shono
Advertisement

নিজভূমে পরবাসী, ২১ দিন শিলচরের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক যুবক

কেমন আছেন ডিটেনশন ক্যাম্পের বাসিন্দারা? দেখুন ভিডিও। The post নিজভূমে পরবাসী, ২১ দিন শিলচরের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক যুবক appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 06:57 PM Aug 04, 2018Updated: 07:46 PM Aug 04, 2018

মণিশংকর চৌধুরি, শিলচর: আতঙ্কের প্রহর গুনছেন জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে নাম না আসা মানুষগুলি। বাঙালি অধ্যুষিত বরাক ভ্যালি যেন অজানা আশঙ্কায় একেবারে চুপ মেরে গিয়েছে। বাতাসে কান পেতে যেন আশঙ্কার পদধ্বনি শুনতে চাইছেন বাসিন্দারা (আদৌ বাসিন্দা কি?)। এই বুঝি দরজা খটখটিয়ে জানিয়ে দিল, এবার ডিটেনশন ক্যাম্পে যাওয়ার সময় হয়েছে। সরকার বাহাদুরের কলমের খোঁচায় যদি অসমিয়াদের নাগরিকত্ব বাদ যায় তাহলে তাঁদের কী হবে? খানসেনাদের অত্যাচারে একদিন প্রাণ বাঁচাতে সিলেটের এপারে চলে এসেছিলেন অনেকেই। তারপর কুড়ি-কুড়ি বছর গিয়েছে। আপন মাটি তো আরও আপনার হয়ে উঠেছে। রাতের অন্ধকারে একদিন প্রাণ বাঁচাতে ওপার বাংলা (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছেড়েছিলেন ভুলেই গিয়েছেন। সন্তান সন্ততির কাছে এখন এটাই তাঁদের বাপ পিতেমোর ভিটে। অবিভক্ত অসমের সিলেট জেলার বাড়ি এখন বিদেশ (বাংলাদেশ)। সে বাড়ি আদৌ কারা দখলে নিয়েছে কিছুই জানেন না। আন্তর্জাতিক নিয়মে দু’ভাগ হয়ে যাওয়া জেলার মাঝে কাঁটাতার উঠলেও সবুজ চা-বাগানের হাতছানি কখনও অচেনা মনে হয়নি। কবে যেন একপাড়া এক গ্রামের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। পল্লিবধূ সন্ধ্যা নামলে গলায় আঁচল জড়িয়ে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। দূরে মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। কেউ বা আজান শুনে নমাজের জন্য তোড়জোড় করছেন। হেসেখেলে কাটিয়ে দেওয়া দিনগুলো আজকাল স্বপ্নের মতো লাগে। মনে হয় ভোরবেলা এই দেখেই বোধহয় ঘুম ভেঙেছে। তাই চোখে লেগে আছে সেসব সুখের মুহূর্ত। চোখ খুলতেই কঠোর বাস্তব যেন প্রশ্ন করছে তুই বিদেশি। গোটা বাড়ি, উঠোন, বাগানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে ‘বিদেশি, বিদেশি’।

Advertisement

[নাগরিকপঞ্জিতে নেই কালিকাপ্রসাদের ভাইঝির নাম, অসমে ভ্রান্তির বহর]

৪৭-র স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত অসমের বাসিন্দা। দেশ ভাগ হলেও জন্মভিটে ছেড়ে যেতে চাননি অনেকেই। কেনই বা যাবেন? এই মাটি জল হাওয়ায় বড় হয়েছেন। এখানের শ্মশানে, কবরে শুয়ে আছেন পিতৃপুরুষরা। আজ আচমকা এনআরসি তাঁদের বিদেশি হিসেবে দাগিয়ে দিল। এই অপমানের বোঝা কীভাবে বইবেন বুঝতে পারছেন না। চুল পাকিয়ে এখন নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার সময় হয়েছে। ইতিমধ্যেই খবর এসেছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে অজস্র ভুল। সেই ভুলের ভারে বোড়োল্যান্ডের বাসিন্দাদের নাগরিকত্বও বাদ পড়েছে। নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যরাও। মাঝেমধ্যেই উড়ো খবর আসে। কোনওটা গুজব বলে উড়িয়ে দেন, কোনওটা আতঙ্কেই বিশ্বাস করে ফেলেন। গোয়ালপাড়া জেলার ডিটেনশন ক্যাম্প আড়েবহরে বেড়েছে। সেখানে নাকি একসঙ্গে অনেক সন্দেহভাজন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে রাখা যাবে। বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা ফের জেগে ওঠে। চলতি মাসের সাত তারিখে ভুলে ভরা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি আবার ঝাড়াই বাছাই হবে। ৪০ লক্ষ অসমবাসীর ভবিষ্যৎ এখন ওই সরকারি আধিকারিকদের হাতে। কে থাকবেন আর কেইবা বাদ পড়বেন। জীবনী শক্তি নিংড়ে দিয়েই আশ্রয়কে বাঁচাতে সকলে তৎপর। পথচলতি মানুষ পরস্পর পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, কাছারে যেন অপার নীরবতা। বাংলা ভাষা নিয়ে অসমের বাঙালিদের লড়াই তো আর ভুলে যাওয়ার নয়। তবে দুঃখের বিষয়, বাঙালি নয় জাতীয় নাগরিকপঞ্জি আজ তাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’র ছাপ মেরে দিয়েছে।

