সুতীর্থ চক্রবর্তী: জোড়বাংলো থেকে অভয়ারণ্যের যে পথে চটকপুর (Chatakpur) পৌঁছলাম সেই পথে এই সময়ে অনায়াস যাতায়াত ভল্লুক আর চিতাবাঘের। পাহাড়ে বর্ষা ঢুকে গিয়েছে। ১৫ তারিখ থেকেই এই সেনচাল অভয়ারণ্যে গাড়ি ঢোকা নিষিদ্ধ হবে তিন মাসের জন্য। কারণ এটা বন্যপ্রাণীদের প্রজননের সময়। সকাল থেকে পাহাড়ে বৃষ্টি চলছে অঝোরে। এবড়ো খেবড়ো বুনো রাস্তা দিয়ে ঝরনার মতো বইছে জলের ধারা। ঝোপঝাড়, গাছের ডালপালা ভেদ করে পাহাড়ের বুক চিরে সেই ঝরনা পথ ধরে সন্তর্পণে গোর্খা যুবক গাড়ি গন্তব্যে নিয়ে এলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে পথেই চিতাবাঘের (Leopard) দেখা মেলে। প্রকৃতি এতটাই বিরূপ যে জঙ্গলে বৃষ্টির আওয়াজ ও পাহাড় থেকে জল ঝরার শব্দের সিম্ফনি ভেদ করে আসা দুয়েকটা পশুর ডাক শুনেই তুষ্ট থাকতে হল। ঘণ্টাখানেকের এইরকম একটা রোমাঞ্চকর যাত্রা শেষ করে পাহাড়ের বুকে ছোট্ট গ্রাম চটকপুর।
ইদানীং পাহাড়ের পর্যটন মানচিত্রে চটকপুর উঠে এসেছে। চিতাবাঘ, ভল্লুকের (Bear) সঙ্গে লড়াই করে এই গ্রামে একশো বছর ধরে মাত্র ১৯টি পরিবারের বাস। এই মুহূর্তে জনসংখ্যা সাকুল্যে ৮৪। গত কয়েকবছরে দার্জিলিংয়ের থেকে আরও ৬০০ মিটার উঁচুতে জঙ্গলের মধ্যে এই দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে পর্যটন এতটাই বেড়েছে যে ১৯টি পরিবারই ‘হোম স্টে’ (Home Stay) ব্যবসায় যুক্ত হয়ে গিয়েছে। আর এইসব ‘হোম স্টে’-গুলির পরিষেবা চোখ ধাঁধানো। টয়লেটে ইতালীয় কমোড। ইনস্ট্যান্ট গিজার। ওয়াশিং মেশিন। ডিশ অ্যান্টেনা। দেওয়ালে কাঠের প্যানেল। ফলস সিলিং। বাইরের কঠিন পরিবেশের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য বৈপরীত্য।
[আরও পড়ুন: ‘ফ্যাটি হার্ট’ই ডেকে আনল কেকে’র মৃত্যু! কেন হয় এই সমস্যা?]
