সাবিরুজ্জামান, লালবাগ:প্রাচীনকালে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগের অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। ভাগীরথী নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা মিউজিয়াম হোটেল 'দ্য হাউস অফ শেহেরওয়ালি'র ডাইনিং রুমকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী আস্ত নৌকা দিয়েই। মূলত গ্রামীণ এলাকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাস পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতেই পূর্ব ভারতের প্রথম মিউজিয়াম হোটেল এই শেহেরওয়ালি।
মুর্শিদাবাদ জেলার ইতিহাস, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। এখানে ডাচ, ওলন্দাজ, ব্রিটিশের পাশাপাশি বাণিজ্যে বসত গড়েন দূগড়, দুধরিয়া, নওলক্ষা, সিংঘী, শেঠ সমাজ। মূলত এই সমাজকে শেহেরওয়ালি বলা হয়। শেহেরওয়ালি সমাজের একটি বড় অংশ বাস করতেন জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাড়ের প্রাচীন আজিমগঞ্জ শহরে। এই সমাজের একটি পোড়ো বাড়ি সংস্কার করে শেহেরওয়ালি সমাজের প্রবীণ সদস্য প্রদীপ চোপড়ার হাতে গড়ে উঠল 'দ্য হাউস অফ শেহেরওয়ালি'।
ভাগীরথী নদীর একেবারে পাড় বরাবর চারতলার এই হোটেলে মোট ১২০ জন আবাসিক থাকতে পারবেন। স্থানীয় শেহেরওয়ালি সমাজের সদস্য রানি ধন্যা কুমারী, নিলম নওলক্ষার নামে ডরমিটরি করা হয়েছে। তেমনই মহিলাদের জন্য 'জানানা'এবং পুরুষদের জন্য 'মর্দনা' নামে আলাদা থাকার ঘর করা হয়েছে। নৌকা দিয়ে সাজানো ডাইনিং রুমের নাম রাখা হয়েছে 'নৌকাঘর'। একই ভাবে প্রতিটি অলিন্দে শোভাবর্ধন করছে শেহেরওয়ালি সমাজের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং আদিকালের ব্যবহৃত আসবাবপত্র থেকে অলঙ্কার।
এখানে এলেই পরিচয় ঘটবে শেহেরওয়ালি সমাজের প্রথিতযশা পূর্ব পুরুষ ও পোশাক পরিচ্ছদের সঙ্গে। ফেলা দেওয়া জিনিসপত্র ব্যবহার করে নির্মাণ শিল্পে ব্যয় সঙ্কোচ করা হয়েছে। তেমনই পরিবেশের কথা মাথায় রেখে সবুজের সমারোহে মোড়ানো হয়েছে বিলাসবহুল এই মিউজিয়াম হোটেল। কর্তৃপক্ষের দাবি, খাবারেও রাখা হবে শেহেরওয়ালি ঘরানা। বিউটি পার্লারের পাশাপাশি শরীর চর্চার জন্য থাকছে জিমের ব্যবস্থা। এহেন হোটেলে দলবদ্ধ স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা জলখাবার-সহ থাকতে পারবেন মাত্র দেড় হাজার টাকায়। সাধারণ পর্যটকদের জন্য খরচ ধার্য করা হয়েছে দু'হাজার টাকা। গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণের জন্য নোঙর করা আছে আধুনিক বার্জ। সম্পূর্ণ নিরামিষ আহারের এই হোটেলে ধূমপানেও নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।
ঐতিহ্য সংরক্ষণ তো বটেই। সেই সঙ্গে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের জন্য হোটেলে কাজ দেওয়া হয়েছে এলাকার পুরুষ-মহিলাদের। এই বিষয়ে পাঁচগ্রামের বাসিন্দা রাধুনি গোপাল বেহারা বলেন, "ভাবিনি বাড়ির কাছে এত বড় হোটেলে কাজ পাব। খুব গর্ব অনুভব করছি।" বিলুপ্তির পথে শেহেরওয়ালি সমাজের ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং ইতিহাসের আদানপ্রদান করতে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন প্রদীপ চোপড়া। তিনি বলেন, "নতুন প্রজন্মের কাছে অতীত ইতিহাস তুলে ধরতেই এই কর্মকাণ্ড। দেশের প্রতিটি ছোট শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি তুলে ধরতে এই ধরনের মিউজিয়াম আরও হোটেল গড়ে তোলা দরকার। এতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। সেই সঙ্গে ভারতের গৌরবময় ঐতিহ্য দেশ বিদেশের পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা যাবে।"