অর্ণব আইচ: অটো কিনে চালাবে বাংলাদেশ (Bangladesh) থেকে আসা দরিদ্র বন্ধু। তাই তার একটা পরিচয়পত্রের প্রয়োজন। এই বলেই বেহালার (Behala) বরিশার এক বৃদ্ধের কাছ থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য তাঁর ভোটার পরিচয়পত্রটি নেয় জামাত উল মুজাহিদিন (বাংলাদেশ) বা জেএমবির ‘কলকাতা মডিউলের’ লিঙ্কম্যান সেলিম মুন্সি। আর তাতেই কেল্লা ফতে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেলিম ও তার সঙ্গী শাকিল তৈরি করে ফেলে জেএমবির বাংলাদেশের পাণ্ডা নাজিউর রহমান পাভেল ওরফে জোসেফের ভুয়া পরিচয়পত্র। নাজিউরের নতুন পরিচয় হয় জয়রাম ব্যাপারী। আর তার বাবা বলে পরিচয় দেওয়া হয় বড়িশার সেই বৃদ্ধকেই, যাঁর নাম গণেশ ব্যাপারী। মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে গোয়েন্দারা।
কীভাবে অতি সহজে জঙ্গিদের ভুয়ো পরিচয়পত্র তৈরি করে তাদের কলকাতার (Kolkata) বাসিন্দা হওয়ার ব্যবস্থা করেছে জেএমবির লিঙ্কম্যানরা, সেই তথ্য হাতে এসেছে গোয়েন্দাদের। দক্ষিণ শহরতলির হরিদেবপুর থেকে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) হাতে গ্রেপ্তার হয় তিন জেএমবি জঙ্গি নাজিউর রহমান পাভেল, মেকাইল খান ওরফে শেখ সাব্বির ও রবিউল ইসলাম। এবার তাদের কতজন সঙ্গী তথা জেমএবির জঙ্গি সদস্য কলকাতা বা আশপাশের জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে, তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। একইসঙ্গে ধৃত জঙ্গিদের জেরায় উঠে এসেছে একের পর এক অসঙ্গতি। মঙ্গলবার লালবাজারে জঙ্গিদের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা ও এনআইএ আধিকারিকরা জেরা করেন। এর আগে মুর্শিদাবাদ থেকে এনআইএর হাতে ধরা পড়েছে জেএমবির জঙ্গি। এই জঙ্গিদের সঙ্গে খাগড়াগড়ের কোনও যোগ রয়েছে কি না, এনআইএ তা খতিয়ে দেখেছে। জেরার মুখে কখনও জঙ্গিরা গোয়েন্দাদের কাছে দাবি করেছে যে, তাদের কলকাতা মডিউল তৈরির জন্য রাখা হয়েছে। আবার কখনও তারা বলেছে, বাংলাদেশের জেলের ভিতরে বসেই জেএমবি নেতা আল আমিন ও নাহিদ তসনিম তাদের অন্য রাজ্যে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এমনকী, মধ্য প্রাচ্যে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল নাজিউরদের। সেই সূত্র ধরে তাদের জেরা করে সিরিয়া ও আইএসআইএস যোগও গোয়েন্দারা জানার চেষ্টা করছেন। নাজিউরের গ্রেপ্তারির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। কারণ, নাজিউর এখন জেএমবি হলেও বাংলাদেশে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে আল কায়দার কাছ থেকেই। সে নিজে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের কাশিমপুর জেলে থাকার সময়ই বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বা বিজিবির চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়া নাজিউরের সঙ্গে পরিচয় হয় বাংলাদেশের আল কায়দা তথা আনসারুল্লা বাংলা টিম বা এবিটির এক নেতা পিয়াস শেখের সঙ্গে।
[আরও পড়ুন: দিল্লি থেকে নেপালে পালানোর ছক কষেছিল ধৃত ভুয়ো CID অফিসার, প্রকাশ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য]
দু’বছর আগে নাজিউর ও পিয়াস দু’জনই জেল থেকে বের হওয়ার পর একে অন্যের সঙ্গে দেখা করে। এবিটির কাছ থেকেই নাজিউর বিস্ফোরকের প্রশিক্ষণ নেয়। এরপর তারা দু’জনই জেএমবির হয়ে কাজ শুরু করে। জেএমবির কয়েকজন সদস্য পিয়াস শেখ, আনোয়ার আলি ওরফে হৃদয়, হাফিজুল শেখ ওরফে সকাল, আবু সালে, সোহেল বা তাদের সঙ্গীরা চোরাপথে বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায় এসেছে কি না, এবার সেই সন্ধান চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা। এই জঙ্গি সদস্যরা ডাকাতির মতো অপরাধের সঙ্গেও যুক্ত। তাই কলকাতায় জঙ্গিরা ‘রবারি উইং’ খুলে ব্যাঙ্ক, সোনার দোকান বা পেট্রোল পাম্পে ডাকাতির ছক কষেছিল কি না, সেই তথ্য জানার চেষ্টা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের মতে, কলকাতায় জেএমবির দুই লিঙ্কম্যান সেলিম মুন্সি ও শাকিল কতজনের ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি ও কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করেছে, সেই তথ্য জানার প্রয়োজন রয়েছে। ধৃত জঙ্গিদের ডায়েরি থেকে বেশ কিছু বাংলাদেশি ও ভারতীয় মোবাইল নম্বর উদ্ধার হয়েছে। সেগুলির সূত্র ধরে চলছে তদন্ত। আরও তথ্য পেয়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন লালবাজারের এসটিএফের গোয়েন্দারা। নাজিউরের ভায়রা ভাই আলআমিন নিজে হুজি নেতা হওয়ার কারণে নাজিউরের সঙ্গে বাংলাদেশের হুজি নেতাদেরও যোগাযোগ রয়েছে বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। এদিকে, গোয়েন্দারা জেনেছেন, সরাসরি ফোন না করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও চ্যাট করত তারা। ভিডিও চ্যাটেই লিঙ্কম্যান সেলিম মুন্সির কাছে বাংলাদেশ থেকেই নির্দেশ আসে যে, নাজিউর কলকাতায় নতুন মডিউল তৈরির কাজে যাবে। তার জন্য তৈরি করতে হবে ভারতীয় পরিচয়পত্র। যদিও আগেই মেকাইল খান সাব্বির নাম নিয়ে হরিদেবপুরে আসে। ছাতা সারাইয়ের পেশায় থাকার কারণে পুরো বেহালাজুড়ে হেঁটে ঘুরত সেলিম। সেই সূত্র ধরেই তার সঙ্গে আলাপ বরিশার বৃদ্ধ গণেশ ব্যাপারীর।