অভিষেক ছেত্রীর পরিবার মাত্র তিন বছর আগে হোম স্টে চালু করেছে। পাঁচ ঘরের হোম স্টে। তাঁর বোন পূজার নামেই হোম স্টে‘র নামকরণ। “আমরা ভাইবোনরা কেউ বিয়ে করিনি। টাকাপয়সা জোগাড় করে চালু করে দিলাম। আমাদের গ্রামের সব বাড়িতে এখন হোম স্টে। কাজের অভাব অন্তত মিটে গিয়েছে”, অভিষেক ওঁদের জীবনযুদ্ধের কথা বলছিলেন। যে পথে বাঘ, ভল্লুক বেরয় সেই পথেই হেঁটে হেঁটে স্কুল যেতে হত। এখান থেকে সোনাদা। সাত কিলোমিটার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খাড়া পাহাড়ি রাস্তা। “সকালে বেরিয়ে সন্ধেতে স্কুল থেকে ফিরতাম,” অভিষেক বলছিলেন, “এই দুর্ভোগ যে পাহাড়ে পুরোপুরি গিয়েছে তা নয়। তবে জীবন তো আগের তুলনায় সহজ অনেক।” হোম স্টের স্বার্থেই সবার ঘরে এখন গাড়ি। সোনাদা যাওয়া এখন গোটা দিনের বিষয় নয়।
চটকপুরের গল্প পাহাড়ের অধিকাংশ গ্রামেই। হোম স্টে গ্রামে গ্রামে অর্থনীতি বদলে দিয়েছে। হোম স্টে তৈরির প্রাথমিক লগ্নি মিলছে ব্যাংক থেকে। সরকারি সাহায্যও রয়েছে বিভিন্ন কর্মসংস্থান প্রকল্পের মাধ্যমে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে শহরের ব্যবসায়ীদের লগ্নি। অভিষেক জানালেন, সরকারি কিছু অনুদান ছাড়া বাকি লগ্নি তাঁদেরই। একটা ঘর থেকে ধীরে ধীরে পাঁচটা হয়েছে। জঙ্গল বন্ধের তিনমাস ছাড়া সারা বছর সব ঘর বুকড। হোম স্টে’র এই আয়ের উপরন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী ইত্যাদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবিধ সামাজিক প্রকল্প। অভিষেক বলছিলেন, “পূজার নামে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা আসছে। দুয়ারে রেশন আসছে। এগুলো তো আমাদের কষ্ট কমিয়েছে। সে কথা অস্বীকার করি কী করে?”
দার্জিলিংয়ে ম্যালের উপরেও বড় বড় করে চোখে পড়ে দুয়ারে রেশনের বিজ্ঞাপন। দুয়ারে রেশনের উপযোগিতা সবচেয়ে ভাল উপলব্ধ হয় এই পাহাড়েই। বস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকল্পগুলির উপস্থিতি পাহাড়ে এখন জোরালো। বাম আমলে পাহাড়বাসীর কাছে রাজ্য সরকার ছিল ব্রাত্য। গত কয়েক বছরে পাহাড়ের এই ছবিটা বদলে গিয়েছে। বিমল গুরুংয়ের বাড়ি ও রাজ্যপাট দার্জিলিংয়ের একপ্রান্ত সিংমারিতে। ঠিক তার উলটোপ্রান্ত ডালিতে বিনয় তামাঙের বাড়ি। বিনয়ের পাড়ায় পতপত করে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। সিংমারিতেও গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার পতাকা বিরল। নর্থ পয়েন্ট স্কুলের সামনে গুরুংয়ের অনশনের ম্যারাপ পুরো শুনশান। পাহাড়জুড়ে বরং দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনিত থাপার নবগঠিত গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার ও অজয় এডওয়ার্ডসের হামরো পার্টির প্রচার গাড়ি। পাহাড়ের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে এটা ব্যতিক্রমী ছবি। হোম স্টে বিপ্লব আর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রকল্প পাহাড়ের শতাব্দীপ্রাচীন জাতিসত্তার দাবিকে কিছুটা ফিকে করেছে।
[আরও পড়ুন: বশ মানাতে পারতেন বাঘ-সিংহকে, ব্রাজিলীয় সেনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই বাঙালি যুবক!]
চটকপুরের ১৯ ঘর ভোটারের বুথ সোনাদায়। ভোট দিতে যাওয়া মানে সারাদিনের ব্যাপার। ৬০-৬৫টি ভোটের জন্য এই দুর্গম অঞ্চলে প্রচারে আসে না কোনও দলই। অভিষেক বললেন, “আমরা সবার হিসাবের বাইরে। তবু ভোট দিতে যাব। ভোটহীন বন্ধের দিন আর ফেরানো যাবে না।” পাহাড়ের হোম স্টে বিপ্লবের এই ক্ষুদ্র সৈনিকের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়ার বাসনা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়। দুর্গম গোর্খা গ্রামগুলিতে এই পরিবর্তিত চেতনা স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পারে পাহাড়কে।