেন, কোর্ট এবং সিবিআই খবরের শিরোনামে, তৃণমূল কর্মীরা যেন একটু ডিফেন্সিভ, ঠিক সেই সময় অর্জুনের মতো বিজেপির ডাকসাইটে সাংসদকে ঘরে ফিরিয়ে আলোচনার অভিমুখ ঘোরালো তৃণমূল। মিডিয়াতেও এসএসসি ইস্যুর সঙ্গে বিকল্প ইস্যু ‘স্ক্রিন শেয়ার’ করল। একটানা তৃণমূলবিরোধী খবর ও জল্পনার মধ্যে একদম ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতমুখী তাস খেলে দিল তৃণমূল।
মাস্টারস্ট্রোক ২: তৃণমূল বারবার বলছে তাদের ৯৯ শতাংশ কাজ ভাল। এক শতাংশেরও কম কাজে ভুল হয়েছে। ভুল বা অন্যায় হলে সংশোধন হবে। অন্যদিকে বিরোধীরা এই ভুল বা অন্যায়কে হাতিয়ার করেই হাঁকডাক করছিলেন। এদিনের পর মানুষ আগের ধারণাতেই থাকবেন, এইসব বিরোধীদের দিয়ে কিসস্যু হবে না। কাজ তৃণমূল করবে। ভুল সংশোধনও করবে তৃণমূল। বিরোধীদের গুরুত্ব দেওয়াটাই ভুল। এরা কর্পূরশ্রেণির।
[আরও পড়ুন: কলেজের অধ্যক্ষ হতে চেয়ে আবেদনের ঢল রাজ্যে, ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে শতাধিক আবেদনপত্র]
মাস্টারস্ট্রোক ৩: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক যখন কৌশলগত কারণে অর্জুনকে নিচ্ছেন, দলের বাকি নেতারা মানতেন। কিন্তু রবিবার যে পদ্ধতি অভিষেক দেখালেন, তা সংযত এবং গভীর পরিকল্পনাপ্রসূত। অর্জুন (Arjun Singh) বিজেপিতে যাওয়ার পর যে নেতারা ওই এলাকায় লড়েছেন, তৃণমূলকে আবার সাফল্য দিয়েছেন, এদিন অভিষেক তাঁদের সম্মান দিলেন। তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তাঁদের মধ্যে অর্জুনকে এনে তিক্ততা ভোলানোর সমন্বয় বৈঠক করলেন। সবশেষে এই নেতাদের দিয়েই অর্জুন-সহ সাংবাদিক বৈঠক করালেন। নিজে থেকে গেলেন শুধু টুইটে, ছবিতে। যাঁদের মিলেমিশে কাজ করতে হবে, তাঁদেরই সামনে এগিয়ে দিলেন। সঠিক পদক্ষেপ।
মাস্টারস্ট্রোক ৪: অর্জুন কোনও বড় তিক্ততার কারণে বিজেপিতে যাননি। গিয়েছিলেন শুধু ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে দীনেশ ত্রিবেদী তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার ক্ষোভে। তিনি প্রার্থী হলে যেতেন না। নেতৃত্ব এটা জানে। পরে জিতে অর্জুন প্রমাণ করেছিলেন, দীনেশকে ফের প্রার্থী করা তৃণমূলের ভুল ছিল। এহেন অর্জুনকে ফেরানোর প্রশ্নেও অন্তত প্রথম দিন একটি ব্যারিকেড রাখল তৃণমূল। সর্বোচ্চ নেত্রীকে প্রথম দিন দেখা গেল না। অভিষেক সবটা করলেও নিজে সরাসরি এলেন না সামনে। দল ছেড়ে গিয়ে আবার ফেরা, হতে পারে রণকৌশলে দল এখন রাজি, বিজেপিকে দুরমুশ আগে দরকার, তবু, এই প্রথমদিনের ব্যারিকেডটাও বার্তা বটে। তবে ৩০ মে বারাকপুরে জনসভা করবেন অভিষেক। জমবে। কিন্তু সব দেখা গেলেও হাতে পতাকা নেওয়ার ছবি দেখা গেল না কেন? নেহাত ঘটনাচক্র, নাকি পরিকল্পিত সুচারু কৌশল, যা ভবিষ্যতে লোকসভার স্পিকারের কোনও সম্ভাব্য চিঠির সম্ভাব্য উত্তরের সম্ভাব্য উপাদান হিসাবে তোলা থাকল।
