সোম রায়, শরিফাবাদ: “পাগল হো ক্যায়া? পহলে প্রেস স্টিকার হটাইয়ে!”
‘এলওসি’র গায়ে লেগে থাকা সিলিকোট গ্রাম। সেখানকার চেকপোস্টে দাঁড়িয়েই হুড়মুড়িয়ে একথা বললেন দুই বিএসএফ জওয়ান। যেমন কথা, তেমনি কাজ। অতঃপর গলার সুর নামল তাঁদের। মিনিট পনেরোর খোশমেজাজে আড্ডা। প্রথম প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই প্রেস স্টিকার খুলতে কেন অতটা জোর দিলেন তাঁরা। সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে আমোল আপ্তে বললেন, “এই যে পাহাড় দেখছেন, ওটা পাকিস্তান। বাঙ্কারগুলোর দিকে তাকান, ওদের ফ্ল্যাগ দেখতে পাচ্ছেন? হয়তো স্নাইপার বন্দুক নিয়ে বসে আছে। প্রেসের গাড়ি দেখে যে কিছু করে বসবে না, কোনও ঠিক আছে?”
ততক্ষণে স্টিকার খুলে ফেলেছেন ড্রাইভার সাবির ভাই। ওঁদের কথামতো চলার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম কোনওভাবে যদি চেকপোস্টের ভিতরের গ্রামে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায়। তবে লাভ হল না কোনও। একবার নাকি কোনও এক মিডিয়া গ্রামে গিয়ে এমন কিছু শুটিং করে গিয়েছিল– যা ‘আপত্তিকর’। তারপর থেকেই অনেক সতর্ক তাঁরা।সতর্কতার এই ছাপ অবশ্য পেয়েছিলাম আরও ঘণ্টাখানেক আগে।
সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম উরির উদ্দেশে। জানতাম সাড়ে তিন বছর আগে আক্রমণ হওয়া ক্যাম্পের ভিতরে ঢোকা যাবে না। চেয়েছিলাম সেই ক্যাম্পের কাছাকাছি কোনও গ্রামে অন্তত যেতে। কাজটা মোটেই সহজ নয়। এমনিতে উরি হল সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা। সেখানে নিরাপত্তার মারাত্মক কড়াকড়ি। ২০১৬-র ১৮ সেপ্টেম্বরের পর যা বেড়েছে আরও। উরি বাজারের পরই সেনা চেকপোস্ট, যা পার করতে নিতে হয় স্পেশাল পারমিট। তার খোঁজ করতেই ঢুকলাম উরি থানায়। দেখলাম পাকিস্তানের দু’টি লরি সেখানে দাঁড়ানো। নম্বর প্লেট দেখে বুঝলাম ‘পেশোয়ার’। শুনলাম, আফিম বোঝাই অবস্থায় আটক করা লরি দু’টি প্রায় দেড় বছর ধরে এখানে পড়ে আছে।
ভিতরে গিয়ে জানা গেল পারমিট পেতে যেতে হবে পাশেই এসডিপিও অফিসে। তার আগে সামনের স্টেশনারি দোকান থেকে ফর্ম ফিলআপ করে নিতেও বললেন উরি থানার মুনশি। কিন্তু ভিতরে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হল। দায়িত্বে থাকা অফিসার বললেন, “প্রেসকে পারমিট দেওয়ার অনুমতি আমাদের নেই। আপনি চেকপোস্টের সামনে মিলিটারি পুলিশের সঙ্গে কথা বলুন। ওরাই কিছু করতে পারে।” চেকপোস্টের কাছে গিয়েও লাভ হল না। গেটের সামনে ডিউটিতে থাকা হাবিলদার সব শুনে বললেন, “ওই কাউন্টারে স্যর আছেন। ওঁকে জিজ্ঞেস করুন।” ‘স্যর’ অবশ্য রাজি হলেন না। বললেন, “আমরা অ্যালাউ করতে পারি না। উপরমহল থেকে যদি অনুমতি থাকত, তাহলে হত।” সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। হোটেল থেকে বেরিয়েছি পৌনে দশটায়। উরি চেকপোস্টে যখন হতাশ হয়ে পড়েছি, তখন প্রায় দু’টো। পেটে দানাপানি দিতে দিতে আমার ‘সবেধন নীলমণি’ সাবির ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। বললেন, “দেখুন দাদা, উরির কাছের গ্রামে যেতে হলে ওই রাস্তা ছাড়া উপায় নেই। হ্যাঁ যদি ‘এলওসি’-র দিকে যেতে চান, নিয়ে যেতে পারি।”
