shono
Advertisement

Breaking News

বদলা নয়, রনজি ফাইনালে ভাগ্য বদলের খোঁজে বঙ্গ ক্রিকেটের ‘ক্ষিদ্দা’ লক্ষ্মীরতন শুক্লা

বাংলাকে রনজি জেতাতে যা দরকার, সব করব, মন্তব্য লক্ষ্মীর।
Posted: 08:50 AM Feb 14, 2023Updated: 08:50 AM Feb 14, 2023

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: আমি বাংলায় গান গাই/আমি বাংলার গান গাই/ আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই…

Advertisement

লক্ষ্মীরতন শুক্লা (Lakhi Ratan shukla) এখন ঘুমোতে যান রাত সাড়ে ন’টায়, ওঠেন ভোর পাঁচটায়। উপায় নেই। কাকভোরে উঠে টিমকে নিয়ে মাঠে দৌড়তে হয়, শরীরের দেওয়াল-ঘড়ির সময় বদলে নিতে হয়েছে সেই অনুপাতে। বিগত কয়েক মাস ধরে অপরিবর্তিত এই রুটিন। পাঁচটায় উঠে সাতটায় মাঠ, গিয়ে ব‌্যাটারদের নিত‌্য পাঁচশো করে বল ছোঁড়া, নেট বোলারের জোগাড়যন্ত্র। কিন্তু পরিশ্রম-প্রশ্নে সপাট ছয়ের মতো উত্তর আসে, ‘‘শুনুন, এটা বাংলা। আমার বাংলা। এখানে আপস চলবে না। অফ সিজনে দু’বেলা ট্রেনিং করিয়েছি। তিন ঘণ্টা সকালে, তিন ঘণ্টা বিকেলে। টিমের স্কিল, এনডিওরেন্স বেড়েছে কতটা দেখেছেন? মধ‌্যপ্রদেশ মাঠে পাঁচ দিন লড়ে পারল আমাদের সঙ্গে?’’ ফাঁপা আওয়াজ নয়, লক্ষ্মী করেছেন এ সমস্ত,‌ করেন এ সমস্ত। এই যেমন রনজি ফাইনাল খেলতে শহরে ফিরে সোমবার সকালে ছুটলেন ইডেন। একা। ইডেন পিচ কেমন দাঁড়াচ্ছে, দেখতে হবে না?

[আরও পড়ুন: EXCLUSIVE: ‘শুধু রাজকোটে খেলে ফাইনালে উঠিনি’, রনজি ফাইনালের আগে হুঁশিয়ারি উনাদকাটের]

আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন/আমি বাংলায় বাঁধি সুর/ আমি এই বাংলার মায়াভরা পথে হেঁটেছি এতটা দূর…

খেলা ছেড়েছেন, নয়-নয় করে আট-নয় বছর হল। কিন্তু গত আট-ন’বছরে বাংলা ক্রিকেটকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারলেন কোথায় এলআরএস? খেলা ছাড়ার পর রাজনীতিতে এলেন, তবু বাংলা ক্রিকেটকে ছাড়তে পারলেন না। লাল বাতি আর হুটার বাজিয়ে ইডেনে বাংলার ম‌্যাচে ঢুকে পড়তেন প্রায়শই। ‘‘বাংলা ছাড়া আমার আর আছেটা কী?’’ অস্ফুটে বলেন লক্ষ্মী। নাহ্, নেই। মনেপ্রাণে যিনি বিশ্বাস করেন, এই বাংলায়, এই বাংলার ক্রিকেটে তাঁর জন্মগত অধিকার। বাংলা সিনিয়র টিমের কোচিংয়ে লক্ষ্মী এসেছেন পরে, অনূর্ধ্ব পঁচিশ টিমে আগে। ভবিষ‌্যৎ প্রতিভা আগে খুঁজে বার করতে হত, তার পর না বর্তমানের গুরুভার বহন। আর হিরে চিনতে যে তাঁর ভুল হয় না, তার প্রমাণ সুদীপ ঘরামি। যিনি লক্ষ্মীর সেই অনূর্ধ্ব ২৫ টিমের ফসল, বঙ্গ ক্রিকেটকে অধুনা আরও শস‌্য-শ‌্যামলা প্রতিনিয়ত করছেন যিনি। আর দিতে হত দু’জনকে প্রাপ‌্য সম্মান, দুই সিনিয়রকে।

অনুষ্টুপ মজুদারের প্রয়োজন ছিল নিরাপত্তা, যাঁকে একটা সময় বাদ দিতে উদ‌্যত হয়েছিল অরুণ লালের টিম ম‌্যানেজমেন্ট। এলআরএস তাঁকে বলে দিয়েছিলেন যে, ‘‘এই টিমের তুই-ই সব। তুই-ই অলিখিত ক‌্যাপ্টেন, তুই-ই কোচ!’’ মনোজ তিওয়ারিকেও ফিরিয়ে দিতে হত তাঁর হারানো মর্যাদা। বছরখানেক আগেও তো মনোজের মতামত নিতে আসত না টিম। লক্ষ্মী দায়িত্ব নিয়ে মনোজকে অধিনায়কের রাজমুকুট দিয়ে দেন। বলে দেন– এটা তোর টিম, তুই চালাবি!