[জমা পড়েনি আবেনপত্র, নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর নাম]

সোমবারের পর থেকে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পের চৌহদ্দির মধ্যে কড়া নিরাপত্তা বলয়। বাইরের একজনও যেন ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। আচ্ছা কারাগারে বন্দি হয়ে দিনযাপন কতটা ভয়াবহ হয়? আইনের চোখে অপরাধীরাই এর সঠিক জবাব দিতে পারবে। ডিটেনশন ক্যাম্পের আশপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সন্দেহভাজন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কথা আগে কখনও ভাবার চেষ্টা করেননি। আজ করছেন, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ভাবাচ্ছে। সংশোধন পরিমার্জনের পর হয়তো ৩০ লক্ষ অসমবাসী ভারতীয় হিসেব প্রমাণিত হবেন। কিন্তু বাকি ১০ লক্ষ? তাঁরা কোন দেশি হিসেবে বিবেচিত হবেন? তাঁদের কোথায় রাখবে অসম সরকার? ১০ লক্ষ মানুষকে রাখার মতো ডিটেনশন ক্যাম্প এখনও অসমে নেই। তাহলে কি হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে অন্ধকার ঘুপচি ঘরে একসঙ্গে বন্ধ করে রাখা হবে! সেখানে পৌঁছায় তো ভোরের আলো? পূব আকাশ রাঙা হওয়ার আগে নমাজ পড়ার সুযোগ কি সেখানে মিলবে? কী খেতে দেয় সেখানে? বাড়ির সবাই একই ক্যাম্পে আশ্রয় পাব তো? নাকি প্রথম দেশ যাবে, পরে পরিবার? সব থেকে ছোট সদস্যের বয়স মাত্র চার। তার মায়ের নাম বাদ গিয়েছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির খসড়া থেকে। মাকে ছেড়ে কোথায় থাকবে একরত্তি? জানেন না। এমনও হাজার হাজার ব্যথায় ভারী হয়ে উঠেছে বরাক ভ্যালির বাতাস। কান পাতলেই সেসবের ফিসফিসানি শুনতে পাওয়া যায়। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পের দিকে। কড়া নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরেছে চৌহদ্দি। ক্যাম্পের সামনে দিয়েও যেতে দিচ্ছে না। একটু উঁকিঝুঁকি মারলেই হয়তো নিরাপত্তারক্ষী ভেতরে পুরে দিতে পারে। কোনওক্রমে ডিটেনশন ক্যাম্পের এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হল। ২১ দিন ধরে শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে রয়েছেন আনোয়ার নস্কর (নাম পরিবর্তিত)। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি শোনার পর কথা বলতে রাজি হলেও চোখে কেমন সন্দেহ। পালটা প্রশ্ন উড়ে এল। তবুও ক্যাম্পের ভিতরের ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হলেন না। বাঁশ ও তারজালির ফাঁক গলে তপ্তদুপুরেও ডিটেনশন ক্যাম্পের অন্দরের যেটুকু নজরে পড়ে শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার। পলকে রোহিঙ্গা স্মৃতি উসকে ওঠে। ৪০ লক্ষ অসমবাসীর ভাগ্য কি অন্ধকারেই!

 

The post নিজভূমে পরবাসী, ২১ দিন শিলচরের ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক যুবক appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement