shono
Advertisement

Breaking News

বাঙালির আপন সুপারহিরো বাঁটুল দি গ্রেট! পাঁচ দশক পরেও অটুট জনপ্রিয়তার রহস্য কী?

হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জিতেই বাজিমাত!
Posted: 08:48 PM Jan 21, 2022Updated: 09:18 PM Jan 21, 2022

বিশ্বদীপ দে: গত কয়েকদিন ধরেই বাঙালির বড় মনখারাপ। তাদের ‘ছোটবেলার জাদুকর’ নারায়ণ দেবনাথ (Narayan Debnath) যে চিরকালের জন্য হেঁটে চলে গিয়েছেন অনন্তের দিকে! যদিও বহু আগেই আমজনতার হৃদয়পুরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছিলেন তিনি। তবু জাগতিক মৃত্যুর ভার শোকের আবহ তৈরি করবে এটাই স্বাভাবিক। সেই শোকের হাত থেকে সান্ত্বনা পাওয়ার একটাই উপায়। একবার ফিরে দেখা তাঁর সৃষ্টির সম্ভারকে। আর ভাবতে বসা, তুলি-কলমের কোন ম্যাজিক সঙ্গতে সম্ভব হল কয়েক প্রজন্মের এই আশ্চর্য সম্মোহন?

Advertisement

বাঙালির প্রথম সুপারহিরো বাঁটুল দি গ্রেটের কথাই ভেবে দেখা যাক। স্রষ্টা নিজেও হয়তো ভাবতে পারেননি হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরা এই অমিত শক্তিধর সরলমনা যুবককে মানুষ এত ভালবেসে ফেলবে। নাকি তিনি জানতেন সার্বিক ভাবে প্যাংলা, পেটরোগার বদনামে ভুগতে থাকা বাঙালির কাছে বাঁটুলের আইকন হয়ে ওঠাটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা? বলা মুশকিল। কিন্তু সচেতন ভাবেই হোক কিংবা স্রেফ এক্সপেরিমেন্ট, বাঁটুল প্রায় শুরু থেকেই খ্যাতি পেয়েছিল।

[আরও পড়ুন: গানে গানে শ্রদ্ধা নারায়ণ দেবনাথকে, আসছে দুর্নিবার সাহার মিউজিক ভিডিও ‘কমিক্স কাণ্ড’]

১৯৬২ সালে হাঁদা ভোঁদার আর্বিভাবের পরে যখন তা বেশ জমে উঠেছে, শুকতারার সম্পাদক তাঁকে বরাত দেন আরেক কমিক স্ট্রিপের। এরপরই জন্ম বাঁটুলের। সেটা ১৯৬৫ সাল। আকাশে বাতাসে বারুদের গন্ধ। দু’দশকেরও কম বয়স তখন স্বাধীন ভারতের। এর মধ্যেই ১৯৬২-তে সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে চিনের সঙ্গে। সেটা সামলে উঠতে না উঠতেই ’৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। বাংলার জৈষ্ঠে জন্ম বাঁটুলের। এর মাস তিনেকের মধ্যেই বর্ষাকালে লেগে গেল যুদ্ধ। দেব সাহিত্য কুটিরের তৎকালীন এক কর্ণধারের মাথাতেই প্রথম এসেছিল‌ আইডিয়া। বাঁটুল দি গ্রেটকে যুদ্ধে নামালে কেমন হয়? সেই আইডিয়া পত্রপাঠ লুফে নিলেন নারায়ণ দেবনাথ। বাংলার ১৩৭২ সালের কার্তিক, পৌষ ও মাঘ এবং পরের বছরের ভাদ্র ও আশ্বিন সংখ্যায় খান সেনাদের বিরুদ্ধে বাঁটুলের অনবদ্য সংগ্রাম বাঙালির মন জিতে নিল। ব্যাস। একটা কথা বহু সাফল্যের বর্ণনাতেই ব্যবহার করা হয়— এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কথাটা বাঁটুলের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।