[আরও পড়ুন: মহিলা আইপিএলের নিলামে রেকর্ড দর পেতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন মন্ধানা, দেখুন ভিডিও]

‘‘যা ঠিক মনে হয়েছে, করেছি। বাংলাকে রনজি (Ranji Trophy) জেতাতে যা দরকার, সব করব। বাংলার হয়ে খেলেছি, অধিনায়কত্ব করেছি। কিন্তু কখনও রনজি জিতিনি। কোচ হিসেবে এবার তো একটা চেষ্টা করতে পারি, স্বপ্ন দেখতে পারি, তাই না?’’ বলার সময় এলআরএসের চোখের কোণ কি ভিজে যায় একটু? গলা কিছুটা আর্দ্র শোনায়?

আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে/ করি বাংলায় হাহাকার/ আমি সব দেখেশুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার…

কড়া হেডস‌্যর নয়, নিজেকে টিমের ‘বড়দা’ হিসেবে ভাবতে বড় ভালবাসেন বঙ্গ কোচ। জুনিয়রদের আগলে রাখেন, কিন্তু বেচাল বরদাস্ত করেন না। কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর দু’টো কাজ নিঃশব্দে করেছেন লক্ষ্মী। প্রথমত, ইতিহাসগত ভাবে বাংলা টিমের যা চিরন্তন ‘অসুখ’, সেই দলাদলি, গ্রুপবাজির পাট পুরো চুকিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, মিডিয়ায় খবর ফাঁস বন্ধ করেছেন। ‘‘আমি কি বকাঝকা করি না নাকি? অবশ‌্যই করি। কিন্তু ড্রেসিংরুমে কাকে কী বললাম, সেটা লেখার জন‌্য নয়,’’ কণ্ঠস্বর এবার বেশ গরগরে শোনায়। ‘‘আমার দর্শন খুব সহজ। ভাল করলে প্রশংসা আমার টিম পাবে। কিন্তু ব‌্যর্থতার বুলেট আমি নেব। আমি যখন কোচ, দায়টাও পুরো আমারই। দোষারোপে আমি বিশ্বাস নই। আমি এটা বলায় বিশ্বাসী নই যে, প্লেয়ার পারল না, আমি কী করব?’’ হে বাংলার পূর্বতন কোচ-রাশি, শুনছেন আপনারা?

বাংলা আমার তৃষ্ণার জল/তৃপ্ত শেষ চুমুক/ আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ…

অধুনা ক্রিকেটে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটারদের খেলা ছাড়ার পর হালফিল সুযোগ কত! আইপিএলে কোচিং স্টাফ টিমে নাম লেখানো যায়, জাতীয় ক্রিকেট অ‌্যাকাডেমিতে ঢুকে পড়া যায়, মোটা অর্থে ভিন রাজ‌্যের কোচিং করানো যায়। কিন্তু তিনি এলআরএস, রাজনীতি থেকে সরে আসার পরেও কিছুই করলেন না, পড়ে রইলেন ‘এলআরএস বাংলা ক্রিকেট অ‌্যাকাডেমি’ নিয়ে, বিনা কাঞ্চনমূল‌্যে প্রতিভা অন্বেষণে। কেন? ‘‘সবার আগে আমি বাংলাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তাই কোথাও যাইনি। টাকার কথা ভাবলে তো আগে আইসিএলেও যেতে পারতাম,’’ বলার সময় লক্ষ্মীর মুখাবয়বে প্রচ্ছন্ন একটা গর্ববোধ আপনমনে খেলা করে। ‘‘বিশ্বাস করেছিলাম, বাংলা ফাইনাল খেলবে। খেলছে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এবার জিতব। আগে আমরা অন‌্য টিম নিয়ে ভাবতাম। আমার বাংলা সে সমস্ত দেখে না। এই যে ফাইনালে জয়দেব উনাদকট খেলবে, আলাদা করে দুর্ভাবনায় পড়ব নাকি? আর একটা কথা। সৌরাষ্ট্র বদলার ম‌্যাচ, প্রচুর শুনছি। কিন্তু ওই সমস্ত অহেতুক আবেগ দেখানোয় আমি নেই। আবেগ মানুষকে পিছিয়ে দেয়। আগে জিতি, আগে চ‌্যাম্পিয়ন হই, আবেগ তার পর।’’

শুনলে মনে হয়, ইডেনে তেত্রিশ বছর পর রনজি ফাইনালে লক্ষ্মীরতন বদলার বাংলা চান না। চান বদলের বাংলা। রেজাল্ট নিয়ে ভাবতে চান না। বরং বাংলা ক্রিকেটের ‘ক্ষিদ্দা’ চান শুধু লড়াই। যে ভাবে লড়ে আসছে তাঁর টিম, এত দিন। ফাইট বাংলা, ফাইট!

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement