সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: বদলের বাংলাদেশে বদলার রাজনীতি করছেন মহম্মদ ইউনুস! এবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-সহ শয়ে শয়ে নেতার মুক্তিযুদ্ধের সনদ বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছে ইউনুস সরকার। মুক্তিযোদ্ধা কারা, সেই সংজ্ঞাই বদলে ফেলা হচ্ছে। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিবৃত করার চেষ্টা চলছে 'নতুন বাংলাদেশে'। তাই তো মুজিব মুছতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের নাম রাখা হয়েছে ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে এক কুখ্যাত গণহত্যাকারী রাজাকারের নামে। ঢাকার রাস্তায় ঘুরতে দেখা যাচ্ছে হিজবুত তাহরিরের জঙ্গিদের। দাঁত-নখ বের করেছে আনসারুল্লা বাংলা টিম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় প্রতিপন্ন করে যারা আসল রাজাকার তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে প্রমাণ করতে চাইছে ইউনুস সরকার।
জানা গিয়েছে, বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ-সহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চারশোর উপর রাজনীতিবিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইনের সংশোধিত খসড়ায় এসব নেতাদের পরিচয় ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এমএনএ (জাতীয় পরিষদের সদস্য) ও এমপিএ (প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য) হিসেবে নির্বাচিত এই নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ গঠিত হলে তাঁদের সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তবে নতুন খসড়া আইনে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৯৪তম সভায় এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম সংশ্লিষ্ট খসড়ায় স্বাক্ষর করেন। সংশোধনীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি আরও চার শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’হিসেবে সনদ বাতিল করা হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে , 'বীর মুক্তিযোদ্ধা কেবল তাঁরাই থাকবেন, যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। রাজনীতিবিদরা সরাসরি যুদ্ধ করেননি, তাই তাঁদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করে নতুন পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে কোনও মর্যাদা কমানো হয়নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আরও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।'
এছাড়া খসড়া আইনে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, 'যাঁরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন, তারাই বীর মুক্তিযোদ্ধা।' সংশোধনীতে রাজনীতিবিদদের নাম বাদ দেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় থাকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও নার্সদের মুক্তিযোদ্ধার পরিবর্তে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই খসড়া অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এরপর এটি অধ্যাদেশ আকারে প্রকাশের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এখন শুধু ভুয়ো মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করার পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকের স্বীকৃতি বাতিল করতে তৎপর ইউনুস সরকার।
তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, "আইন বদলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান পরিবর্তন করা যায় না। এটি অপ্রয়োজনীয় এবং অপচয়মূলক উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। যদি কেউ ভুয়ো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে থাকে, তাহলে সেটি যাচাই করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।" মানবাধিকার কর্মী ও প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, "মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, কেবল সামরিক যুদ্ধ নয়। এ লড়াইয়ে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢালাওভাবে এমএনএ, এমপিএ ও গণপরিষদ সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিল করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।" এই পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই বদলে যাবে।