স্টাফ রিপোর্টার: এসআইআরে পশ্চিমবঙ্গে ৯৯.৪২ শতাংশ এনুমারেশন ফর্ম বিলির নির্বাচন কমিশনের দাবি ঘিরে রাজ্যজুড়ে প্রবল ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, বিএলও-দের সঙ্গে গত ১৩দিন ধরে বাড়ি বাড়ি ঘোরা সমস্ত রাজনৈতিক দলের বিএলএ-রা প্রকাশ্যে তথ্য দিয়ে দাবি করছেন, অধিকাংশ বুথেই রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬০ থেকে ১৮০টির বেশি ফর্ম বিলি হয়নি। কোথাও বিলি না হওয়া ফর্মের সংখ্যা আরও বেশি। এই বিলি না হওয়া ফর্মের মধ্যে মৃত ও ঠিকানা বদল করা ভোটারের সংখ্যাই বেশি। ছুটির দিন হওয়ায় এদিন অনেকে বিএলও-র সঙ্গে যোগাযোগ করে ফর্ম সংগ্রহ করেছেন। আবার অনেকেই এরই মধ্যে ফর্মপূরণ করে জমা দিতে শুরু করেছেন। শোনা যাচ্ছে, বিএলও-রা বাড়ি না গিয়ে এক জায়গায় বসে ফর্ম সংগ্রহ করছেন।
কলকাতা দক্ষিণের নির্বাচন অফিস সূত্রে খবর, রাত ৮টা পর্যন্ত কমিশন ৯৯.৪২ শতাংশ দাবি করলেও বাস্তবে রবিবার পর্যন্ত ৮০-৮২ শতাংশের মতো ফর্ম ভোটারদের হাতে পৌঁছেছে। উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের তরফে সিইও অফিসের নির্দেশ বলে গত বৃহস্পতিবারই সমস্ত বিএলও-দেরই ১০০ শতাংশ ফর্ম বিলি দেখাতে প্রবল চাপ দেওয়া হয়। বলা হয়, যে ফর্মগুলি এখনও বিলি হয়নি সেগুলি 'বণ্টন হয়েছে' বলে কমিশনের অ্যাপে দেখিয়ে দিন। বস্তুত নির্বাচনী অফিসারদের সেই গোপন নির্দেশের মোবাইল 'মেসেজ' এখন নানা রাজনৈতিক দলের হাতে কমিশনের বিরুদ্ধে একটি বড় অস্ত্র হিসাবে উঠে এসেছে। স্বভাবতই কমিশন বাংলায় যে ১০০ শতাংশ ফর্ম বিলির দাবি করছে, তা নিয়েই বিএলও থেকে রাজনৈতিক মহলে বড় ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তরফে বুলেটিনে রবিবার দাবি করা হয়, পশ্চিমবঙ্গে এখনও পর্যন্ত ৭ কোটি ৫৯ লক্ষ ৯৪ হাজার ৯৯৭ ফর্ম বিলি হয়েছে। ৯৯ শতাংশের বেশি ফর্ম বিলি হয়েছে আন্দামান-নিকোবর, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশেও। ১০০ শতাংশ ফর্ম বিলি হয়েছে গোয়া ও লাক্ষাদ্বীপে। তামিলনাড়তে সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৯৩.৬৭ শতাংশ এনুমারেশন ফর্ম বিলি হয়েছে বলেও কমিশনের দাবি। তবে বাংলার রাজনৈতিক মহলের দাবি, বিএলও-দের চাপ দিয়ে বুথ পিছু '৬০ থেকে ১৮০টি বিলি না হওয়া ফর্ম' অ্যাপে দেখিয়ে ১০০ শতাংশ বণ্টন দেখানোর পিছনে নিশ্চয়ই কমিশনের কোনও নয়া মতলব রয়েছে। এখানেই শেষ নয়, কমিশনের অ্যাপে দেখিয়ে দিলেও হাতে জমা থাকা গোছা-গোছা এনুমারেশন ফর্ম নিয়ে এখন প্রবল চাপে বিএলও-রা। কী করবেন এই বিলি না হওয়া শতাধিক ফর্ম?
রাজ্যের অধিকাংশ বিএলও-দের ক্ষোভ, নিত্যনতুন ফর্মুলা এবং অ্যাপ বদল করে কাজের পরিকাঠামো আরও জটিল করে দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। জমা পড়া ফর্মের যাবতীয় তথ্য অ্যাপে তুলতে বলছেন, যা বিএলও-দের মোবাইল সার্ভারের সমস্যায় সব সময় সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণ ও গ্রামে স্মার্ট ফোন ব্যবহারে অনভিজ্ঞ বিএলও-দের ক্ষেত্রে হিমালয় সমান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু স্রেফ নিজেদের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন বিএলওদের ঘাড়ে সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়ে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলায় আগেই একজন বিএলও নির্বাচন কমিশনের প্রবল কাজের চাপে মারা গিয়েছেন। অনেক বিএলও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। খাস কলকাতায় কাজের অসুস্থ হয়ে পড়েন এক বিএলও। রবিবার সকালে কলকাতার পুরসভার ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২০৫ পার্টের বিএলও অনিমেষ নন্দী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে বেলেঘাটার এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে, বীরভূমের বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের লোহারগড় গ্রামে গোলাম নেহরু মণ্ডল নামে এক বিএলও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরিবারের দাবি, অতিরিক্ত মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তির জেরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গোলাম।
অভিযোগ, যেখানে দু'জন করে বিএলও দেওয়ার কথা সেখানে বারোশো থেকে তেরোশো ভোটারের বুথেও মাত্র একজন করে বিলও দিয়েছে কমিশন। স্বভাবতই কাজের চাপে অসুস্থ ভিনরাজ্যের বহু বিএলও। এদিনই কাজের চাপ সামলাতে না পেরে কেরলে আত্মঘাতী এক বিএলও। পরিবার ও পরিচিতিদের অভিযোগ, ভোটার তালিকার এসআইআর কাজের চাপে মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন ওই বিএলও। সেই চাপ সহ্য করতে না পেরেই চরম পদক্ষেপ করেছেন বলে তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ। বিষয়টি নিয়েই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেই থানায় এদিনই এফআইআরও দায়ের হয়েছে। মৃত বিএলও-র নাম অনীশ জর্জ। পয়ান্নুরের এক সরকারি স্কুলে পিওনের কাজ করতেন তিনি। পুলিশ সূত্রে খবর, রবিবার নিজের বাড়ি থেকে অনীশের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। তদন্তকারীদের প্রাথমিক অনুমান, আত্মহত্যা করেছেন তিনি। অনীশের আত্মহত্যার নেপথ্যে 'এসআইআরের কাজের চাপকে দায়ী করছে তাঁর পরিবার।
