সুকুমার সরকার, ঢাকা: কথা ছিল, এবছরই জন্মভূমি সাতক্ষীরায় এসে ঘুরে দেখবেন। কিন্তু নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশে আর পা রাখা হল না 'বাঞ্ছারাম'-এর। সাতক্ষীরা জেলা শহর ছাড়িয়ে ছয় কিলোমিটার দূরে ধুলিহর গ্রাম। এই গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মনোজ মিত্র (Manoj Mitra)। কিংবদন্তী অভিনেতার প্রয়াণে মনখারাপ সেই গ্রামেরও।
ধুলিহর গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শৈশবে পড়াশোনা করেছেন তিনি। সেখানকার প্রধান শিক্ষক দীপক কুমার মল্লিক জানালেন, "মনোজ মিত্র এই বিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন। পুরোনো নথিপত্র সব সংরক্ষিত রয়েছে আজও। একটি রেজিস্টার খাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখি, মনোজ মিত্র ওই বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৪৫ সালের ৫ জানুয়ারি। তাঁর জন্ম তারিখ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে- ১৯৩৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। বাবা অশোক মিত্রের পেশারও উল্লেখ রয়েছে এখনও দিব্যি।" রেজিস্টার খাতায় মনোজ মিত্রের নাম খুঁজে পাওয়ার পর অবাক হন প্রধান শিক্ষক-সহ বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকরাও।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, "মনোজ মিত্র সাতক্ষীরা তথা বাংলাদেশের কৃতী সন্তান। ধুলিহর গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁকে বড় করে তুলেছে। তিনি চলতি বছর সাতক্ষীরা আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। জন্মভূমি সাতক্ষীরার মানুষকে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ও নাটক দেখাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই পরিকল্পনা স্থগিত রাখা হয়। বড় বৃক্ষ বেঁচে থাকা মানে অনুপ্রেরণা। আমরা প্রেরণা হারা হলাম। 'বাঞ্ছা' আর আমাদের মাঝে ফিরবেন না। স্মৃতিগুলোই এখন সম্পদ। এ ভূখণ্ডের গন্ধ গায়ে মাখা তাঁর। আমরা তাঁকে নিয়ে বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান করব আগামিতে।"
২০১৯ সালের জুন মাসে একবার সাতক্ষীরায় এসেছিলেন মনোজ মিত্র। তখন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁকে। সেখানেই মনোজবাবু জানিয়েছিলেন, শৈশব থেকেই তিনি অভিনয় শুরু করেন। বাড়ির পাশে চণ্ডীতলায় তাঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি। বাবা সরকারি চাকরি করার সুবাদে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছেন। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁরা সপরিবার কলকাতায় চলে যান। মনোজ মিত্র বলেছিলেন, সাতক্ষীরার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিন যোগাযোগ ছিল না। এখন জন্মভূমি তাঁকে টানে। বারবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা হয় ধুলিহরের মাটি। ধুলিহরের মানুষ সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, জন্মভূমিতে কিছু একটা করার। আবার এসে সেসব বিষয় কথা বলবেন বললেও অসুস্থতার কারণে আর সাতক্ষীরায় আসতে পারেননি।
মনোজ মিত্র জানিয়েছিলেন, বাঞ্ছারাম চরিত্রটি তিনি বাংলাদেশ থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, "বাঞ্ছারাম কিন্তু আমার দেখা একজন জলজ্যান্ত মানুষ! আমার বৃদ্ধ পিসিমা একদিন বললেন- চল মনু, তোকে একটি পানের বাগান দেখিয়ে আনি! পিসি সেই পানের বরজের কাছে গিয়ে বাঞ্ছা…বাঞ্ছা বলে চিৎকার করে ডেকেছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি, পাটকাঠি দিয়ে ঘেরা পানের বরজ থেকে শুধু একটা মাথা বেরিয়ে পিসির দিকে তাকিয়ে। মাথাটা একজন বুড়ো মানুষের। মাথার চুল থেকে দাড়ি- সবই সাদা...। বাঞ্ছা কুঁজো হয়েই থাকেন, হাঁটেনও কুঁজো হয়ে। পরনে একটা নোংরা খাটো ধুতি, খালি গা। সে এক ভয়ংকর চেহারা! আমি ভয়ে পিসির গায়ে সেঁটে রয়েছি। বাঞ্ছারাম আমার কাছে এসে বললেন- কী খোকা, খুব ভয় পেয়েছ? আমি নির্বাক। তিনি তখন বললেন- দেখো, শুধু এই পানের বরজ নয়, ফুল, ফল, আম, কাঁঠালের যেসব গাছ দেখছ, সবই আমার। এই গাছগুলো আমার ছেলেপিলে। আমি এদের জন্ম দিয়েছি, পালন করেছি। এরা আমায় বাবার মতো ভালোবাসে। আমি আর কী বুঝব? ভয়েই মরি আর কি! কাছে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে চললেন তাঁর ভাঙা কুঁড়ের দিকে। সামনের একটা কাঁঠালগাছে হাত বাড়িয়ে বেশ মাঝারি সাইজের একটা কাঁঠালের বোঁটা ছাড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন- যাও, এটা নিয়ে বাড়ি যাও। কদিন বাদে পাকলে পিসিকে বলো ভেঙে দেবে। কাঁঠালটা খেও। সেই আমার প্রথম দেখা বাঞ্ছরামের সঙ্গে, চোখ ভরে দেখছিলাম তাঁর বাগানের বহর। কোন ফুল নেই সেই বাগানে, কোন সবজি ছিল না সেখানে। পরে পিসির কাছেই শুনেছিলাম, প্রতিদিন তিনি পানের বরজ থেকে একগোছ পান পাঠাতেন পিসির জন্য। একটা পয়সাও নিতেন না। কিন্তু গ্রামের অন্য কাউকে তিনি বাগানের ধারেকাছে ঘেঁষতেও দিতেন না। ওই পুরো বাগানই ছিল তাঁর একার সম্পত্তি।" মনোজ মিত্রর দীর্ঘ পথচলা আজীবন প্রেরণা জোগাবে দুই বাংলার নাট্যানুরাগী, শিল্পীদের।