দেব গোস্বামী, বোলপুর: অত্যাচারী ইংরেজদের লুকিয়ে বিপ্লবীদের কার্যকলাপ চালু রাখতেই মূর্তির কাঠামোই বন্দেমাতরম লিখে এই পুজোর শুরু। শুধু মায়ের আরাধনাই নয়, বিপ্লবীদের এক ছাতার তলায় আনার সুযোগ করে দিত ইলামবাজারের ব্রাহ্মণপাড়ার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাপুজো। ব্রিটিশ আমলে শুরু হওয়া ওই পুজো মানে কেবলমাত্র লোকাচার বা পূজার্চনা ছিল না। তা ছিল বিপ্লবীদের একজোট করে পরিকল্পনা রূপায়ণের আস্তানা।
বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই পুজোর প্রতিটি ছত্রেই রয়েছে বিপ্লবদের ফিরে ফিরে দেখা। পুজোর সঙ্গে থাকত রাজকীয় আয়োজন। পাশের এলাকা থেকে পুজো দেখার জন্য মানুষ ভিড় জমাতেন মন্দিরে। জমিদারির বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ফিকে হয়েছে বৈভব। কিন্তু পুজোটাই যেন ইতিহাস। আজও দেবী দুর্গাকে দেশমাতৃকা রূপেই পুজো করা হয়। এখনও প্রতিমার চালচিত্রে বন্দেমাতরম লেখা থাকে। শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ইলামবাজারের আদি পুজোরূপেই খ্যাত।
মূলত দুই পরিবারের মেলবন্ধনে এই পুজো। ইলামবাজারের তাম্বুলি ও বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। তাম্বুলি পরিবাররা অজয় নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পান চাষ করত পরিবার। পানের উৎপাদন এত বেশি ছিল যে বীরভূম ছাড়িয়ে বর্ধমান-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার চাহিদা মেটাত। প্রচুর অর্থ উপার্জন হওয়ায় ইংরেজদের নজরে পড়লে শুরু হয় নীল চাষ।
অন্যদিকে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার বিপুল সম্পত্তি ছাড়াও গালা শিল্পের সূচনা করেছিলেন। সেই গালা দিয়ে গয়না খেলনা থেকে শুরু করে গৃহসজ্জা নানা জিনিস তৈরি হত। আর এই শিল্পের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বাংলার নবাবের দরবারে। বৈষ্ণব মতে পুজোর চারদিন বন্দোপাধ্যায় পরিবারের দায়িত্ব থাকলেও। তাম্বুলি পরিবারের অষ্টমীর চাল কুমড়ো ও নবমীর আঁখ বলির প্রথা আজও রয়েছে। আজও দুই পরিবারের সৌভ্রাতৃত্বে প্রথা মেনেই দুর্গাপুজোর আয়োজন।
[আরও পড়ুন: সপ্তমীতে রাজ্যে এলেও সুকান্তর অনুরোধ রাখছেন না নাড্ডা! প্রশ্ন বিজেপির অন্দরে]
পরিবারের সদস্য মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বাংলার ১২৫৩ সালে বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদার পরিবারের ব্যোমকেশ ও বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গামন্দির ও নারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বৈদ্যনাথ ছিলেন অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত। বন্দেমাতরম ধ্বনি দেওয়ার অপরাধেই বার বার তাঁকে ইংরেজদের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল এবং জেল খাটতে হয়েছিল। তাও পিছু হটেননি। ইংরেজ আমলে বন্দেমাতরম বলা ব্রিটিশের চোখে ছিল অন্যায়। পরিবারের সদস্যরা তোয়াক্কা না করেই প্রতিমার চালচিত্রে বন্দেমাতরম কথাটি লিখতে শুরু করেন। সেই প্রথা আজও রয়েছে। দেশ স্বাধীন করার জন্য স্বদেশি যুগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে লড়াই করেছিলেন আমাদের বাড়ির পুজো আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। স্বদেশি যুগেও এই পুজোর রক্ষার সমান উৎসাহী ছিল স্থানীয় বাসিন্দারাও।”