সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: 'বাঁদনা', 'সহরায়' পরবের রঙে রঙিন সাবেক মানভূম। রাঙা পুরুলিয়া। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, কুঁড়েঘর সেজে উঠেছে দেওয়াল চিত্রে। দেওয়ালই যেন ক্যানভাস! আর সেই ক্যানভাসে নানা কারুকাজ, সমাজজীবনের ছবি। সবটাই প্রাকৃতিক রঙে। আর তাই 'বাঁদনা' পরবকে ঘিরে চোখ টানছে পুরুলিয়া। গ্রামে গ্রামে হাজির আলোকচিত্রী থেকে পর্যটক। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, "এই পরব সাবেক মানভূমের প্রাণের উৎসব। পুরুলিয়ার এমন কোনও গ্রাম নেই যেখানে এই উৎসব হয় না। মূলত গো-বন্দনা এই উৎসবের মূল বিষয়। তবে এই উৎসবকে ঘিরে দেওয়াল চিত্র আলাদাভাবে চোখ টানে।"
বৃহস্পতিবার কালীপূজার দিন থেকে এই উৎসবে মেতে উঠলেন জঙ্গলমহলের এই জেলার কৃষিজীবী মানুষ। যা চলবে তিনদিন ধরে। কোথাও আবার পাঁচদিন। 'বাঁদনা' পরব আসলে আমন ধান বাড়িতে তোলার আগে গরু-গাভীদের বন্দনা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর রীতি। গ্রামবাংলার মানুষের বিশ্বাস, কালীপূজার রাতে মর্ত্যলোকের প্রতিটি বাড়িতে আসেন স্বয়ং মহাদেব। তাই বাড়ির মহিলারা ঘরকে নানাভাবে সাজিয়ে তোলেন। অমাবস্যার রাতে গোয়াল ঘরে সারারাত জ্বালিয়ে রাখেন ঘিয়ের প্রদীপ 'জাগড় হাঁড়ি'। এই রাতে পুরুষেরা দল বেঁধে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে ঢোল-ধামসা সহকারে অহিরা গান গেয়ে, প্রদীপ জ্বালিয়ে জাগিয়ে রাখেন গরুকে - "অহিরে-জাগহো লক্ষ্মী, জাগহো ভগবতী....।"
প্রদীপ জ্বালিয়ে জাগিয়ে রাখা হচ্ছে গবাদি পশুকে। আড়শার বামুনডিহা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।
মহিলারা মাঠ, চাষের জমি থেকে চুনামাটি, খড়ি মাটি, পলিমাটি-সহ বিভিন্ন ধরনের মাটি সংগ্রহ করেন। সেই মাটিতে মিশিয়ে দেন গোবর। এরপর শুকোতে হয় দেওয়াল। তারপর দেওয়া হয় খড়িমাটি। এর পর প্রাকৃতিক রং দিয়ে সেই সাদা দেওয়ালে নানা রকম নকশা ও গাছপালা আঁকেন। এই পরবের সঙ্গে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের নিবিড় সম্পর্ক। সেই কারণেই প্রকৃতি থেকেই রং সংগ্রহ করে থাকেন মহিলারা। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে ধরে রাখেন তাঁদের সৃজনশীলতা। কালো-কাঠ, টায়ার, খড় পোড়ানো ছাই, ভুসাকালি থেকে হয় কালো রঙ। লাল গেরু মাটি থেকে হয় লাল। আলয় মাটি, বনক মাটি বা হলুদ থেকে হয় হলুদ। খড়ি মাটি বা কলি চুন থেকে হয় সাদা। নীল বড়ি, জামাকাপড় দেওয়ার নীল থেকে নীল। আর সিমের পাতা থেকে সবুজ। এছাড়া গেরুয়া ও নীল রং মিশিয়ে করা হয় সবুজ।