আবির্ভাবের বছরেই খানসেনাদের নাকানিচোবানি খাইয়েছিল বাঁটুল

একটা বিষয় নেহাতই কাকতালীয় হলেও অবাক করে। বাঙালির আরেক কাল্পনিক আইকনেরও জন্ম ১৯৬৫ সালেই। রজনী সেন রোডে তার বাড়ি। হ্যাঁ, প্রদোষ মিত্র ওরফে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিরও সূচনালগ্ন সেবছরই। সেই যুবকও বাঙালির কাছে বুদ্ধিদীপ্ত স্মার্টনেসের এক চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবুও… ফেলুদা সুপারহিরো নয়। তার মগজাস্ত্রের যতই ক্ষমতা থাক, শেষ পর্যন্ত তা গোয়েন্দা কাহি‌নি। সুপারহিরোর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মজা বাঙালিকে প্রথম এনে দিল বাঁটুলই। তাই তার অনন্যতায় কেউ ভাগ বসাতে পারবে না।

[আরও পড়ুন: সন্ধে নামতেই ধান ঝাড়ার শব্দ, মাঝরাতে পুকুরে ঝাঁপ দিচ্ছে কেউ! ‘ভূতে’র আতঙ্কে কাঁটা দেগঙ্গা]

‘উইথ গ্রেট পাওয়ার কামস গ্রেট রেসপন্সিবিলিটি’। ‘স্পাইডারম্যানে’র ট্যাগলাইন কেবল মাকড়শা মানুষের কাহিনিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। তা যে কোনও অতিমানবের গল্পেরই মূল কথা। বাঁটুল তার আবির্ভাবের অব্যবহিত পরেই সেই দায়িত্ব পালন করে ফেলে দেশের ‘দুশমন’দের নিকেশ করে। এরপর আর তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে সময় লাগবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। পরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও লড়েছিল বাঁটুল। অনেক পরে কার্গিলের যুদ্ধেও তাকে দেখা গিয়েছিল।

গুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায় শরীর, এমনই অপ্রতিরোধ্য বাঁটুল

তবে বাঁটুল কেবলই লড়াই করে বেড়ালে, সে আমাদের এত আপন হয়ে উঠতে পারত না। তার অধিকাংশ কমিকসেই রয়েছে নিখাদ মজা। সমসাময়িক ঘটনাস্রোতের পাশাপাশি এই ফুরফুরে মজা মনের সব ক্লেদকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়। বাঁটুলের মধ্যে হিরোইজমের সঙ্গে দারুণ ভাবে মিশে গিয়েছে এক সরল বালক মন। ফলে ছোটদের মনে হতে থাকে, আরে এ তো আমাদেরই মতো। নিজের শক্তি সম্পর্কেও সে যেন কেমন উদাসীন। দুম করে হয়তো কিছু একটা সরাতে গেল। দেখা গেল মচাৎ করে আরও অনেক কিছুই উপড়ে ফেলেছে সে। তাতে বাকিরা নাজেহাল তো বটেই। সে নিজেও চরম ভ্যাবাচ্যাকা। শক্তি ও সারল্যের এই বৈপরীত্য বাঁটুলের জনপ্রিয়তার গ্রাফকে এত বছর ধরে ধরে রেখেছে— একথা বললে বোধহয় ভুল বলা হবে না।

বাঁটুলের এত বছরের অভিযানে দেখা মিলেছে তার যে আপনজনদের তারা হল— বন্ধু লম্বকর্ণ (যার শ্রবণক্ষমতা তাক লাগিয়ে দেয়), পিসি, পোষা কুকুর ভেদো। বাঁটুলের পোষা এক উটপাখিও ছিল। নাম তার উটো। আর অবশ্যই অধিকাংশ কাহিনিতে তার ‘দুশমন’ দুই বিচ্ছু। যারা নানা ভাবে কায়দা করতে যায় বাঁটুলকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেরাই বেকায়দায় পড়ে। সবথেকে বড় কথা, বাঁটুল দুই ওস্তাদকে হাড়ে হাড়ে চিনেও প্রতিবারই এদের ট্র্যাপে পা দিয়ে ফেলে সরল বিশ্বাসে। আর এই জায়গায় এসেই বাঁটুল তার ছোকরা বয়সকে অতিক্রম করে এক বালকেরই চরিত্রকে প্রতিফলিত করে ফেলে। নন্টে আর ফন্টে কিংবা হাঁদাভোঁদার সাফল্যের রসায়ন অন্য। তাদের নিজেদের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া মোটেই শক্ত কিছু নয়। বরং প্রতি পদেই মনে হবে, ‘‘আরে এ তো আমারই মতো।’’ বাঁটুলের ক্ষেত্রে কাজটা কিন্তু কঠিন ছিল। আর সেই কঠিন কাজটাকে নারায়ণ দেবনাথ সহজে করতে পেরেছিলেন তার চরিত্রের মধ্যে সারল্যকে প্রতিষ্ঠা করেই। এটাই ছিল মাস্টারস্ট্রোক।