শাবাশ তোপসে! ‘এলওসি’ কথাটা শুনেই কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! এ সুযোগ তো বারবার আসে না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কতক্ষণ লাগবে?’ উত্তর এল এক-আধঘণ্টা। এরপর আর অন্য কিছু ভাবার কথা মাথাতেই আসেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলাম সিলিকোট গ্রামের সামনে। সেখানেই প্রেস স্টিকার খুলতে বলেছিলেন দায়িত্বে থাকা দুই বিএসএফ জওয়ান। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময়ই চেকপোস্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ভেড়া। তার পিছন পিছন ১৭-১৮ বছরের এক যুবক। জওয়ানদের অনুরোধ করলাম, “এই তো যাতায়াত হচ্ছে। আমাকেও যেতে দিন!” বললেন, “ও তো গ্রামের ছেলে। দাদা অনুরোধ করবেন না। রাখতে পারব না।”
সময় নষ্ট না করে গাড়ি ঘোরালাম। একটু এগোতেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা। জানতে পারলাম গ্রামে ২৭টি পরিবারের বাস। কথায় কথায় বেরিয়ে এল, “এমনিতে এখানে খুব একটা সমস্যা হয় না। তবে মাঝে মধ্যে রাতের বেলা ওপার থেকে গুলির আওয়াজ হয়। গতবছর তো গ্রামের একটু বাইরে বোমাও পড়েছিল। জানেন, আমরা খুব ভয়ে থাকি। ভারতের সেনারা আমাদের কোনও সমস্যা করে না। কিন্তু ওপার থেকে যদি কিছু উড়ে আসে…”
কথাটা শেষ হল না। কেমন একটা ভয় জুড়ে বসল ছেলেটার মুখে। ভেড়াটা আগেই পালিয়েছিল। মোবাইল বের করে ছবি তুলতে যেতে ছেলেটাও পালাল। পাহাড়ের কোন খাঁজে ঢুকে গেল আর দেখতে পেলাম না।
পাহাড়ের গা বেয়ে নামার পথে দূরে সেই অভিশপ্ত ক্যাম্প দেখালেন সাবির ভাই। ঘুমের ঘোরে যেখানে প্রাণ গিয়েছিল ১৯ জন নিরপরাধ সৈন্যর। আরও কিছুটা এগোতে পেলাম জে অ্যান্ড কে ব্যাঙ্কের এটিএম। ভিতরে এক বয়স্ক লোক টাকা তুলছিলেন। বাইরে থাকা গার্ডের সঙ্গে সেই ছুতোয় গল্প শুরু করলাম। এটিএম-এর পাশেই পরপর কয়েকটি বন্ধ দোকান। গার্ডের থেকে জানলাম সারা বছর এগুলো বন্ধই থাকে। আগস্টের শেষ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এখানে চলে ড্রাই ফ্রুটের ব্যবসা। এই অঞ্চলই নাকি শুকনো ফলের ঠেক। হঠাৎ মাথায় এল সাড়ে তিন বছর আগে যখন উরিতে আক্রমণ হয়েছিল, সেই সময়টা তো তাহলে এখানে ব্যবসার টপ সিজন। দিকশূন্যপুরে তাকিয়ে বললেন, “আর বলবেন না। সেবার সবার মাথায় হাত পড়ে গিয়েছিল। ব্যবসা চৌপাট! ওই ঘটনার পর নিরাপত্তার কড়াকড়ি প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। গোটা এলাকা ভয়ে চুপসে গেছিল। আসলে কি জানেন তো, ওপার থেকে গোলাগুলির আওয়াজ এলেও এত কাছ থেকে অত বড় আতঙ্ক এখানে কেউ দেখেনি। বাচ্চা, বুড়ো, মহিলারা তো বটেই, আমরাও ঘরের বাইরে বেরোতে খুব ভয় পেতাম।”
খরস্রোতা ঝিলম নদীর পাশ দিয়ে ফিরে আসছিলাম শহরে। শ্রীনগরের থেকে উরির তাপমাত্রা অনেকটাই বেশি। না, সেই ঘটনার জন্য নয়। ভৌগোলিক নিয়ম মেনেই। শ্রীনগরে আসার পর এই প্রথম এতটা ঘামলাম। তাপমাত্রার জন্য তো বটেই। সঙ্গে দূর থেকে নজরে আসা উরি ক্যাম্পের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ার রাগ ও এলওসি-র কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার উত্তেজনার কারণেও। কেমন একটা ঘোরের মতো লাগছিল পুরোটা। এই সেই উরি, যার জন্য ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’। দেশের সাম্প্রতিক সামরিক শক্তি দেখানোর মাতৃভূমি। অথচ এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না, উরি কতটা শান্ত একটা জায়গা। এখানে না আছে পাত্থরবাজ। না সন্ত্রাসবাদ। তবু সেই উরির মাটিকেই রাঙা হতে হয়েছিল রক্তে। কেন? কী দোষ ছিল ঘুমিয়ে থাকা জওয়ানদের?
The post এখনও আতঙ্কেই দিন কাটে উরির বাসিন্দাদের appeared first on Sangbad Pratidin.