মাস্টারস্ট্রোক ৫: গতবার লোকসভায় অর্জুন জিতলেও এলাকায় বিধানসভা, পুরসভায় তৃণমূলের রমরমা। অর্জুন চাপে পড়ছিলেন। তাঁকে ছাড়াও হয়তো এলাকা থাকত তৃণমূলের, কিন্তু অর্জুন এলে বিজেপি কর্মীদের মনোবল ভাঙবে সারা রাজ্যে। বিজেপির বহু পদে, বহু দায়িত্বে ছিলেন বাহুবলী হেভিওয়েট অর্জুন। তাঁর মুখে বিজেপির সমালোচনা, ফেসবুকের পার্টি, এসি ঘরে বসে রাজনীতির পার্টি, বাংলার ঘরানা না বুঝে রাজনীতির পার্টি, এইসব কথা বিজেপিকে বেআব্রু করে দিতে শুরু করেছে। বিজেপি কর্মীরা ভাববেন, কোন নেতাকে বিশ্বাস করব, কবে আবার চলে যাবেন। এই অনাস্থা, অবিশ্বাসের বাতাবরণ ছিলই; সেটা আরও গতি পেয়ে গেল রবিবার।
মাস্টারস্ট্রোক ৬: অর্জুনের (Arjun Singh) প্রত্যাবর্তনের পর প্রশ্নটা অবধারিত ছিল, সাংসদপদ ছাড়ছেন? অর্জুনের জবাব, “তৃণমূলের দুই সাংসদ তো বিজেপি করছেন। আগে ওঁরা ছাড়ুন। আমি রেডি আছি। দল বললেই ছাড়ব।” এই অবস্থান চমকপ্রদ। শিশির অধিকারী বিজেপির মঞ্চে বসে বিশ্বাসঘাতকতার নমুনা রাখবেন আর বাবুল সুপ্রিয় ইস্তফা দেবেন, এসব তো দেখলাম। এবার অর্জুনের এই মোক্ষম প্যাঁচালো যুক্তিটিও দেখা হোক।
[আরও পড়ুন: নবান্নে মন্ত্রিসভার বৈঠক, রয়েছে একাধিক জরুরি আলোচনা, তলব করা হল শুভেন্দু অধিকারীকে]
মাস্টারস্ট্রোক ৭: বিজেপির ভিতরটা ভঙ্গুর। আদি বনাম তৎকাল। সঙ্গে পরিযায়ীদের ডায়ালগবাজি। অন্যদল থেকে একের পর এক নেতা নিয়েই গ্যাসবেলুন। দিল্লির নেতারা বুঝুন, এখানে গুটিকয়েক অপদার্থ পুষছেন। একের পর এক নেতা বিজেপি ছাড়ছেন। তার মধ্যে পাটশিল্পের ইস্যু তুলে ধরা যথেষ্ট চতুরতার রাজনীতি। প্রমাণ হল বাংলার স্বার্থে এই বিজেপি কাজ করে না। দিল্লির বিজেপি সরকার বাংলার বন্ধু নয়।
এই মাস্টারস্ট্রোকগুলি তৃণমূলের তরফে। এগুলি রাজনীতির ময়দানে সঠিক ও সময়োপযোগী। তবে, তৃণমূলকেও নজর রাখতে হবে, ওই এলাকায় দলের দুর্দিনের নেতা-কর্মীদের উপর। বহু ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা লড়াই করেছেন। যাঁরা চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাই যদি এসে ওই এলাকায় মাতব্বরি করেন, সেটা যন্ত্রণার। তৃণমূল নিশ্চয়ই মনে রাখবে। রবিবার আবারও বোঝা গেল, দলে শেষ কথা নেত্রীই। কিন্তু আগামী দিনের জন্য তাঁর যোগ্য সেনাপতি এবং উত্তরসূরি চওড়া কাঁধে লম্বা ইনিংসের জন্য তৈরি রাখছে তৃণমূলকে, তিনি অভিষেক। শেষ কথা, প্রলাপপ্রতিম দিলীপ ঘোষ দেখলাম বললেন, প্রশাসনিক চাপের ভয়ে অর্জুন বাধ্য হয়ে তৃণমূলে ফিরেছেন। তা ও দিলীপবাবু, তাহলে আপনার কথা অনুযায়ী, সিবিআই, ইডির ভয়েই শুভেন্দু অধিকারী দলবদলে আপনাদের চৌকাঠে গলায় বকলস পরে বসে আছে, মানছেন কি?