সৃষ্টির মগ্নতায় স্রষ্টা

আরেকটা কথা মনে হয়। এই যে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট— এই পোশাক প্রায় সব ধরনের আর্থ-সামাজিক স্তরকেই চিহ্নিত করে। ফলে যে কোনও পাঠকই চরিত্রটিকে নিজের লোক ভেবে ফেলতে পারে। বিশেষ করে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই বাস করতে হয় অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্য ও অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে, সেখানে এই পোশাক যেন আইডিয়াল।

সাদা-কালো। কিংবা দু’রঙা। তবু কীভাবে যেন তাঁর অন্যান্য কমিকসের মতোই একটা অদ্ভুত চৌম্বক ক্ষমতা তৈরি করে ফেলতে পেরেছিলেন নারায়ণবাবু। এমন নয়, রিপিটেশন নেই। অনেক সময়ই ঘটনাপ্রবাহ একটা নির্ধারিত ছকেই যেন বয়ে চলে। তবু পড়তে বসলে শেষ পর্যন্ত না দেখে উপায় নেই। ছোটবেলায় ‘শুকতারা’ হাতে পেলেই মলাট উলটে পরের পাতাতেই বাঁটুলের কাণ্ডকারখানা দেখতে বসে পড়েছি আমরা। আমরা মানে বেশ কয়েকটা প্রজন্ম। ‘এক্স’ ফ্যাক্টর যে একটা ছিলই, সেটা না মেনে তাই উপায় থাকে না। আরেকটা কথা মনে হয়। এই যে এত বছর ধরে চরিত্রগুলোর বয়স তো বটেই, স্বভাব কিংবা গল্পের চরিত্রও সেভাবে বদলানো হয়নি সেটাও নারায়ণ দেবনাথের সাফল্যের অন্যতম রসায়ন। সময় যতই বদলে যাক, বাঁটুল থেকে গিয়েছে বাঁটুলের মতোই। বদলায়নি দুই ওস্তাদ কিংবা লম্বকর্ণরাও। একেবারেই শৈশবের মতো— অপরিবর্তনশীল।

ছোটরা আজও বই পড়তে ভালবাসে একই রকম

বাঁটুল তাই থেকে যাবে। হয়তো এই সময়ের ছোটদের কাছে অপশন অনেক বেশি। তবু বইমেলায় বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা কিনতে তাদের উৎসাহকে অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি যারা আজ আর ছোট নেই, তারাও তো রয়েছে। বুড়োধাড়ির দলকে এক নিমেষে হাফপ্যান্টের বয়সে নামিয়ে আনতে গেলেও বাঁটুলকেই প্রয়োজন। বড়বেলার যাবতীয় তেতো কষটা স্বাদকে হেলায় সরিয়ে রেখে ছোটবেলার অফুরান রোদহাওয়ায় ফুসফুস ভরে নিতে হলে নারায়ণ দেবনাথ ও তাঁর সৃষ্টিদের কাছেই ফিরে যেতে হবে আমাদের। বারবার। লাগাতার। বিজ্ঞাপনের সেই সাবানের মতোই। অফুরান মজাদার ফেনার প্রাচুর্য সত্ত্বেও যার কোনও ক্ষয় নেই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement