স্টাফ রিপোর্টার: এত সিজার কেন? কেনই বা গ্রাম মফস্বলের প্রসূতিরা সিজার করতে চাইছেন? কমে যাচ্ছে স্বাভাবিক প্রসবের হার? কেন এখনও প্রত্যাশিত হারে রাশ টানা যাচ্ছে না এক্ল্যামসিয়া অর্থাৎ মাত্রাতিরিক্ত প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণের মতো সমস্যায়? এবার এ সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজতে হন্যে হয়ে কাজ শুরু করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতি মৃত্যু বেড়ে চলায় উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্যভবন। সম্প্রতি তৈরি করেছে ম্যাটারনাল ডেথ রিভিউ (এমডিআর) কমিটি।
স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগমের পৌরহিত্যে সেই কমিটির প্রথম বৈঠক স্বাস্থ্যভবনে হতে চলেছে মঙ্গলবার। বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন স্বাস্থ্যকর্তাদের পাশাপাশি সব জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ও সব সরকারি হাসপাতালের সুপাররা। আর থাকছেন স্বাস্থ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন এমডিআর কমিটির ১৬ জন সদস্যও। তাতে যেমন রয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা সৌমিত্র মোহন, স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য, পরিবার কল্যাণ অধিকর্তা অসীম দাস মালাকারের মতো শীর্ষস্থানীয় স্বাস্থ্যকর্তারা, তেমনই থাকছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ শাখার বেশ কয়েক জন শিক্ষক-চিকিৎসক, এমনকী ইউনেসেফের প্রতিনিধিও। আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে জেলাস্তরের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের তাঁরা বুঝিয়ে দেবেন, প্রসূতি মৃত্যুর হার কমাতে কী কী করণীয়। পাশাপাশি, জেলাস্তরের অভিজ্ঞতাও শুনবেন এমডিআর কমিটির সদস্যরা।
[আরও পড়ুন: মৃত ব্যক্তিদের নামে সরকারি প্রকল্পের ঘর! ভূতুড়ে কাণ্ডে চাঞ্চল্য কালনায়]
পরিবার কল্যাণ অধিকর্তার কথায়, স্বাস্থ্যকর্তাদের প্রাথমিক উপলব্ধি হল, মারাত্মক হারে বেড়ে গিয়েছে অযৌক্তিক ও অনর্থক সিজারের সংখ্যা। সেই অনুপাতে প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি যথাযথ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বাভাবিক প্রসবের হার। এবং সর্বোপরি প্রতিটি প্রসূতির ক্ষেত্রে এখনও নিশ্চিত করা যায়নি গর্ভাবস্থাকালীন চেক-আপ। বিশেষ করে আসন্নপ্রসূতিদের চেক-আপ ‘মিস’হয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। ফলে ধরা পড়ছে না প্রসূতিদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক জটিলতা। প্রসূতি মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে এই সব ক’টি কারণের ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি প্রসূতি মৃত্যুর হার রাজ্যে বেড়ে যাওয়া সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করায়, সপ্তাহ দেড়েক আগে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় স্বাস্থ্যভবনে আয়োজিত ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা বৈঠকে। সেখানেই স্বাস্থ্যদপ্তরের পদস্থ কর্তারা জেলাস্তরের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের মহিলাদের গর্ভাবস্থাকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার নির্দেশ দেন। তার পরেই গঠিত হয় এমডিআর কমিটি।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৭-১৯ সালের স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সার্ভের (এসআরএস) রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, ২০১৬-১৮ সালের তুলনায় সাম্প্রতিকতম এই রিপোর্টে সারা দেশই প্রসূতি মৃত্যুর হার বা ম্যাটারনাল মর্টালিটি রেশিও (এমএমআর) কমানোর ব্যাপারে প্রভূত উন্নতি করেছে। প্রতি লাখে প্রসূতি মৃত্যুর হার বা এমএমআর দেশের ক্ষেত্রে ১১৩ থেকে কমে হয়েছে ১০৩। কমেছে সিংহভাগ রাজ্যেরই প্রসূতি মৃত্যুর হার। কিন্তু হরিয়ানা, ছত্তিশগড় ও উত্তরাখণ্ডের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে বেড়ে গিয়েছে এমএমআর। রাজ্যে ২০১৬-১৮ সালে এমএমআর ছিল ৯৮। কিন্তু তা ২০১৭-১৯ সালে বেড়ে ১০৯ হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টি চিন্তায় ফেলেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। তাই মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকদের পাশাপাশি হাসপাতাল সূপারদের প্রসূতি মৃত্যু নিয়ে দায়বদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর স্বাস্থ্যভবন।
[আরও পড়ুন: তীব্র দাবদাহে বাংলায় প্রথম মৃত্যু! প্রাণ গেল হাওড়ার টোটোচালকের]
স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, এর জন্য এএনএম নার্স ও আশাকর্মীদের আরও সুচারু ভাবে কাজে লাগাতে হবে। এবং এ সব কিছুই তদারক করতে হবে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে। প্রতিটি হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে প্রসূতি মৃত্যুর অডিট করা হবে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের নোডাল অফিসার হিসেবে এর দায়িত্ব নিতে হবে কোনও একজন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, ‘সুপার গোটা হাসপাতালেরই প্রতিটি বিষয়ের উপর নজর রাখবেন। এবং তাঁরই দায়িত্ব সুশৃঙ্খল ভাবে হাসপাতাল চালানো। প্রতিটি ডাক্তারবাবুর কাজকর্মের উপর নজর দেওয়ার জন্য সুপারকে দায়িত্ব দিয়েছে স্বাস্থ্যভবন।’ তাঁর মতে, এই দায়িত্বটা স্বাস্থ্য দপ্তর কেন্দ্রীয় ভাবে নিলে প্রশাসনিক ক্ষমতার যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ হবে না। তাই যথাযথ প্রশাসনের স্বার্থে সুপারকেই প্রসূতি মৃত্যু ঠেকানোর জন্য পদক্ষেপ করতে হবে।